সুমিত বিশ্বাস, কাশীপুর (পুরুলিয়া): ঘড়ির কাঁটায় তখন সোমবার বেলা ১১টা ৪৭। রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালানে বেজে উঠল ঢাক। গাছের ছালে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় ৯টি পাতায় ৯টি লাইন লেখা। সেই গুপ্তাতিগুপ্ত ‘শ্রীনাদ’ মন্ত্র পাঠে শুরু হল দুর্গাপুজো।
তারপরই আগমনী গান। “আজকে পেলাম তোমায় উমা / মনের মাঝে রাখতে চাই / আঁধার ভবন করলে আলো / এবার না মা বলবে যায়।” এরপর চণ্ডীপাঠ, বলিদান ও আরতি।
অথচ দেবীর বোধন দুর্গা ষষ্ঠীর বাকি ১২ দিন। ৫ দিন বাকি মহালয়ার।
এখনও হয়নি ভাদুর জাগরণ। বিশ্বকর্মার আরাধনারও একদিন বাকি। কিন্তু তার আগেই তিথি-নক্ষত্র যোগে পুজো শুরু হয়ে গেল পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারে।
জিতা অষ্টমীর পরের দিন সোমবার আদ্রা নক্ষত্র যুক্ত কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে একেবারে ছাগ, চালকুমড়ো বলিদানের মধ্য দিয়ে পুজো শুরু হয়। বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই পঞ্চকোট রাজপরিবারের দেবী বাড়িতে রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালানে ১৬ কল্পের পুজো অতীতে কবে হয়েছিল মনে করতে পারছেন না ওই পরিবারের সদস্যরা। তিথি-নক্ষত্রের এমনই যোগ যে কাশীপুর রাজবাড়ি জ্যোতি প্যালেসে ভাদু আসার আগেই মায়ের বোধন হয়ে গেল। পিতৃপক্ষেই মহালয়ার আগে রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালানে শিখরবাসিনী দুর্গার আরাধনা ফি বছরই হয়ে থাকে। কয়েক বছর আগে মল মাসে তিথি-নক্ষত্র যোগে ১৬ কল্পের পুজোর দিনও বেড়ে যায়। কিন্তু বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই শিখরবাসিনী দুর্গার আরাধনা শুরুর উদাহরণ অতীতে রয়েছে কিনা তা ইতিহাস ঘেঁটেও সামনে আনতে পারেননি রাজ পরিবারের সদস্যরা।
পঞ্চকোট রাজপরিবারের সদস্য তথা সিপাহী বিদ্রোহের মূল উদ্যোক্তা মহারাজাধিরাজ নীলমণি সিং দেও-র প্রপৌত্র সৌমেশ্বরলাল সিং দেও বলেন, “বিশ্বকর্মা পুজোর আগে মায়ের পূজো শুরু হয়ে গিয়েছে এমন উদাহরণ অতীতে রয়েছে কিনা তা এখনই বলতে পারব না। আসলে আমাদের পুজো তিথি-নক্ষত্র যোগে হয়ে থাকে। তবে এটা ঠিক বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই মায়ের আরাধনা শুরু সাম্প্রতিককালে হওয়ার উদাহরণ নেই। রাবণবধ করার জন্য শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার আরাধনার সূচনার্থে যে বোধন করেছিলেন, সেই অকালবোধনের বিধি মেনেই পঞ্চকোট রাজপরিবারের পুজো হয়। শকাব্দ ২ থেকে এই পুজো হয়ে আসছে আমাদের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালানে।”
মা শিখরবাসিনী দুর্গা এখানে অষ্টধাতুর তৈরি। চতুর্ভুজা। একহাতে জপমালা, আর এক হাতে বেদ। বাকি দুই হাতে বরদান ও অভয়। গলায় নরমুণ্ডমালা। পদ্মফুলের উপর বসে থাকা রাজরাজেশ্বরী মূর্তির দুর্গা ১৬ দিন ধরে পূজা পায়। ১৬ দিনের এই পুজো ষোল কল্পের দুর্গাপুজো নামে পরিচিত। দু’হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন এই পুজোর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। নানা পৌরাণিক আখ্যান। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীর ধার নগরের মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর জগদ্দেও সিং দেও-র কনিষ্ঠ পুত্র দামোদরশেখর সিং দেও বাহাদুর চাকলা পঞ্চকোটরাজের প্রতিষ্ঠাতা। এই রাজস্থাপনের সময় থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষের কুলপ্রথা অনুযায়ী শকাব্দ ২ থেকে এই পুজো শুরু হয়। রাবণবধ করার জন্য শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাদেবীর আরাধনার সূচনার্থে যে ‘বোধন’ করেছিলেন। যা ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত। সেই মত অনুসারেই ধারনগরের প্রথা এবং কুলাচারকে মেনে মহারাজা দামোদরশেখর সিং দেও বাহাদুর এই জঙ্গলমহলে দুর্গাপুজো শুরু করেন।
দামোদরশেখরের নামানুসারে এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলের নাম ‘শেখরভূম’ বা ‘শিখরভূম’ নামকরণ হয়। তাই এই দুর্গার নামও হয় শিখরবাসিনী দুর্গা। বর্তমানে পঞ্চকোট রাজ দেবোত্তর-র সেবাইত বিশ্বজিৎপ্রসাদ সিং দেও-র তত্ত্বাবধানে পূজো হয়। এই রাজবংশের রাজধানী গড়পঞ্চকোট থেকে শুরু করে পাড়া, কেশরগড়, কাশীপুর যেখানে রাজত্ব স্থানান্তরিত হয়েছে, সেখানেই এই পুজো চলছে ধুমধাম সহকারে। এখানে নিত্য পুজোতে অন্ন ভোগ দেওয়া হলেও ১৬ কল্পের এই পুজোর ভোগে থাকে বিশেষ আয়োজন। যা টানা ১৬ দিন ধরে চলে। তবে মায়ের কাছে থালাতে করে ভোগ নিবেদন করেন এই রাজরাজেশ্বরীর ঠাকুরদালানের কর্মচারী দেওঘরিয়া-রা। এই উপাধি রাজাদের দেওয়া। যে থালায় ভোগ নিবেদন করা হয় সেই থালা নিয়ে পঞ্চব্যঞ্জনে সেই প্রসাদ আহার কেবল দেওঘরিয়ারা-ই করতে পারেন। রাজপরিবারের সদস্যরা সেই ভোগ পেলেও নিবেদন করা থালায় পঞ্চব্যঞ্জন সহযোগে প্রসাদের আহার করতে পারেন না। এটাই রীতি। এদিনও সেই ছবি দেখা গেল।
বলিদান করা অবনী দেওঘরিয়া ঠাকুর দালানের এক কোণে মায়ের কাছে নিবেদন করা বড় থালায় পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে আহার করছেন। তাঁর কথায়, “এই প্রসাদ বিলি করার পর সবাই খেতে পারেন। কিন্তু মাকে যে পাত্রে ভোগ নিবেদন করা হয়, সেই পাত্রে পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে প্রসাদ দেওঘরিয়ারা ছাড়া আর কেউ খেতে পারেন না।” যে বনমালী পণ্ডিতের হাত ধরে এই পুজো শুরু হয়, তাঁদের বংশধর বর্তমানে গৌতম চক্রবর্তী এই পুজো করে থাকেন। তাঁর কথায়, “রাজরাজেশ্বরী দেবী-ই হলেন কল্যাণেশ্বরী দেবীর প্রতিমূর্তি। যিনি মাইথনের কাছে সবনপুরে প্রতিষ্ঠিত। এই মা ভূজ্যপত্রে (গাছের ছাল) বা খত (চিঠি)-তে অঙ্গীকার করেন, ‘আমার প্রতিমূর্তি রাজরাজেশ্বরীর মন্দিরে যতদিন যাবৎ দুর্গাপুজো হবে আমি সেখানে মহাষ্টমীর দিন সন্ধিক্ষণে বিশেষরূপে অধিষ্ঠিত হব। এবং প্রমাণস্বরূপ দেবী দুর্গার যন্ত্রে সিঁদুরের ওপর পায়ের ছাপ ফেলে আসব।’ তাই মহাঅষ্টমীর সন্ধিক্ষণে এই শিখরভূমে মা দুর্গার পায়ের ছাপ দেখা যায়। তাই তো কথিত আছে, “মল্লেরা শিখরে পা / সাক্ষাৎ দেখবি তো শান্তিপুরে যা….।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.