বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: ‘জয় মা কালী…।’ নদীর ওপার থেকে ভেসে আসে সেই ধ্বনি। একবার নয়, মাঝেমধ্যেই সেই ধ্বনি তোলেন নদীর ওপারে থাকা মানুষজন। দীপান্বিতা অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে সেভাবে কিছুই ঠাহর যায় না। দূরেই রয়েছে অদৃশ্য জঙ্গল। এর মধ্যেই আচমকা ‘হল্লা হো…হল্লা হো’ ধ্বনি! যা শুনে বুক কেঁপে ওঠে বারবার। কারণ, বুঝতে অসুবিধা হয়নি ডাকাত দল কালীপুজো সেরে গাঁয়ের পথে পা বাড়িয়েছে। সারি দিয়ে মশালের আলো। আর তা নজরে আসতে লাঠিয়ালদের সতর্ক করেন বাড়ির কর্তা।
জলপাইগুড়ির বাসুসুবা এলাকার বাসিন্দা অশীতিপর সুপেনচন্দ্র রায় ছেলেবেলায় দাদুর মুখে ওই গল্প শুনেছিলেন। দাদু নিত্যানন্দ রায় ছিলেন একজন লাঠিয়াল। সুপেনবাবু জানান, দেবী কালী তখন ডাকাত দলের আরাধ্য দেবী। গ্রামাঞ্চলে ওই দেবীর কালীঠাকুরানি নামে পুজো হয়েছে বাড়ির বাইরে থানে। অনেকে ঘরের ভিতরে বিষহরির সঙ্গে দেবীকে পুজো দিতেন। কিন্তু সেভাবে ছিল না কোনও মূর্তি। সুপেনবাবুর সঙ্গে একমত ভাওয়াইয়া রত্ন কামেশ্বর রায়। তিনি বলেন, “উত্তরে ঘরকালী নামে এক ধরনের কালীপুজোর প্রচলন ছিল। রান্না ঘরে এই পুজো আয়োজনে শুয়োর বলি দেওয়া হত।” কামেশ্বরবাবু মনে করেন, দেবী কালীঠাকুরানির মূর্তি পুজোর আয়োজক ছিলেন জোতদার সমাজ। পরে ধীরে ধীরে মহাশক্তির প্রতীক হিসেবে দেবী সাধারণের মধ্যে জায়গা করে নিতে শুরু করেন। যদিও রাজবংশী সমাজে মাটির ঢিবিকে কালী রূপে পুজোর রীতি কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দগোপাল ঘোষ জানান, সময়ের সঙ্গে দীপাবলি উৎসব কালীপুজোর সঙ্গে জুড়ে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বাইরে সংস্থা গড়ে পুজোর আয়োজন শুরু হয়।
যদিও উত্তরের বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে কালী আরাধনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেবী চৌধুরানীর নাম। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে তিনি অন্য রূপে হাজির থাকলেও হন্টারের ‘এ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থে তিনি নিছকই দস্যুরানি। ডাকাত দল তিস্তাপাড়ের বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে আত্মগোপন করে যে রংপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ডাকাতি করেছে সেকথা হন্টারের রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। তিনি ডাকাত সর্দার ভবানী পাঠক এবং তার শিষ্যা দেবী চৌধুরানীর নামও উল্লেখ করেন। এই ভবানী পাঠক ছিলেন বিহারের ভোজপুরের বাসিন্দা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে তিনি জলপথে বাংলায় ডাকাতি করতেন। গবেষকদের একাংশের মতে, বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭১ সাল থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী কমিশনারের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে নিযুক্ত ছিলেন। হান্টারের গ্রন্থটি তার দেখা অসম্ভব ছিল না। তিনি ভবানী পাঠক ও দেবীচৌধুরানী চরিত্রকে উপন্যাসের প্রয়োজনের ভিন্নভাবে পরিবেশন করেন। উপন্যাসের দেবী চৌধুরানী একদিনও ডাকাতি করেননি।
তবে ইতিহাস ও উপন্যাসের সুক্ষ্ম তফাতে মন নেই তিস্তাপাড়ের। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল সঙ্কুচিত হলেও সেখানে এখনও স্বমহিমায় সেদিনের অনেক গল্পগাথা। স্থানীয় প্রবীণরা জানান, নিশিরাতে অভিযানে বের হওয়ার আগে ডাকাত দল জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় কালী পুজো করত। তিস্তাপাড়ের বোদাগঞ্জ থেকে বাকালী জুড়ে ছড়িয়ে আছে সেদিনের প্রচুর কালীর থান এবং দেবী চৌধুরানী মিথ। লোকসংস্কৃতি গবেষক দিলীপ বর্মা বলেন, “তিস্তায় বজরা ভাসিয়ে ডাকাত দল যে ডাকাতি করেছে সেই তথ্য ইতিহাসে রয়েছে। ওরা যেখানে আত্মগোপন করেছে সেখানে পুজো করে থাকতে পারে। পরে মাহাত্ম্য বাড়াতে সেসবে দেবী চৌধুরানী মাহাত্ম্য জুড়েছে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.