গোবিন্দ রায়, বসিরহাট: ‘বর্ষার দিনে এই ইছামতীর কূলে কূলে ভরা ঢলঢল রূপে সেই অজানা মহাসমুদ্রের তীরহীন অসীমতার স্বপ্ন দেখতে পায় কেউ কেউ…’ বিভূতিভূষণের অবিস্মরণীয় উপন্যাস ‘ইছামতী’ কে না পড়েছে! কিন্তু এই আখ্যান নিছক মনগড়া নয়। এই নদী ও তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা পানিতর গ্রামের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। গ্রামের জমিদার পরিবারের মেয়ে গৌরীর সঙ্গেই পরিণয়ে আবদ্ধ হন লেখক। বহুকাল ধরেই ওই বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। সেই পুজো পরিচিত ছিল ‘ধুনির ঘরের পুজো’ নামে। কালের নিয়মে সেই জমিদারি আর নেই। তবে ওই দুর্গাপুজো ঘিরে মানুষের আবেগ ক্রমেই বেড়েছে। ধুনির ঘরের সেই পুজোই এখন হয়ে উঠেছে গ্রামবাসীদের পুজো। শোনা যায়, স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিভূতিভূষণও ওই পুজোয় উপস্থিত থাকতেন। সময়ের স্রোতে ভেসে আজ গ্রামবাসীদের উদ্যোগেই ওই পুজো আয়োজিত হয়।
বাংলার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এই গ্রাম ও এই পুজোর ইতিহাস সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এবারও স্থায়ী পুজো মণ্ডপেই চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। সেই কাজের তদারকি করতে মাঝেমধ্যেই হাজির হচ্ছেন এলাকার লোকজন। আর ক’দিন পরেই ঢাক বাজতে শুরু করবে। পুজোর আনন্দে মাতোয়ারা হবেন গ্রামের মানুষজন।উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের পানিতর গ্রাম। দুর্গাপুজো নিয়ে এই গ্রামের মানুষদের মধ্যে উৎসাহ, উদ্দীপনা বরাবরের৷ গ্রামে কেবল হিন্দুরা বাস করেন তেমন নয়, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজনও থাকেন। তবে, এই গ্রামে কোনও বিভেদ নেই। এই পুজোতে দুই সম্প্রদায়ের মানু্ষজনই শামিল হন। পুজোর দিনে রামের পাশে হাসিমুখে দেখা যায় রহিমকেও।
বসিরহাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির মৎস্য ও প্রাণী দপ্তরের কর্মাধ্যক্ষ শরিফুল মণ্ডল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে বললেন, “এই গ্রামে ধুনির ঘরের পুজোয় হিন্দু-মুসলিম সবাই শামিল হয়। সীমান্তের এই গ্রাম সম্প্রীতির বার্তা দেয়।” গ্রামের মানুষরাই এই পুজোর এখন আয়োজন করেন। জানা যায়, প্রতি বছর অষ্টমী ও নবমীতে গ্রামের কোনও বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। এই দু’দিন পুজো উপলক্ষে গ্রামে চলে মহাভোজ। স্থানীয়রা এই অনুষ্ঠানকে ‘ভজরাম’ বলে। পুজো উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এখানে কোনও ধর্মীয় ভেদাভেদ নেই। এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সকলেই অংশগ্রহণ করে। পুজো দেখতে ইছামতী পেরিয়ে আগে ওপার বাংলা থেকেও মানুষজন আসতেন বলে খবর।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল পানিতরে। বিভূতিভূষণের ঠাকুরদা তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কবিরাজ। তারিণীচরণের ছেলে মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স তখন বারো। সেসময় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার বসিরহাট ছেড়ে বনগাঁর কাছে চাঁদপাড়ায় চলে যান। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন এই গ্রামের মেয়ে গৌরী দেবীর সঙ্গে।
পৈতৃক ভিটে দেখভালের জন্য প্রায়ই পানিতরে আসতে হত মহানন্দকে। ছোট থেকেই বাবার হাত ধরে পানিতরে যাতায়াত ছিল বিভূতিভূষণেরও। ওই দিনগুলিতে বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের গৌরীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। পরে বিবাহ। তবে শোনা যায়, বিয়ের একবছর পরেই কলেরায় মারা যান গৌরী দেবী। স্ত্রীর শোকে কাতর হয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। কিছু কাল এই গ্রামে তিনি থেকেওছিলেন। পানিতরে থাকতেই তিনি রচনা করেন ‘পথের পাঁচালী’, ‘ইচ্ছামতী’-র মতো বহু উপন্যাস। আজও এই গ্রাম, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী এবং গ্রামের ‘ধুনির ঘরের পুজো’র ভিতরে যেন সেই ইতিহাসেরই প্রাণস্পন্দন শোনা যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.