অর্ণব দাস: তুলোর আকাশ আর সমারোহে দুর্গাপুজোর আহবান! কেনাকাটাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্বামী-শরতের পেঁজা কাশফুলের স্ত্রীর মধ্যে খুঁটিনাটি বিষয়ে অশান্তির বিরাম নেই। পাশের পুজো মণ্ডপে যখন প্রতিমা আগমনে উলু-শঙ্খ-কাঁসর-ঘণ্টার সুর, তখনও চলছে দম্পতির মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি। আর তাঁদের সন্তান আতঙ্কে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির। বাপের বাড়িতে মায়ের আগমনের রীতি সম্পন্ন হতে না হতেই দম্পতির সেই অশান্তি বিচ্ছেদের রূপ নেয়। পুজোর নতুন জামাকাপড় ফেলেই সন্তানকে টেনে নিয়ে সেই মা রওনা দেন বাপের বাড়ি। আর সন্তান মুখ বুজে সব মেনে নিলেও দোটানায়, আলো-আঁধারে। দেবীপক্ষের শুরুতেই রাজ্যজুড়ে পুরুষ নির্যাতনের করুণ চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
জানা গিয়েছে, চলতি বছরে গোটা রাজ্যে ছ’শোর বেশি পুরুষ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছেন। মেনস রাইট অ্যাকটিভিস্ট নন্দিনী ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, “জানুয়ারি থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের কাছে ৬৩৩ জন পুরুষ নিপীড়নের অভিযোগ জানিয়েছেন। আসলে এদেশের আইন কিছুটা হলেও বধূদের অনুকূলে, পুরুষের প্রতিকূলে। নারীর সুরক্ষায় আইন যত শক্তিশালী, পুরুষের ক্ষেত্রে তত নয়। যে পরিসংখ্যান বললাম, তা আমাদের নথিবদ্ধ। কিন্তু এর আড়ালে আরও কতশত এমন ঘটনা রোজ ঘটে চলেছে, তার হদিশ অনেকেই রাখে না। অবসাদের কারণে তরুণ-তরুণীদের নেশায় আসক্ত হওয়ার পিছনেও মা-বাবার অশান্তি বা বিচ্ছেদ একটি বড় কারণ।”
এদিকে, স্বামী মনের মতো না হওয়ায় অন্য পুরুষের প্রেমে পড়ে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ তুলে, অন্যত্র সংসার পাতা বা বাপের বাড়িতে পুনরায় স্থায়ীভাবে আশ্রয় নেওয়ার ভূরি ভূরি অভিযোগ নথিবদ্ধ করতে গিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজের পাহাড় জমে থানায়। তার কোনওটার কিনারা হয় দু’বছরে। আবার কোনওটা পাঁচ বছরেও হয় না। ততদিনে হয়তো পরিচিতরা সব ভুলতে বসেন। সে যা-ই হোক, দম্পতির এই অশান্তির জেরে সন্তানের অপমৃত্যুর কারণ জানা যায় আইনের হাত ধরে। থানায় লিপিবদ্ধ অভিযোগের সংখ্যা কম হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা বহুগুণ বলেই দাবি অনেকের। শুধু উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙা থানার কথাই ধরা যাক।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জানুয়ারি, ২০২৪ থেকে আগস্ট, ২০২৫-এর মধ্যে মা-বাবার মধ্যে চলমান অশান্তি বা বিচারাধীন বৈবাহিক সম্পর্কের অবনতির কারণে গোবরডাঙা থানা এলাকায় আত্মঘাতী হয়েছে ১জন নাবালক ও ৪ জন নাবালিকা। এমনটা ঘটেছে স্বামীদের ক্ষেত্রেও। স্ত্রীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক জানাজানির পরে চূড়ান্ত অশান্তি ও সামাজিক অপমানের লজ্জায় অনেক স্বামীও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সূত্রের খবর, বিগত ২০ মাসে বারাসত থানায় ২ জন ও গোবরডাঙা থানায় ১ জন স্বামীর আত্মঘাতী হওয়ার অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তবে, বারাসত পুলিশ জেলার অন্তর্গত বাকি থানা মধ্যমগ্রাম, দত্তপুকুর, দেগঙ্গা, হাবড়া, অশোকনগর, আমডাঙা ও শাসনে এই সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের না হলেও বহু বিবাহিত যুবকের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা সামনে এসেছে।
অভিজ্ঞদের মতে, পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্যই পুত্র হারলেও নাতি-নাতনির কথা চিন্তা করে অনেক অভিভাবকই পুত্রবধূর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায় না। কিন্তু, চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রায় সব ক’টির কারণ স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তি, দাম্পত্য কলহ ও অত্যধিক মানসিক চাপ। আদপে, গৃহবধূদের সুরক্ষার জন্য বধূনির্যাতন বিরোধী আইন থাকলেও স্বামীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনও আইন না থাকায় ভয়ে, সামাজিক লজ্জায় নিরুপায় হয়ে পড়েন পুরুষরা। কিছু ক্ষেত্রে অশান্তির সীমা ছাড়িয়ে গেলে অবশ্য স্ত্রীর বিরুদ্ধেও থানায় অত্যাচারের অভিযোগ দায়ের করতে বাধ্য হন জীবনসঙ্গীরা। তবে, আইনের খাতায় এর সংখ্যা নগণ্য। পুলিশ সূত্রে খবর, জানুয়ারি, ২০২৪ থেকে আগস্ট, ২০২৫-এর মধ্যে বারাসত পুলিশ জেলার অন্তর্গত থানাগুলির মধ্যে মাত্র বারাসত থানায় ৬ জন, গোবরডাঙা থানায় ৪ জন ও শাসন থানায় ২ জন স্বামী অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু, সচেতনতার অভাবে বাকি থানা এলাকার স্বামীরা আইনি পথে এগোতে পারেননি বলেই মত অনেকের। এনিয়ে
আইনজীবী তথা বারাসত জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলোক সমাজপতির বক্তব্য, “সমাজের চোখে স্বামী মানেই আসামি। স্ত্রীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বধূনির্যাতন, স্ত্রী-ধন আইনে মামলা করে। বারাসত আদালতের ক্ষেত্রে বলতে পারি এ ধরনের ১৮ শতাংশ মামলাই পরবর্তীতে আপস হয়, নয়তো খালাস হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রথমে স্বামী ও তার পরিবারকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।”
যদিও আশ্বস্ত করে বারাসত জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জোনাল) অতীশ বিশ্বাস জানিয়েছেন, “আইন সবার ক্ষেত্রে এক। পুরুষরা অত্যাচারিত হলেও অভিযোগ জানাতে পারেন। থানায় সশরীরে যেতে শঙ্কা বোধ করলে থানা বা পুলিশ সুপারের কাছে মেল মারফত অভিযোগ জানাতে পারে। পারিবারিক পরিস্থিতি নিয়ে নাবালক-নাবালিকাদের কোনও অভিযোগ থাকলে ফোনে, স্কুল বা অন্য কারও মারফত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, আমরা সরাসরি তাঁদের সঙ্গে কথা বলব। এক্ষত্রে সোশাল উইংসের মাধ্যমে বা নিগৃহীত হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.