Advertisement
Advertisement
Purulia

বাস্তুভিটেতে দোষ! ওঝার নিদান-ভূতের ভয়ে ২ মাস ঘরছাড়া শবর পরিবার

বলরামপুরের হাড়জোড়া গ্রামে ৯ জনের মৃত্যুর জের!

Sabar Family in Purulia left house for 2 month in superstitious belief

ভূতের ভয়ে ২ মাস ঘরছাড়া শবর পরিবার। পুরুলিয়ার বলরামপুরের হাড়জোড়া গ্রামে। ছবি: সুমিত বিশ্বাস

Published by: Paramita Paul
  • Posted:June 4, 2025 1:54 pm
  • Updated:June 4, 2025 3:09 pm   

সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: শুধু অনুন্নয়ন নয়, সচেতনতার অভাবে বাসা বেঁধেছে কুসংস্কারও। গত এক বছরে পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল বলরামপুরের সেই শবর গ্রাম হাড়জোড়ায় অপুষ্টিতে পরপর ৯ জনের মৃত্যুতে ভয় ধরেছে ভূতের। ফলে ওঝা এসে ধূপ-ধুনো দিয়ে পুজো করে। নিদান দেয়-ভূত আছে ঘরে! আর ওঝার সেই নিদানে স্বামীকে অকালে হারিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঘরছাড়া বাসন্তী শবর। প্রায় ২ মাস পার হয়ে গেলেও ভূতের আতঙ্কে গ্রামে পা রাখেননি ওই শবর মহিলা। তাঁর মেয়ে ও ছোট ছেলে ওই গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকে। বড় ভাই কাজ করে ঝাড়খণ্ডে রাঁচিতে। বাসন্তী দেবী থাকেন লাগোয়া বরাবাজার ব্লকের তুমড়াশোল গ্রাম পঞ্চায়েতের জারিয়া গ্রামে অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

Advertisement

শহর পুরুলিয়া থেকে ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরের দিকে যাওয়া ১৮ নম্বর জাতীয় সড়ক। সেই জাতীয় সড়কের উপরেই ছোট উরমা হাটতলা। সেখান থেকে বাঁদিক দিয়ে কয়েকটি জনবসতি পার হয়ে ওই হাড়জোড়া গ্রাম। ওই গ্রামের শেষপ্রান্তে থাকেন শবররা। সেই শবর টোলায় ২০২৪ সালের মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত মোট ৯ জনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ ওই ৯ জনের মৃত্যুই অপুষ্টিজনিত কারণে। তবে ইতিমধ্যেই পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন ওই গ্রামে পদক্ষেপ নিয়েছে।

ভূতের ভয়ে ২ মাস ঘরছাড়া শবর পরিবার। পুরুলিয়ার বলরামপুরের হাড়জোড়া গ্রামে। ছবি: সুমিত বিশ্বাস

 

ওই ৯ জনের মধ্যেই রয়েছেন বাসন্তী শবরের স্বামী শঙ্কর শবর। ৩৯ বছরের ওই যুবক গত বছর মারা যান। তারপর আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয়। গত ২ মাস আগে শরীর খারাপ হতে শুরু করে বাসন্তী শবরের। তার ১৪ বছরের মেয়ে উত্তরা শবর বলে, “বাবা যখন প্রথম অসুস্থ হয়েছিল। তখন মা এক ওঝাকে ডেকে নিয়ে এসেছিল। সেই ওঝা ১০ হাজার টাকা নিয়ে ঘরে পুজো করে মাটি খুঁড়ে কী সব জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, ভূত আছে। তারপর বাবা মারা গেল। পরপর গ্রামের আরও কয়েকজন মারা যান। গত দু’মাস ধরে মার ভীষণ শরীর খারাপ। তাই মা বান্দোয়ানের হলুদবনি ওঝার কাছে যায়। ওই ওঝা ৫ হাজার টাকা নিয়ে বলেছিল ঘরে দোষ আছে।” এরপরই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন বাসন্তীদেবী। রাতে ঘুম ভেঙে যেত ভূতের ভয়ে। যে আত্মীয়ের বাড়িতে এখন উত্তরা তার ছোট ভাইকে নিয়ে থাকে সেই কালা শবর বলেন,”হলুদবনির ওঝার কাছ থেকে ফিরে এসে ঘরের সামনে বাঁশ দিয়ে বজরংবলীর ঝান্ডা তোলা হয়। কিন্তু তাতেও ভূতের ভয় কাটেনি। বাসন্তীদেবী ছেলেমেয়েকে আমাদের কাছে রেখে উনি এক অন্য আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছেন। তিনি সেখান থেকে কিছুতেই আসছেন না। এই ছেলেমেয়েও নিজের বাস্তু ভিটেতে যেতে ভয় পাচ্ছে। “

ওই গ্রামে শবর জনজাতিকে নিয়ে কাজ করা উরমা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সিপিএম প্রধান সহদেব মাহাতো বলেন, “ঠিক কবে যে বাসন্তী ঘরে তালা লাগিয়ে চলে যায়। তা বুঝতেই পারিনি। ভূতের আতঙ্কে আর নিজের বাস্তুভিটেতে আসছেন না। আসলে ওঝাগুলোর জন্যই এমন অবস্থা। ছাগল বিক্রি করে অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে দু’দুবার ওঝাকে টাকা দিয়েছিল। এই বিষয়গুলো জানতে পারলে আমি বাধা দিতাম। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই এমন ঘটনা ঘটে গেল।”

 

ভূতের ভয়ে ২ মাস ঘরছাড়া শবর পরিবার। পুরুলিয়ার বলরামপুরের হাড়জোড়া গ্রামে। ছবি: সুমিত বিশ্বাস

 

হাড়জোড়া গ্রামে যে এমন কুসংস্কার আছে তা জানে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ। তবে এখানকার শবররা ঠিকমতো খাবার না পাওয়ায় অপুষ্টিতে ভোগে। স্বাস্থ্য পরিষেবা না পেয়ে একের পর এক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। বিষয়টিও পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা কমিটির অজানা ছিল না। সেই কারণেই মাস ছয়েক আগে ওই গ্রামে গিয়ে প্রান্তিক জনজাতির মানুষদেরকে ফলমূল দিয়ে এসেছিল ওই বিজ্ঞানমনস্ক সংগঠন। সংগঠনের জেলা সাধারণ সম্পাদক তথা চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন,”আমাদের হয়তো উচিত ছিল ধারাবাহিকভাবে ওই গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগে থাকা। সেটা আমরা পারিনি। শুনলাম, ভূতের ভয়ে একটি শবর পরিবার ২ মাস হল ঘরছাড়া রয়েছে। তবে ওঝার বিষয়টা আমাদের জানা ছিল না। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে আমরা খুব দ্রুত ওই গ্রামে আবার যাব।”

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ