Advertisement
Advertisement
Gram Banglar Durga Puja

উধাও ভেদাভেদ! ‘মনমোহিনী’ ঢাকের তালে মাতাচ্ছেন বাঁকুড়ার মোহন বাউড়ি

'সংবাদ প্রতিদিন'-এর কাছে নিজের সংগ্রামের কথা খুলে বললেন মোহন বাউড়ি।

Gram Banglar Durga Puja: Bankura Dhaki Mohan Bauri shares his story to take part in Durga Puja
Published by: Sucheta Sengupta
  • Posted:August 29, 2025 5:49 pm
  • Updated:August 30, 2025 2:34 pm   

বাউড়ি সম্প্রদায় বলে যেন অধিকার নেই ঢাকের বোলে সুর তোলার! তাই এক উঠোনে যখন কাঁধে ঢাক নিয়ে অনবরত মহড়া করতেন, তখন এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বাঁকুড়ার প্রতাপপুর গ্রামের মোহন বাউড়িকে। সেসব উপেক্ষা করে সুর-তাল-ছন্দ আর ভালোবাসার টানেই ঢাক বাজানোকে পেশা করে নিয়েছেন। পুজোর মরশুমে বাউড়ি-কালিন্দী মিলেমিশে এক এখন। নিজের জীবন সংগ্রামের কথা ‘সংবাদ প্রতিদিন‘-এর কাছে মন খুলে বললেন মোহন বাউড়ি। শুনলেন প্রতিনিধি দেবব্রত দাস

Advertisement

বাউড়ি ও কালিন্দীর এক উঠোনে সকাল-সন্ধ্যা চলছে রিহার্সাল, বাজছে ঢাক-ঢোল। এই শুনেই ছোট থেকে বড় হয়েছি। তাই ঢাক-ঢোল বাজলেই মন তালে তালে নেচে উঠত। মনে প্রশ্ন উঠল, এক উঠোন, এক পেশা কেন নয়। তাই পড়শি কমল কালিন্দীকে ‘গুরু’ বানিয়ে নিজের কাঁধেও ঢাক তুলে নিলাম। এরপর দুর্গাপুজো, বিয়ে থেকে মেলায় সারাবছর ধরে বাজাতে গিয়েছি। ঢাকের আওয়াজে যখন মানুষ ভিড় করে, চোখ বন্ধ করে তাল মিলিয়ে নাচে, তখন মনে হয় জীবনের সেরা প্রাপ্তি এটাই! অনেকে এখনও বলে, বাউড়ি হয়েও ঢাক বাজাও? আমি হেসে উত্তর দিই, সুর-তাল কোনও জাতের বাঁধনে আটকে থাকে না। এ আমার ভালোবাসা, এ-ই আমার সংসার, এ-ই আমার গর্ব। এবারও দুর্গাপুজোয় বরাত পেয়েছি পূর্ব বর্ধমানের উখড়া কোলিয়ারিতে। সেখানে ছেলে ও দলকে নিয়ে বাজাতে যাব।

আমি বাঁকুড়া দুই ব্লকের প্রতাপপুর গ্রামের বাসিন্দা ৫০ বছরের মোহন বাউরি। আমাদের প্রতাপপুর গ্রাম যেন ছবির মতো চারপাশে সবুজে ভরা মাঠ, মাটির বাড়ি, নিকানো দেওয়াল। এখানে বাউড়ি আর কালিন্দী আলাদা নয়, একেবারে মিলেমিশে থাকেন। তাই কালিন্দী নয়, বাউড়ি সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও আজ সারাজীবন ধরে ঢাক বাজিয়ে চলেছি। অনেকের কাছে এ বড় বিস্ময়ের, কারও কাছে আশ্চর্যের। কিন্তু আমার কাছে ঢাক, ঢোল, তবলা, খোল আর করতাল – এরা শুধু বাদ্যযন্ত্র নয়, আমার নিঃশ্বাস, আমার অস্তিত্ব।

যৌবন বয়সে ঢাক বাজিয়ে গ্রামে গ্রামে যেতাম। সেই সময়েই ওলা গ্রামের মঞ্জরি বাউড়ির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। প্রথমে উনি ভেবেছিলেন, বাদ্যযন্ত্র বাজানো ছেলেকে বিয়ে মানে সংসারে ঝামেলা আসবে। কিন্তু পরে ওই আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। আজও মঞ্জরি বলে, ”ঢাক-ঢোল তো আমাদের সংসারেরই অঙ্গ, ওঁর হাতের তালেই সংসার এগিয়ে যায়।” আমাদের সংসারের মতোই সুরও যেন বংশ পরম্পরায় বেঁধে গিয়েছে। আমার একমাত্র ছেলে বিশ্বজিৎও এখন ঢাক বাজায়। ছোট থেকেই আমার সঙ্গেই বাজনার সুরে ডুবে থেকেছে। ও গর্ব করে বলে, বাবা আমার গুরু। এখন দেশের নানা প্রান্তে আমিও যাই, ছেলেও যায়। ঢাকের শব্দে মানুষ যখন নেচে ওঠে, তখনই বোঝা যায় আমাদের জীবনের আসল সাফল্য।

আমার ‘গুরু’ কমল কালিন্দীর উঠোনে খোলা আকাশের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত তাল-লয়ের সাধনা। ভুল করলে ধমক খেতাম, আবার ঠিক বাজাতে পারলে প্রশংসা মিলত। সেই আঙিনা আজও চোখে ভাসে। কমলদার শিক্ষা আমার হাতের প্রতিটি তাল-লয়ে রয়ে গিয়েছে। আজও আমার ঘরে তবলা, খোল, করতাল, ঢোল আর ঢাক সাজানো থাকে। তবলায় শৃঙ্খলার ধ্বনি শুনি, খোলের সুরে মাটির টান পাই, করতালে শরীরের রক্তস্রোতে বাজে তাল, ঢোলে জাগে মেলার উচ্ছ্বাস। আর ঢাক? সে তো আমার আত্মা। দুর্গাপুজোর ভোরে ঢাক বাজালে মনে হয়, দেবী যেন আশীর্বাদ করছেন।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ