সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বাংলাদেশের পালা বদলের পরে কেটে গিয়েছে এক বছর। ইউনুসের নেতৃত্বে চলছে নতুন প্রশাসন। দোলাচলের বাংলাদেশে চাপের মুখে অবশেষে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন ইউনুস। তার আগে একাধিক সংস্কার চলছে নির্বাচন কমিশনের আওতায়। এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউনুসের ‘নতুন’ বাংলাদেশে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে অর্থনীতি। ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদাণকারী সংস্থাগুলি জোর ধাক্কা খেয়েছে। ঋণখেলাপির মাত্রা অনেকটাই বেড়েছে। বিদেশি লগ্নিতে ভাটা পড়েছে। সব মিলিয়ে, আপাতদৃষ্টিতে সংস্কার ব্যর্থ। এই পরিস্থিতিতে দিল্লির আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনার ভোটাধিকার বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত তাঁর ‘বদলা’রই প্রতিফলন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
এশিয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি) সম্প্রতি একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে। সেই মূল্যায়নে দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি সে দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুতর সংকটের মুখোমুখি। বলা হয়েছে যে মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও দেশের অর্থনীতির তিনটি স্তম্ভ—ব্যাঙ্কিং, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা এবং শেয়ার বাজারের স্থিতিশীলতা ফেরেনি এখনও। অন্যদিকে দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতির জালে আটকে পড়ছে দেশ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী বছর নির্বাচনের আগে আরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এছাড়াও আরও ৩ লক্ষ ১৮ হাজার কোটি টাকার খোঁজ মেলেনি বলে জানিয়েছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, এর মধ্যে ১ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা আদালতে আটকে রয়েছে। ৮০ হাজার কোটি টাকা মকুব করা হয়েছে এবং ৬০ হাজার কোটি টাকা আদালতের স্থগিতাদেশের আওতায় রয়েছে। ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, আগের সরকারের সাহায্যে ঋণের নামে বহু টকা নয়ছয় করেছে বাংলাদেশের সংস্থাগুলি। এই দাবির বিপরীতে দাঁড়িয়ে এডিবি জানিয়েছে, এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটির মতে, ২০২৪ সালে দেশের মোট বিতরণ করা ঋণের ২০.২ শতাংশ মেটানো হয়নি। এই পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্নর ডক্টর আহসান এম মনসুর জানিয়েছেন, ‘এখন থেকে কোনও তথ্য গোপন করা হবে না। সব ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হবে। পাশপাশি, তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের প্রচেষ্টা জোরদার করা হবে।’
একই অবস্থা ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলির। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় সমস্যার প্রভাব পড়েছে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলির উপরেও। জানা গিয়েছে, এই ক্ষেত্রে সমস্যার অবস্থা ব্যাঙ্কিং-এর তুলনায় অনেকটা বেশি। ২০ টি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থায় ঋণ খেলাপের পরিমাণ ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এই টাকা মোট ঋণ দেওয়া টাকার ৮৩ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের সংস্থাগুলি প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। আমানতকারিদের টাকা ফেরাতে পারছে না বহু সংস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত, এই ২০টি সংস্থার মোট ঋণ ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। কিন্তু এই ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পদের পরিমাণ মাত্র ছয় হাজার ৮৯৯ কোটি। এটি মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের দাবি এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন না হলে আমানতকারীদের টাকা ফেরানো সম্ভব হবে না। এই সমস্যার সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক মোট নয় সংস্থকে বন্ধ করে দেওয়ার করার প্রস্তাব দিয়েছে। এই সংস্থা বন্ধ করে তাঁদের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা ফেরানো হবে আমানতকারীদের। আহসান মনসুর জানিয়েছেন, ‘চিন্তা করার কোনও কারণ নেই। সরকার সব দায়িত্ব নেবে।’
তীব্র অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের শেয়ার বাজার। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৬ বছরে শেয়ার বাজার ৩৮ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। বার্ষিক তিন শতাংশ হারে বিনিয়োগ করা টাকা হারাচ্ছেন লগ্নিকারীরা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ জানিয়েছে, শেয়ার বাজারে থাকা ৩৯৭ সংস্থার মধ্যে ৯৮টি সংস্থার শেয়ারের দাম রয়েছে ১০ টাকার নিচে। এরমধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি সংস্থার শেয়ারের দাম ৫ টাকার কম। শেয়ারের দাম কমে যাওয়া প্রমাণ করেছে এই সংস্থাগুলির ব্যবসা কমেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। খারাপ ব্যবসা হচ্ছে যে সংস্থাগুলির সেগুলিকে একত্রিত করে নতুন সংস্থার বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকার সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সৈফুল ইসলাম বলেন, ‘শেয়ার বাজারে বেশি মাত্রায় থাকা জাঙ্ক শেয়ার বিদেশী এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বিমুখ করছে। দুর্বল কোম্পানিগুলিকে দ্রুত বন্ধ বা একত্রিত করতে হবে, এবং নতুন শক্তিশালী কোম্পানিগুলিকে বাজারে আনতে হবে।’ বাংলাদেশের মানুষের ধারণা ইউনুস প্রশাসন দেশে সংস্কার করার চেষ্টা করলেও, বিশেষজ্ঞরা এখনও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে সে বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন