সঞ্জিত ঘোষ, নদিয়া: বৃষ্টির ফাঁকেই আচমকা নীল রঙের আকাশ উঁকি দিয়ে মনে করাচ্ছে পুজো একেবারে দোরগোড়ায়। সর্বত্রই শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি তুঙ্গে। নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের শুকুলবাড়িতে চলছে দুর্গাপ্রতিমার মূর্তি তৈরির কাজ। শুকুলবাড়ির এই পুজো ঘিরে একাধিক কাহিনি রয়েছে। সময়ের সঙ্গে জৌলুস কিছুটা কমলেও পুজোর দিনে নিষ্ঠা, জাঁকজমকে কোনও খামতি থাকে না। ৩৮৪ বছর ধরে এই পুজো হয়ে আসছে। এবারও পুজো উপলক্ষে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।
পুজো ঘিরে গল্প কম নেই। বলা হয়, শুকুল পরিবারের পূর্বপুরুষ মহেন্দ্রনাথ শুকুল স্বপ্নে দেবীদর্শন পেয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরেই এই পুজোর শুরু। সেসময় মাজদিয়া থেকে পাবাখালির দূরত্ব ছিল তিন কিমি। এখনকার বাংলাদেশ সীমান্তও খুব একটা দূরে নয়। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে চূর্ণী নদী। এছাড়াও একপাশে মাথাভাঙা ও ইছামতী নদী। সেসময় বনজঙ্গলে ঘেরা ছিল গ্রামটি। কথিত আছে, সেসময় ওই জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় একটি সাপ ধরা পড়েছিল। সেটিকে একটি মাটির কলসে ধরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল প্রায় আধ কিলোমিটার দূরের এলাকায়। তখন শুকুল পরিবারের বসতবাড়িটিও তৈরি হচ্ছিল। গৃহপ্রবেশের শুভদিনে ওই পরিবারের তরফে দেবী মনসার বাহনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পরিবারের সকলকে হতবাক করে সেদিন একজোড়া সাপ সত্যিই হাজির হয়েছিল সেই নতুন বাড়িতে। বাড়ির জমিতেই ছিল একটি প্রকাণ্ড বেলগাছ। সেই সাপ দুটি সেই বেলগাছের কোটরে আশ্রয় নিয়েছিল। ওই ঘটনাকে শুভ বলেই আজও মনে করেন পরিবারের সদস্যরা।
পরবর্তী সময়ে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন ওই বাড়ির কর্তা মহেন্দ্রনাথ শুকুল। কথিত আছে, দেবী দুর্গা স্বপ্নে মহেন্দ্রকে তাঁর পুজোর আদেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশমতোই ওই শুকুল পরিবারে শুরু হয় দুর্গাপুজো। স্বপ্নে দেবীকে দেখা গিয়েছিল একচালার প্রেক্ষাপটে। স্বপ্নাদেশে দেখা সেই মূর্তির আদলেই দেবী দুর্গার কাঠামো তৈরি হয়। চালচিত্রও হুবহু একই রাখা হয়। আজও সেই একই আদলে দেবী দুর্গার মূর্তি ও চালচিত্র তৈরি হয়। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, স্বপ্নে পুজোর আদেশ পাওয়ার পর প্রথম ওই বেলগাছের গোড়াতেই পুজো শুরু হয়। পরে নাটমন্দির তৈরি হয়। ওই নাটমন্দিরেই এখন দুর্গাপুজো হয়। জানা যায়, তিমির শুকুলের বাবা শান্তি শুকুলও স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তবে দেবী মনসার। কথিত আছে, ওই বেলগাছের তলাতেই মন্দির তৈরির স্বপ্নাদেশ পান তিনি। তৈরি হয় মনসা মন্দির। তবে মন্দিরের মেঝে স্বপ্নাদেশ অনুসারে বাঁধানো হয়নি। রাখা হয়েছিল মাটিরই।
প্রতি বছর মহালয়ার দিনে নাটমন্দিরে দুর্গাপ্রতিমার অধিষ্ঠান হয়। যুগ যুগ ধরে এই রীতি চলে আসছে। বর্তমানে পরিবারের ছোটছেলে তিমির শুকুল এই পুজো পরিচালনা করেন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি বছর ওই বেলগাছের গোড়াতেই বোধনের পুজো হয়। চণ্ডীর ঘট ও বোধনের ঘট বসানো হয় ওই গাছের নিচে। সপ্তমী, অষ্টমী, সন্ধিপুজো, নবমী ও দশমীর পুজো শুরুর আগে এই বোধনতলায় পুজো দিতে হয়। এটাই এই পরিবারের রীতি।
সন্ধিপুজোর সময় এখনও বন্দুকের গুলি ছোড়ার রেওয়াজ আছে ওই পরিবারে। আগে সপ্তমী থেকে নবমী ছাগবলির প্রচলন ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক বছর হল সেই বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন কলা, আখ ও কুমড়ো বলি হয়। কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকে সব থেকে প্রাচীন পুজো এই শুকুলবাড়ির পুজো। দশমীর পুজো শেষ হলেই শুরু হয় বিসর্জনের প্রস্তুতি। উমা ফিরে যাবেন কৈলাসে। সেখানেও পুরনো ঐতিহ্য বহমান। চূর্ণী নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। সেই বিসর্জনেরও নির্দিষ্ট সময় আছে। দশমীর সন্ধ্যায় উত্তর আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখা যায়। সেটি দেখার পরেই দেবীকে বিদায় জানানো শুরু হয়। প্রথমে উমাকে সাত পাক রীতি মেনে ঘোরানো হয়। এরপর দুটি নৌকাতে তোলা হয় প্রতিমা। মাঝনদীতে নৌকা দুটি যায়। সেখানেই দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়। জল ভরা হয় মঙ্গলঘটে। শুরু হয় আরও একবছরের প্রতীক্ষা।
পুজোর দিন এলাকার বাসিন্দাদের অবাধ যাতায়াত থাকে শুকুলবাড়িতে। খাওয়াদাওয়াও চলে। পুজোর ভোগ রান্নার দায়িত্ব শুকুল পরিবারের সদস্য ও ভরদ্বাজ গোত্রভুক্ত রমণী ছাড়া কেউ পান না। ভোগের প্রসাদ পান সাধারণ মানুষও। পুজো উপলক্ষে এলাকাতে মেলাও বসে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.