Advertisement
Advertisement
Durga Puja 2025

‘অচ্ছুৎ’ নয়, পুজোর আয়োজক! প্রথমবার উমা আবাহনে পুরুলিয়ার কুষ্ঠরোগীরা

দেবী দুর্গার ছবি আর দুর্গোৎসবের হরেক কার্টুন-ব্যানারে সেজে উঠেছে হোম।

Durga Puja 2025: Leprosy patients organising Durga Puja for the first time in Purulia
Published by: Sucheta Sengupta
  • Posted:September 18, 2025 6:23 pm
  • Updated:September 18, 2025 6:25 pm  

সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: দুর্গাপুজো এলেই মনখারাপ হয়ে যেত। চোখ ভরে উঠত অশ্রুতে। এখনও যে তাঁরা সমাজে অচ্ছুৎ! তাঁদের কাছে ঘেঁষতে চান না সাধারণ মানুষ। পরিবারও তাঁদের ঘরে তোলেনি। পুজোমণ্ডপ দেখতে গিয়ে সকলের ছোঁয়া বাঁচিয়ে দূর থেকেই চলত দুর্গাদর্শন। কারণ, তাঁরা একসময় কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাবা-মা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ায় যেন সমাজে ‘শাস্তি’-র মুখে পড়েছেন ছেলেমেয়েরাও। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিকভাবে ঘুরতে-ফিরতে পারেন না যে! এই সমাজ আজকের দিনেও এড়িয়ে চলে কুষ্ঠরোগীদের। সকলের ‘বাঁকা নজরে’ পড়তে হয়। কিন্তু এবছর সেই অতীত মুছে যেতে বসেছে। পুরুলিয়ার আদ্রার মণিপুর লেপ্রসি রিহ্যাবলিটেশন সেন্টারে এই প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন হচ্ছে। মায়ের আগমনে উৎসাহের শেষ নেই সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এই হোমের।

Advertisement

মায়ের ছবি আর দুর্গোৎসবের হরেক কার্টুন-ব্যানারে সেজে উঠেছে হোম। উত্তর ২৪ পরগনার বিরাটির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে ওই হোমের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে উমা এখানে পা রাখছেন প্রথমবার। পুজোর দিনগুলিতে এই হোমের আবাসিকরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে তাঁদের সাংস্কৃতিক প্রতিভা তুলে ধরার জন্য চলছে অনুশীলন। গানে-গানে অনুশীলনেই আগমনি বার্তা স্পষ্ট। সব আবাসিকের মুখে হাসি, উচ্ছ্বাস, আবেগ। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে সকলেরই যে নতুন জামাকাপড় হয়ে গিয়েছে। এখন শুধুই পুজোর আয়োজন। যা নিজেদের হাতে সামাল দিচ্ছেন আবাসিকরা। এই হোমের কর্ণধার নবকুমার দাস বলেন, “২০০২-০৩ আর্থিক বছর থেকে সরকারি তত্ত্বাবধানে আমাদের এই হোম চলছে। তারপর থেকে বহু পুজো পার হয়েছে। কোনওবার পুজোর আগে হোমে এত আনন্দ, এত খুশি দেখিনি। এই প্রথম পুজোর আয়োজনের উদ্যোগ নিতেই সমগ্র হোমের চেহারাটাই যেন বদলে গিয়েছে। এই হোমের বহু আবাসিকদের পুজো দেখতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হতো। বোধহয় এই আয়োজনের পর আর এমন সমস্যা হবে না।”

তাঁদের শরীরে একসময় কুষ্ঠ রোগ বাসা বেঁধেছিল। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তাঁদের ছেলে-মেয়েদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গিয়েছে এই হোম। এমন সংখ্যাটা এই হোমে প্রায় ১৫০ জন। হোম কর্তৃপক্ষের কথায়, এখানে এই ধরনের আবাসিক তাঁরাই, যাঁদের পরিবার ফিরিয়ে নেয় না বা তাঁদের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। এই আবাসিকদের জন্য সরকারি তরফে হোম কর্তৃপক্ষকে ১০ শতাংশ টাকা দিতে হয়। বাকি অর্থ দেয় সরকার। পুটু পান্ডা নামে এক আবাসিক বলেন, “আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এটাই আমাদের ঘর। সে ঘরেই এবার মা উমা আসছেন। আমাদের যে কী আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না। আর পুজো দেখতে গিয়ে আমাদেরকে দূরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে না। একেবারে কাছ থেকেই মাকে দর্শন করতে পারব।”

পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত পুরুলিয়ার আদ্রার মণিপুর লেপ্রসি রিহ্যাবলিটেশন সেন্টারে। নিজস্ব ছবি।

আরেক আবাসিক ৮৭ বছরের পল্টু চক্রবর্তীর কথায়, “খুব আনন্দ হচ্ছে। মা মুখ তুলে তাকিয়েছেন। আর কয়েকদিন পরেই তো ঢাক বাজবে। কতদিন পর যে এমন মন খুলে বাঁচার আনন্দ পাচ্ছি বলে বোঝাতে পারব না।” হোমের আবাসিক হিসেবে থাকা কিশোর-কিশোরীরা গীতি আলেখ্য পরিবেশন করবে। চলছে তার চর্চা। কিন্তু এই আয়োজন কি ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও হোম কর্তৃপক্ষেরই? কর্ণধার নবকুমার দাস বলেন, “আমরা এলাকার মানুষজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলছি। বাজেট রাখা হয়েছে ২ লাখ। আমাদের প্রতিমা বাইরে তৈরি হচ্ছে। পঞ্চমীতে আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চতুর্থীতেই প্রতিমা হোমে চলে আসবে।” সেই অপেক্ষায় যেন আর সময় কাটছে না আবাসিকদের।

এই হোমের মধ্যেই রয়েছে ‘অবশেষে’ নামে এক বৃদ্ধাবাস। যার আবাসিক সংখ্যা ২৮। এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার জন পিছু ৭ হাজার টাকা করে দিয়ে থাকে। তবে এই টাকা নিয়মিত পাওয়া যায় না। হোমের হিসাব অনুযায়ী এখনও ৩২ মাস বকেয়া। কিন্তু তাদের কোনও অসুবিধা বুঝতে দেয় না হোম কর্তৃপক্ষ। ফলে ১১ জন পুরুষ ও ১৭ জন মহিলা পুজোর প্রাক্কালে একেবারে খুশিতেই রয়েছেন। পুজোর দিনগুলোতে কোন জামাকাপড় পরবেন, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত তারা। এছাড়া কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত পুরুষ, মহিলা ও তাদের ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি দুস্থ,অনাথ, সিঙ্গল পেরেন্টসদের ছেলেমেয়েরাও এখানে থাকেন। থাকেন ‘চাইল্ড নিড কেয়ার অ্যান্ড প্রটেকশন’ প্রকল্পের আওতায় থাকা বালক-বালিকা থেকে কিশোর-কিশোরী। অর্থাৎ যারা ট্রেন থেকে উদ্ধার হয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসেন। বাধ্য হয়ে শিশুশ্রমে যুক্ত হয়, বাল্য বিবাহের মতো এলাকায় ঘটনা ঘটলে এই হোমই তাঁদের ঠিকানা হয়। এমন বালক-বালিকা ও কিশোর, কিশোরীর সংখ্যা ২৮। তবে তারা ধারাবাহিকভাবে থাকেন না। ৬ মাসের মধ্যেই তাঁদের সমস্যার সমাধান হওয়ার পর ঘরে ফিরে যান।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement