Advertisement
Advertisement
Purulia

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কমছে পড়ুয়া, ‘অর্ধ সত্য’ বলে ভাইরাল মালতি! ভুল স্বীকার স্বামীর

সমাজমাধ্যমে মালতি এখন ট্রেন্ডিং।

Viral Malati tells 'half truth' in Purulia

চলছে প্রার্থনা। সন্তান কোলে মালতি মুর্মু। সোমবার। ছবি: অমিতলাল সিং দেও।

Published by: Suhrid Das
  • Posted:July 14, 2025 11:20 pm
  • Updated:July 14, 2025 11:26 pm  

সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: খসে পড়েছে চাঙড়। ভেঙে পড়া সেই অংশ থেকে বৃষ্টির জল চুইয়ে পড়ছে ডেস্কে। শিক্ষকের টেবিলও একেবারেই ভেজা। মেঝেতেও জল জমা। আলো, পাখা থাকলেও বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন থাকায় অন্ধকার থাকে ক্লাস রুম। ঘোরে না পাখা। মিড ডে মিলের চাল একেবারে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আর সেই চাল পড়ছে মিড ডে মিলের হাঁড়িতে। স্কুলের ভাঙা সীমানা প্রাচীর থাকলেও সদর দরজা নেই। স্কুলের চৌহদ্দিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাপ। শৌচাগার থাকলেও নেই জলের ব্যবস্থা। স্কুলে সৌরচালিত পানীয় জলের প্রকল্প থাকলেও সেই পয়েন্ট বুজে গিয়েছে। এভাবেই পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি ব্লকের জিলিংসেরেঙ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল চলছে।

Advertisement

আর তাই এই বিদ্যালয়ের স্কুলছুটরা পাঠ নিচ্ছে ওই বিদ্যালয় থেকে এক কিমি দূরে মালতিবালা বিদ্যালয়ে! মালতি মুর্মুর অবৈতনিক স্কুলে। আর তাই ফি দিন পড়ুয়া কমছে ওই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সপ্তাহের প্রথম দিন সোমবারই ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা গেল বেলা এগারোটা পাঁচে স্কুলের তালা খুললেন শিক্ষকরা। আর সেই স্কুলে ছাত্রছাত্রী হাজিরা মাত্র ১১ জন। তার মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির যে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস হয়, সেখানে মাত্র দু’জন। ওই তৃতীয় শ্রেণির দুই ছাত্রকে পড়ালেন স্কুলের হেডমাস্টার। আর দুই পার্শ্বশিক্ষকের মধ্যে একজন অনুপস্থিত। এদিকে কোনও স্তরে সাহায্য না পাওয়ার বয়ান বদলে দিয়েছেন মালতি ও তার স্বামী বাঙ্কা মুর্মু। ভুল স্বীকার করেন মালতির স্বামী। সেই সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার তরফে পাঠ দেওয়ার জন্য মাসে মাসে আড়াই হাজার করে সাম্মানিকের সাহায্য মালতি জানতেনই না। এই ‘অর্ধ সত্য’ বলেই যে ভাইরাল মালতি। তাই ট্রোলে বিদ্ধ তিনি।

Viral Malati tells 'half truth' in Purulia
ক্লাস চলছে স্কুলে। নিজস্ব চিত্র

সমাজমাধ্যমে মালতি এখন ট্রেন্ডিং। ট্রেন্ডিং তার বিনা পয়সার স্কুল। কিন্তু এক কিলোমিটার দূরে জিলিংসেরেঙ গ্রামের মধ্যবর্তী স্থলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এমন চেহারা? ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনাদিকুমার টুডু বলেন, “ওই বেসরকারি স্কুলে ব্যাগ দেওয়া হচ্ছে। ড্রেস দেওয়া হচ্ছে। তাই এখানে আর আসছে না পড়ুয়ারা। তবে বর্ষার মরশুমে এখন উপস্থিতি কম। অন্যান্য দিন ২৫ থেকে ৩০ জন পড়ুয়া আসে। স্কুলের সমস্যার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কিন্তু এই পাহাড়ি গ্রামে যা প্রতিবন্ধকতা তাতে সময় মতো কিছু করা যায় না।” সরকারি এই বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪৩। অন্য দিকে মালতির স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৪৫। সরকারি বিদ্যালয়ে গড় হাজিরা ২৫ থেকে বড়জোর ৩০। অন্যদিকে, মালতির স্কুলে ৩৫ থেকে ৪০। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮-৯ জন পড়ুয়া স্কুলছুট হয়ে এখন মালতির বিদ্যালয়ে পাঠ নিচ্ছে। তা স্বীকার করেছেন ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁর কথায়, “আমি শুনেছি এখান থেকে বেশ কিছু স্কুলছুট হওয়া ছাত্র ওই স্কুলে লেখাপড়া করছে।”

এদিন মালতির স্বামী বাঙ্কা মুর্মু বলেন, “কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করা আমার ভুল হয়েছে। আমি চাই আমার গ্রামবাসী-সহ সকলের সাহায্য নিয়ে এই স্কুলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমার সঙ্গে কারও কোনও শত্রুতা নেই। আমি ও আমার স্ত্রী একটা ভালো কাজ করতে চেয়েছি। সকলের শুভেচ্ছায় যেন সেটা করতে পারি। স্কুল চালানোর জন্য পুলিশের কাছ থেকেও সাহায্য পাই।” বাঙ্কা আরও বলেন, “স্কুলের জন্য যা সাহায্য করা হত তা যথেষ্ট ছিল না। তবুও আমরা চালিয়ে নিতাম।” অন্যদিকে তার স্ত্রী মালতি মুর্মু বলেন, “আমি জানতাম না যে মাসে মাসে কোনও সাম্মানিক দেওয়া হয়। লকডাউনের বেশ কিছুটা পরে আমার শরীর খারাপ হয়েছিল। আমার মাথায় সমস্যা ছিল তাই হয়তো আমার স্বামী স্কুল সংক্রান্ত কোনো কিছু বিষয় আমাকে বলেনি। আমি চলতি বছর থেকে আবার পড়াতে শুরু করেছি। আমি যাতে স্কুলকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি এটাই আমি চাই।”

এদিকে যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এই মালতির স্কুলকে সবরকমভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে, তাদের অন্যতম কর্মকর্তা শোভন মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ওই স্কুলের মাটির দেওয়ালের জন্য ১২ হাজারের বেশি টাকা দিয়েছি। ড্রেস দেওয়া হয়েছে। মিড ডে মিলের জন্য প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হত। এছাড়া আরও অন্যান্য খরচ আমরা দিতাম। মাসে মাসে বাঙ্কাকে আড়াই হাজার করে সাম্মানিক দেওয়া হত শিক্ষকতার কাজের জন্য। যিনি মিড ডে মিল রান্না করতেন সেই রাঁধুনিকেও সাম্মানিক দিতাম।” তিনি আরও বলেন, “তার ৬০০ টাকার সাম্মানিক আমরা বাড়িয়ে ৭০০ করতাম। ২৫০০ টাকাটা বাড়িয়ে হয় ৩ হাজার বা সাড়ে ৩ হাজার করারও চিন্তাভাবনা করছিলাম। পানীয় জলের সমস্যা থাকার কারণেই মিড ডে মিল রান্না করা যাচ্ছিল না। তাই ওই কাজে আমরা সেসময় থেকে কোনও অর্থ দিইনি। আমরা কোনওদিন ওই স্কুলে মালতিকে পড়াতে দেখিনি। আমরা জানতামই না যে বাঙ্কার স্ত্রী মালতি। আমরা যে সাহায্য করেছি তার কৃতজ্ঞতাটুকু স্বীকার করা উচিত ছিল। আমাদের নাম না নেওয়া হোক। সাহায্য যে তারা পান সেটা অন্তত বলা উচিত। মিথ্যা বলে শিক্ষা হয় না। তবে মালতিদির পাঠদানকে আমরা কুর্নিশ জানাই।”

২০২০ সাল থেকেই এই স্কুল শুরু হয়। সেই সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সংস্থা আর পরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তারপর একাধিক সংস্থা তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারপরেই ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মালতির স্কুলের পাশে দাঁড়ায় শোভনবাবুদের সংস্থা। তবে ‘অর্ধ সত্য’ বলে ভাইরাল হওয়া মালতি ও তার স্বামীকে ঘিরে নানান বিতর্ক তৈরি হলেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এখনও নানান জিনিসপত্র বিতরণ করছে। শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে পড়ুয়াদের। সোমবার সেই ছবি দেখা গেল।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement