মূর্তি তৈরিতে ব্যস্ত শিল্পী। নিজস্ব চিত্র
সুমন করাতি, হুগলি: এক হাতেই মাটি মাখা, কখনও কাঠামোয় খড় গোঁজা। খড়ের উপরেই মাটির প্রলেপ দেওয়ার কাজ ওই এক হাতেই। অদম্য মনের জের। বাম হাত সম্পূর্ণভাবে অকেজো। ডান হাত দিয়েই একাগ্রে গড়ে তুলছেন প্রতিমা। তিনি ধনঞ্জয় মিশ্র। অন্যবারের মতো এবারও নাওয়া-খাওয়া ভুলে দেবী দুর্গার মূর্তি বানাতে ব্যস্ত হুগলির পোলবার বীরেন্দ্রনগর গ্রামের বাসিন্দা মৃৎশিল্পী। হাতে যে আর বেশি সময় নেই! তার উপরে আবহাওয়া এখনও প্রতিকূল। মেঘ-বৃষ্টির আনাগোনার ভিতরই নিপুণ দক্ষতায় এঁকে চলেছেন দেবীর চোখ, তৈরি হচ্ছে লক্ষ্মী-সরস্বতীর মূর্তি।
অথচ চিরদিনই এই পরিস্থিতি ছিল না। আর পাঁচজন মানুষের মতোই ছিল জীবন। দুই হাতে দেবীপ্রতিমা তৈরি করতেন ধনঞ্জয়। নিজের স্টুডিও আরও বড় করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সংসারের দায়িত্ব পুরোটাই ছিল তাঁর উপরে। কিন্তু ২০১৫ সালে জীবনে নেমে এসেছিল ভয়াবহ অঘটন। বাইক চালিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেসময় লরিতে ঠেকে যায় বাইকের হ্যান্ডেল। রাস্তায় ছিটকে পড়েন। শরীরের উপর দিয়েই চলে যায় চারচাকা গাড়ি। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলেন। টানা ২০ দিন কোমায় ছিলেন। মৃত্যুকে কার্যত হারিয়ে একসময় জ্ঞান ফেরে। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন শিল্পী। একসময় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করেন তিনি। তবে বাম হাত কোনওভাবেই আর কাজ করে না। ডান হাতেই সমস্ত কাজ করতে শুরু করেন। ফলে লড়াইটা যে ছিল অত্যন্ত কঠিন, তা বলাই বাহুল্য।
কীভাবে হবে মায়ের মূর্তি তৈরি? এক হাতে কি এই গুরুদায়িত্ব সামলানো সম্ভব? অদম্য মনের জোরে কাজ শুরু করেন ধনঞ্জয়। প্রথমে কিছুই হচ্ছিল না। মৃন্ময়ী রূপ দেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠছিল। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। ধীরে ধীরে মূর্তির আদল আসতে শুরু করে। একহাতের অধ্যবসায়ে প্রতিমা সঠিক রূপ পেতে থাকে। এবছর তিনি দুটি দুর্গাপ্রতিমা তৈরির বায়না পেয়েছেন।
বয়স যখন মাত্র পাঁচ তখন থেকেই মাটির কাজে হাতেখড়ি ধনঞ্জয়ের। পাড়ায় মৃৎশিল্পীদের মূর্তি তৈরি করা দেখতেন। এরপর নিজেই প্রতিমা নির্মাণ শুরু করেন। মাটির প্রতিমা ছাড়াও সিমেন্ট ও ফাইবারের মূর্তিও তৈরি করেন ধনঞ্জয়। ২০০৩ সালে আর্ট কলেজে থেকে উত্তীর্ণ হন। প্রতিমা তৈরির পাশাপাশি এখন তিনি ছবি আঁকাও শেখান। বর্তমানে তাঁর কাছে প্রায় ৬০ জন ছাত্রছাত্রী আঁকা শেখেন। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট সংসার এতেই চলে যায়।
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে ধনঞ্জয় বললেন, “আমার এক হাতে কাজ করতে খুব সমস্যা হয়। তবে আমার স্ত্রী আমাকে কিছুটা সাহায্য করে। দুর্ঘটনায় বাম হাত নষ্ট হয়ে যায়। ডান হাত দিয়ে সব কাজ করতে হয় আমাকে। শুধু মনের জোর এই প্রতিমা তৈরি করি। আমি যে কোনও মূর্তি তৈরি করতে পারি। যে কোনও মানুষকে দেখে তাকে তৈরি করতে পারি।” তিনি আরও বলেন, “ছোট থেকে কখনও হারিনি। তাই আমি জীবনে হারতেও চাই না। শুধু মনের জোর নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.