ঢাক বাজাতে ব্যস্ত বৃদ্ধ জগন্নাথ। নিজস্ব চিত্র
সুমন করাতি, হুগলি: টিনের তৈরি ঘরের বাইরে চলছে ঢাক বাঁধা। আর দিন কয়েক পরেই দুর্গাপুজো শুরু। ঢাকের বোল তোলার জন্য চলছে প্রস্তুতিও। বয়সের ভারে বৃদ্ধ জগন্নাথের শরীর কিছুটা ঝুঁকে গিয়েছে। কিন্তু ঢাকের কাঠি হাতে নিতেই চনমনে হয়ে ওঠেন বছর সত্তরের ওই বৃদ্ধ। মধ্য বয়সে ভয়াবহ এক ঝড় বয়ে গিয়েছে তাঁর উপর দিয়ে। দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন একটি পা। কোনও সাহায্য ছাড়া এখন একা চলাচলও করতে পারেন না। কিন্তু সেই মানুষটিই চেয়ারে বসে ঢাকের বোল তুললে বিভোর হন সকলে। অজান্তেই কোমর দুলে ওঠে মণ্ডপে উপস্থিত আমজনতার।
হুগলির কোন্নগরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জগন্নাথ ঘোষ। আগে ছিলেন ডিমের কারবারি। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য অনেক স্বপ্নও ছিল যুবক বয়সে। সেজন্য কঠিন পরিশ্রমও করতেন নিত্যদিন। কিন্তু ১৯৮৯ সালের ২৯ জানুয়ারি তাঁর জীবনে অকস্মাৎ নেমে আসে আঁধার। রেললাইন পেরনোর সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি। ট্রেনের চাকা চলে যায় তাঁর পায়ের উপর দিয়ে। একটি পা ও অন্য পায়ের একটি আঙুল কাটা পড়ে ওই দুর্ঘটনায়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু নিজের পায়ে চলাচল বন্ধ হওয়ায় একমাত্র রোজগেরে বাড়ি যেন তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আর্থিক অনিশ্চয়তার ধাক্কার সামনে ডিমের ব্যবসা ছাড়তে হয় তাঁকে। স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সংসার কীভাবে চলবে, সেই দুশ্চিন্তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল হৃদয়। কিন্তু হাল ছাড়েননি জগন্নাথ।
অনেক আগে থেকেই তিনি ঢাক বাজাতেন। ঢাকের প্রতি অমোঘ টান। যেন তাঁর রক্তে ঢাকের বোল। অস্থির সময়ে সেই ঢাকের কাঠিই হাতে তুলে নেন। দাঁড়িয়ে বাজানোর পরিস্থিতি না থাকায় চেয়ারে বসেই শুরু হয় ঢাক বাজানো। দিনের পর দিন প্রস্তুতির পাশাপাশি নিজের মনকেও দৃঢ় করেন জগন্নাথ। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ঢাক বাজানোকেই পেশা করেন তিনি। এক সময়ের ডিমের ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন জগন্নাথ ঢাকি।
এরই মধ্যে সরকারি তরফে কাগজ সংগ্রহ করেন তিনি। শারীরিক পরীক্ষায় দেখা যায় জগন্নাথ ঘোষ ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সরকারের তরফে প্রতিবন্ধী ভাতাও পেতে শুরু করেন তিনি। এদিকে সংসার টানতে একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ নেন স্ত্রী। একমাত্র সন্তান বড় হয়ে দৈনিক মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। আর জগন্নাথ ঢাক বাজানোর দৌলতে পরিচিত হন ঢাকশিল্পী হিসেবে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজোয় ঢাক বাজানোর জন্য ডাক পেতে শুরু করেন বিভিন্ন জায়গার ক্লাবগুলির থেকে। গত তিন দশক ধরে ঢাক বাজানোর দৌলতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে কোন্নগর-সহ আশপাশের এলাকাতেও। ঢাক বাজিয়েই এখন তিনি উপার্জন করেন। এবারও দুর্গাপুজোর ঢাক বাজানোর জন্য আগাম বায়না তিনি পেয়ে গিয়েছেন। এখন পুজোর দিনে মণ্ডপে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বৃদ্ধ জগন্নাথ।
জগন্নাথ বলেন, “পা চলে যাওয়ার পর থেকে একমাত্র উপার্জনের সঙ্গী ঢাক। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজোতে ঢাক বাজাই। একাধিক পুরস্কারও ঢাক বাজানোর জন্য পেয়েছি। কেবল পুরস্কার বাবদ অর্থ অনুদান বাড়ি নিয়ে আসি। অন্যান্য পুরস্কার ওইসব ক্লাবেই রেখে আসি।” ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাবলু ঘোষ বলেন, “জগন্নাথ ঘোষ এলাকায় পরিচিত মুখ। বর্তমানে তাঁর যাতায়াতের জন্য একটি তিন চাকার সাইকেল প্রয়োজন। সেটি বৃদ্ধকে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চলছে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.