Advertisement
Advertisement
Durga Puja 2025

দশমীতে বিসর্জন নয়, দেবী উমা উত্তরের চাষি পরিবারের কুটিরে বিশ্রাম নেবেন ভান্ডানি রূপে

তিস্তা ও তোর্সানদী পাড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এমনই বিশ্বাস।

Durga will be worshipped at farmer family as Bhandani after dashami
Published by: Kousik Sinha
  • Posted:October 2, 2025 3:52 pm
  • Updated:October 2, 2025 3:52 pm   

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: দশমীতে বিসর্জন! মোটেও না। উত্তরে দেবী উমা ওই বিশেষ তিথিতে মোটেও ফিরে যান না শ্বশুরালয়ে। আরও কয়েকটি দিন চাষি পরিবারের পর্ণ কুটিরে থেকে বিশ্রাম নেন দেবী ভান্ডানি রূপে। তিস্তা ও তোর্সানদী পাড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এমনই বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের টানে একাদশী তিথি থেকে দেবীকে ঘিরে রাজবংশী সমাজ এবারও মেতে উঠবে অন্য দেবী বন্দনায়। অন্য শারদ উৎসবে। চলছে তারও প্রস্তুতি। বর্ণময় অভিনব গ্রামীণ শারদ উৎসব উৎসগত দিক থেকে কৃষি বন্দনা এবং আত্মকেন্দ্রিকতার বাধন ছেড়ার অদম্য ইচ্ছা হলেও সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে আদল। জুড়েছে হৈমবতীর শ্বশুরালয়ে ফেরার পথে ক্লান্তি জুড়ানোর কাহিনি। তাই উত্তরের রাজবংশী সমাজে ভান্ডানি এখন দেবী উমার ভিন্ন রূপ হিসেবে বেশি পরিচিত। অনেকে তাঁকে বনদুর্গাও বলেন। সেই সূত্রে প্রচলিত হয়েছে রকমারি কাহিনি। যেমন, দশমীতে বিসর্জনের পর দেবী শ্বশুরালয়ের পথে রওনা হলেও ক্লান্তি জুড়াতে গায়ে চাষির পর্ণ কুটিরে ভান্ডানি রূপে আশ্রয় নেন। অন্য কাহিনি, ভান্ডানি আদতে দেবী উমার মালপত্র দেখভালে নিযুক্ত একজন। কোচবিহারের রাজবাড়ি থেকে পুজো নিয়ে ফেরার পথে তিনি অসুস্থ হন। তাই দেবীর সঙ্গে কৈলাসে না ফিরে চাষির পরিবারে কয়েকদিন বিশ্রাম নেন।

Advertisement

গবেষকরা অবশ্য গল্পগাথাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। লোকসংস্কৃতি গবেষক দিলীপ বর্মা মনে করেন, মঙ্গোলীয় বংশদ্ভূত রাজবংশী সমাজের লোকদেবতাকে ব্রাহ্মনায়িতকরণের মাধ্যমে ভান্ডানিকে কোথাও দুর্গা, আবার কোথাও বনদুর্গা কল্পনার সূত্রপাত। পাল্টেছে দেবীর গড়ন। বেড়েছে জৌলুস। তাই গবেষকদের একাংশের দাবি, ভান্ডানি মোটেও দুর্গা নন। তিনি শস্য ও প্রাচুর্যের প্রতীক। দুশো বছর আগে দেবীর মূর্তি ছিল না। পরে মূর্তি প্রচলনের সূচনায় দেবী ভান্ডানিকে দ্বিভূজা কল্পনা করা হয়। ব্যাঘ্র বাহিনী। রক্তিম বর্ণ। তিনি পশ্চিম মুখে বসেন। যদিও সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় দেবীর গড়নে পরিবর্তন এসেছে। কোথাও বাহন বাঘ হয়েছে সিংহ। কোথাও দ্বিভূজা দেবী হয়েছেন চতুর্ভুজা। সেই সঙ্গে ভাবনাও পাল্টেছে। শস্য রক্ষার দেবী হৈমবতীর অন্য রূপ হিসেবে কল্পিত হয়েছেন।

রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তথা লোকসংস্কৃতি গবেষক দীপক রায় বলেন, “ভান্ডানিকে দেবী দুর্গা কল্পনা করা হলেও তিনি আদতে শস্যের দেবী। ‘ভান্ডানি’ শব্দটির উৎস ‘ভান্ডার’ শব্দ থেকে। যেমন, শস্য ভান্ডার। তাই ওই দেবী যে শস্য ভান্ডার রক্ষার দেবী সেই বিষয়ে কোনও বিতর্ক থাকার কথা নয়।”

গবেষকদের ওই বক্তব্যের সঙ্গে এক মত তিস্তাপাড়ের বেশিরভাগ প্রবীণ চাষি। তাঁরা জানান, প্রযুক্তি কেমন করে শস্য উৎপাদনের চালচিত্র পাল্টে দিয়েছে সেটা গ্রামের প্রত্যেকে জানে। কিন্তু ফসলের মাঠের আদল পাল্টে গেলেও পিছন ফিরে তাকাতে বুক কাঁপে। কেন? ময়নাগুড়ির কালামাটি গ্রামের বাসিন্দা দীনেশ রায় বলেন, “রোজগার বেড়ে চলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেমন জীবন পাল্টেছে। তেমন যৌথ পরিবার ভেঙে এখন বিলুপ্তির পথে। ছেলেরা বিয়ে করে বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে দিনমজুরি খেটে পেটের ভাত জোটাতে হচ্ছে। উবে যাচ্ছে গাঁয়ের শান্তি। ওই শান্তি ফিরে পাওয়ার আশা নিয়ে দেবীর চরণে ফুল দেন তঁারা। শিলিগুড়ি মহকুমার টামবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা বিমল সরকার বলেন, “খেতের সবজি যেন ভাল হয়। প্রত্যেকে যেন মিলেমিশে শান্তিতে চলতে পারি এটাই প্রার্থনা করি। এর বেশি দেবীর কাছে কি চাওয়ার আছে।”

কোথাও একাদশী তিথি থেকে তিনদিনের মধ্যে। আবার কোথাও লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন এভাবে দেবীর কাছে শস্য রক্ষা ও সমাজের মঙ্গল কামনা করবেন রাজবংশী চাষি পরিবারের লোকজন। ময়নাগুড়ির গাবুরবাড়ি, খাসিমোচরা, মাধবডাঙা গ্রাম ছাড়াও কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর জেলা, শিলিগুড়ি মহকুমার বিভিন্ন প্রান্তে ওই পুজোর আয়োজন চলছে। দশমীর রাতে সেখানে রাজবংশী সমাজের পুরোহিত দেউসি দুধ, দৈ, চিনি, বাতাসায় নৈবেদ্য সাজিয়ে একাদশীর ভোরে পুজো শেষ করবেন। বেলা বাড়তে প্রতিটি মণ্ডপে চাষি পরিবারে ভিড় উপচে পড়বে।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ