সুমন করাতি, হুগলি: বাংলা এবং বাঙালি ইস্যুতে উত্তাল রাজ্য রাজনীতি। বিজেপিশাসিত একাধিক রাজ্যে বাঙালি শ্রমিকদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ সামনে আসছে। যা নিয়ে ইতিমধ্যে সোচ্চার হয়েছে শাসকদল তৃণমূল। শহর এবং শহরতলির বহু দুর্গাপুজোই (Durga Puja 2025) এবার বাঙালি অস্মিতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এই ভাবনাকে সামনে রেখে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। এবার ইতিহাস বহন করে চলা কোন্নগরের ঘোষাল বাড়ির নাটমন্দিরে ফুটে উঠবে ‘বাংলা ভাষা-বাঙালি অস্মিতা’র কথা। নাটকের মাধ্যমে তা তুলে ধরা হবে। এবার এই বাড়ির পুজো ৫৭১ বছরে পড়ল! প্রতিবাদস্বরূপ এবার এই বাড়ির পুজোয় ফুটে উঠবে এহেন ভাবনা।
হুগলির এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একাধিক ইতিহাস। হুগলির ঘোষাল পরিবার জমিদারি পায় ১৪৫৪ সালে। বাড়ির ঠাকুর দালানেই সেই সময় থেকে আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু হয়। ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ সরকার ঘোষাল বাড়ির এই পুজোকে একটা সময় স্বীকৃতিও দিয়েছিল। পুজো করতে দেওয়া হত অনুদানও। তবে সেই ব্রিটিশরাজ এখন নেই! তাতে কি, এখনও ধূমধাম করে ঘোষাল বাড়িতে হয় এই পুজো। তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই পুজোর সঙ্গে মিশেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বদল এসেছে অনেক কিছুতেই। কিন্তু শ্রদ্ধা, রীতি এখনও অটুট রয়েছে। ছেদ পড়েনি প্রথাতেও।
শিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে এলাকায় ঘোষাল বাড়ির পুজো পরিচিত। একটা সময় পুজোর দিনগুলিতে ঠাকুর দালানে বসত নাটক, যাত্রাপালের আসর। এমনকী ওস্তাদ বুরদুল খান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সঙ্গীতশিল্পীরাও এই বাড়ির ঠাকুর দালানে বসে গান গেয়ে গিয়েছেন। এখনও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে! তবে বাড়ির সদস্যরাই নাটক, গানের মাধ্যমে পুজোর দিনগুলিতে উমাকে আবাহন জানান।
বাড়ির সদস্যদের কথায়, ষষ্ঠীর দিন থেকে বিসর্জন সবটাই একেবারে রীতি, প্রথা মেনে পালন করা হয়। এই বাড়ির বিশেষত্বগুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, পুজোর দিনগুলিতে বাইরের দোকানের মিষ্টি ব্যবহার করা হয় না। বাড়ির মহিলারা নিজেরাই নাড়ু তৈরি করেন। তাই দিয়েই হয় ঠাকুরের প্রসাদ। অষ্টমীর দিনে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালান বাড়ির পুরুষরা। দশমীর দিন দেবীকে ইলিশ মাছের বিশেষ ভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে। কনকাঞ্জলি দিয়ে বরণ করে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন বাড়ির মহিলারা।
এই বাড়িতে মায়ের বিসর্জন হয় সকালে। এর পিছনে রয়েছে এক করুণ কাহিনী। আগে নিয়ম মেনে নৌকায় সবাই মিলে মাঝ গঙ্গায় প্রতিমাকে ভাসানো হত। নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর চলও ছিল। কিন্তু এক বিসর্জনের রাতে পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। পরিবারের এক সদস্যকে বাঘের আক্রমণে পড়তে হয়। এরপর থেকে ঘোষাল বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জন সকালে হয়ে আসছে ।
পরিবারের বর্তমান বংশধর প্রবীর ঘোষাল বলেন, “দুর্গাপুজোর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। দিল্লিতে মুঘল সাম্রাজ্য, সেই সময়ে এই বাড়ির পুজো শুরু হয়। ইংরেজদের শাসনকালে পুজোর জন্য বিলেত থেকে অনুদান আসত। তৎকালীন সময়ে ৭৫০ টাকা। এই টাকা এতটাই বিপুল ছিল যে পুরো পুজো হওয়ার পরও টাকা শেষ করা যেত না। তাই ঘোড়ার গাড়ি চেপে শ্রীরামপুরের খাজাঞ্চি খানায় আবারও টাকা ফেরত পাঠাতেন বাড়ির লোকজন। সেই প্রথা এখনও চলে আসছে।”
এখানেই শেষ নয়, প্রবীরবাবুর কথায়, ”রীতি মেনে পুজোর দিনগুলিতে পরিবারের সদস্যরাই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন এখনও। এবার তা হবে নবমীর দিন। নাচ গানের সঙ্গেই একটা নাটকও মঞ্চস্থ হবে। সেটির নাম দেওয়া হয়েছে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি অস্মিতা”। ঠাকুর দালানে এখন সেই নাটক এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রিহার্সাল চলছে।
অন্যদিকে বাড়ির মহিলা সদস্য তনুশ্রী ঘোষাল বলেন, পুজোর প্রত্যেকটা দিন বাড়ির মহিলারা খুবই আনন্দের সঙ্গে কাটাই। নাড়ু তৈরি থেকে শুরু করে ভোগ রান্না, একেবারে সবকিছু নিষ্ঠা ভাবে করা হয়”।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.