Advertisement
Advertisement
Rath yatra 2025

রশিতে নয়, পুরুলিয়া শহরে ট্রাক্টরে একাই রথ টানেন ‘বাহুবলী’!

২০০০ সাল থেকে পিতলের রথটি ট্রাক্টরের মাধ্যমে টানেন ৬২ বছরের ভৈরব মাহাতো।

Rath yatra 2025: Not rope but this chariot has been moved by tractor in Purulia town as unique ritual

পুরুলিয়া শহরের চকবাজারে রথ টানে ট্রাক্টর। ছবি: প্রতিবেদক।

Published by: Sucheta Sengupta
  • Posted:June 27, 2025 10:42 pm
  • Updated:June 27, 2025 11:00 pm  

সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: রথে চড়ে ভাইবোনদের নিয়ে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি যাওয়া মানেই দু’পাশে লোকে লোকারণ্য। রশি ধরে ভিড় ঠেলে রথকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু পুরুলিয়া শহরের চকবাজারের রথকে টানে না রশি। এক ‘বাহুবলী’র টানে রথ এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় মাসির বাড়ির পথে। যে হাতে রশি টানার কথা, সেই হাত থাকে স্টিয়ারিংয়ে। উদ্বাহু হয়ে ভক্তদের আওয়াজ ওঠে ‘জয় জগন্নাথ’। শহর পুরুলিয়ার চকবাজারের রথ যে টানে ট্রাক্টর! টানেন ট্রাক্টরের চালক। তবে নিয়ম রক্ষায় রশি থাকে। সেই রশি স্পর্শ করে জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রার কৃপা নেন মানুষজন।

এ রথযাত্রায় তিনি-ই ‘বাহুবলী’। মাথায় লাল পাগড়ি। পরনে হলুদ পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, সঙ্গে কোলাপুরী চটি। দাড়ি-গোঁফওয়ালা মুখে তিনি বর্তমান রথের ‘বাহুবলী সারথি’। পুরুলিয়া শহরের রাঁচি রোডের বাসিন্দা তথা পূর্ত দপ্তরের (সিভিল) অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী ভৈরব মাহাতো। তিনি পূর্ত দপ্তরের রোলার ড্রাইভার ছিলেন। ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই ৫৫ হাজার টাকা বেতন-সহ অবসর নেন। কিন্তু রথকে ট্রাক্টরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন সেই ২০০০ সাল থেকে। সে বছর থেকেই এই রথ রশি ছেড়ে ট্রাক্টরে যুক্ত হল।

অভিনব রথ দেখতে রাস্তার দু’পাশে উপচে পড়া ভিড়। ছবি: প্রতিবেদক।

কিন্তু কেন এই রথ ট্রাক্টরে টানে? পুরুলিয়া পোস্ট অফিস মোড় থেকে প্রায় দেড় কিমি এই শহরের রথতলা তথা প্রভু জগন্নাথের মাসির বাড়ি। এই পথ যেতে অতীতের ওল্ড মানবাজার রোডে কম দুর্ঘটনা হয়নি। ৯৫-৯৬ সালে শেষ দুর্ঘটনা ঘটে। তারপরেই ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে ২০০০ সাল থেকে এই রথ টানতে শুরু করে ট্রাক্টর। বর্তমানে এই রথের দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রবীণ শচীদুলাল দত্ত বলেন, “এই পিতলের রথে জগন্নাথ মাসির বাড়ি যাওয়ার সময় বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেই কারণেই ২০০০ সাল থেকে রশির বদলে ট্রাক্টরে টানে। তারপর আর কোনও অসুবিধা হয়নি।”

৬২ বছরের ওই ‘বাহুবলী’ চালকের কথায়, “ওই স্টিয়ারিংয়ে হাত ধরা মানে ঠাকুরকে পাওয়া। জগন্নাথকে পেয়েছি আমি। আমার জীবন সার্থক। এই জীবনে এখনও পর্যন্ত আমি যা চেয়েছি, তা পেয়েছি। এত পরিচয়, এত নাম-ডাক সব মহাপ্রভুর জন্য। জগন্নাথের কাছে একটাই প্রার্থনা যতদিন বাঁচবো ততদিন যেন এই রথকে টেনে নিয়ে যেতে পারি।” সত্যিই তাই। সেই ২০০০ সাল থেকে আজ ২৫ বছরে রথকে টানার জন্য বিভিন্ন কোম্পানির ট্রাক্টর স্পন্সর করে। তাই ফি বছর নতুন ট্রাক্টরে রথ টানা হয়। ট্রাক্টর দেওয়ার জন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সবাই যোগাযোগ করেন ওই ‘বাহুবলী’ চালকের সঙ্গে। কোন ট্রাক্টরে রথের চাকা গড়াবে, তা ঠিক করেন ‘সারথি’ই। ‘বাহুবলী’ চালক ভৈরব বাবু বলছিলেন, “আজ শুক্রবার যে কোম্পানির ট্রাক্টরে রথ টানা হয়েছে। উল্টো রথে অন্য কোম্পানির নতুন রথ আসবে।”

যে পরিবার এখন এই রথের দেখভাল করে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই রথের বয়স ১১৪ বছর। কিন্তু প্রাচীন রথের সূচনা অনেকটা আগে। পঞ্চকোট রাজপরিবারে নাচগানের জন্য আসতেন মণিবাইজি। পঞ্চকোট রাজ পরিবারের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ সিং দেও-র আমলে সুদূর উত্তরপ্রদেশের লখনৌ থেকে ওই নর্তকী আসেন। রাজ আবহে নাচগানের মধ্য দিয়েই তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। পুরুলিয়া শহরে ১৮৯৮ সালে রাধাগোবিন্দ জিউ-র মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নাম হয় মনমোহিনী বৈষ্ণবী।

পিতলের তৈরি রথ বিশেষ আকর্ষণ। ছবি: প্রতিবেদক।

এরপরেই তাঁর হাত ধরে শুরু হয় পিতলের রথযাত্রা। বাঁকুড়ার কারিগর আশুতোষ কর্মকার ওই রথ তৈরি করেন। ইতিহাস বলছে, ১৯১২ সালে এই রথের রশিতে প্রথম টান পড়ে। তখন এই রথের দৈর্ঘ্যে-প্রস্থ ছিল ১২ ফুট, উচ্চতা ২২ ফুট। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ওই বৈষ্ণবী রথে শামিল থাকতেন। এই রথযাত্রা পরিচালনার জন্য রয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড। ওই বোর্ড ১৯২২ থেকে এই রথযাত্রার সব কাজ সামলাচ্ছে। প্রবীণ শচীদুলালবাবু ওই বংশেরই সদস্য। তাঁর কথায়, “এখন যেমন সন্ধ্যা পর্যন্ত আলোয় ঝলমলে এই রথ চলে। আগে এই রথ সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যেত। তবে ১৯৬৩ সালে হ্যাজাক বাতির আলোয় সাজিয়ে এই রথের যাত্রা শুরু হয়। তার আট বছর পর বৈদ্যুতিক আলোয় সাজে এই রথ।”

কিন্তু মহাপ্রভুর মাসির বাড়ির পথ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ১৯৬৯ সালে গিরিধারী কর্মকার নামে একজন কারিগর ওই রথের চারদিকে দুই ফুট কমিয়ে দেন। ফলত লম্বা-চওড়ায় ছোট হয়ে যায় ওই রথ। ঐতিহ্যের ধারায় আজও সেই রথের চাকা গড়ায়। কিন্তু রশিতে নয, ট্রাক্টরে।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement