রমেন দাস: বছর দুই কেটে গিয়েছে। আর জি কর আবহে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাইচাপা আগুনেও উঠে আসে বিচারের কথা। শোকস্তব্ধ অপেক্ষার পাহাড়ে কড়া নাড়ে একটাই প্রশ্ন, এবার বিচার হবে তো? এই আবহেই খানিকটা যেন বিমর্ষ এক বাড়িকে সঙ্গ করেই আজও পুজোয় মাতে নদিয়ার বগুলা। দুর্গাপুজোর (Durga Puja) প্যান্ডেলের ঠিক কাছেই দাঁড়িয়ে একটি বাড়ি। যে বাড়ির ধূসর রং, প্রত্যেকটি দেওয়ালে আজও যন্ত্রণার দগদগে ছাপ। ২০২৩ সালের ৯ আগস্টের পর একাই দাঁড়িয়ে বাড়িটা।
নদিয়ার বগুলা স্টেশনে নেমে পশ্চিম দিকে মুখ করে একটু এগোলেই রাস্তার ধারে পাঁচিল ঘেরা একতলা বাড়ি। উঠোনে জন্মেছে আগাছা। বিপর্যস্ত বাদামি রংয়ের লোহার গেট খুলে একটু এগোলেই আর একটি দরজা। সেটাও লোহার। কিন্তু তারপর? যে বাড়িতে এককালে পুজো আসলেই শোরগোল পড়ত, পাড়ার পুজোয় আনন্দে মেতে উঠত যে পরিবার, যে বাড়ির ছেলে পুষ্পাঞ্জলি দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠত, সেই বাড়িটাই আজ একাকী! দেওয়ালে দেওয়ালে রং চটে যাওয়ার মতোই ক্ষতবিক্ষত স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে সেও।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মাত্র দু’দিন কেটেছিল। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়েরই মেন হস্টেলে মৃত্যু হয় ওই পড়ুয়ার। তোলপাড় হয় রাজ্য, ওঠে খুনের অভিযোগ। ‘র্যাগিং’ নামক বিষের প্রকোপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় রাজ্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাদবপুর পেরিয়ে আর জি কর, একাধিক ঘটনার আধিক্যে খানিকটা চাপা পড়েছে নদিয়া। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নিয়েও আশায় দিন গুনছেন ওঁরা। বিধ্বস্ত বগুলা ছাড়িয়ে আজ ওই পরিবারের বাস রানাঘাটে। ঠিক যেখানে প্রত্যেক পুজোয় আসত ছোট্ট ছেলেটি। মৃত ছেলের ছবি দেখলে আরও কাঁদেন ওঁর মা। দুর্গার মুখ দেখেন না আর! সন্তান হারিয়ে নিরন্তর চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘বিচার চাই।’ পুজো আসলেই স্বপ্নের বিচরণে ঝড় তোলে স্মৃতি। মৃত যাদবপুরের পড়ুয়ার বাবা বলছেন, ‘‘পুজোয় আমার ছেলে খুব আনন্দ করত। কত কিছু খাবারের পদ রাঁধতে শিখেছিল – বিরিয়ানি, পিৎজা! আমাকে বলত, বাবা শপিং মলে যাব, এটা লাগবে, ওটা লাগবে। এনে দিতাম। পুজো হয় আমার বগুলার বাড়ির কাছেই। বলতে পারেন, ওই পুজো আমাদের হাতে শুরু। ওখানেও যেত, আবার প্রত্যেক পুজোতেই আমার সন্তানরা ওদের মামার বাড়িতে যেত। পুরো পরিবারের সঙ্গে কাটাতাম।’’
কান্না আজও বিরামহীন! দলা পাকিয়ে থাকা দুঃখ নিয়েই আজও চোখ মোছেন ওঁরা। বাবার কথায়, ‘‘ওর চলে যাওয়ার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের পুজো আমার কাছে অন্যতম ছিল। সেবার দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন আমরা সকলে গেলাম বেলুড় মঠে। পুষ্পাঞ্জলি দিলাম। অনেক সময় কাটল। মহারাজদের প্রণাম করল আমার ছেলে। ও একটা বই পড়েছিল স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতা নিয়ে। পড়তে ভীষণ ভালোবাসত।’’ খানিকটা থেমে আবার বলতে শুরু করলেন নদিয়ার বাসিন্দা, ‘‘জানেন তো, সেদিনের পর আর কোনও উৎসবে অংশ নিতে পারি না। বুক ফেটে যায়। কান্না পায়। হাহাকার নিত্যসঙ্গী। ওর মা যে কীভাবে আছে বলে বোঝাতে পারব না। শুধু ছেলের কথা মনে পড়ে। পুজোয় নতুন জামা। খাবার। ঘুরতে যাওয়া। ওদের হাত ধরে ঠাকুর দেখানো। সব মনে পড়ে।”
বাড়ির দেওয়ালে এখনও রয়েছে ছবি। মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু যেন ওলটপালট করে দিয়েছে সব। কিন্তু বছর দুয়েক পরেও বিচার নিয়ে কী বলবেন? মা দুর্গার কাছে কোনও প্রার্থনা? ফের কান্নাভেজা চোখে অসহায় বাবার আর্তি, ‘‘আমরা সঠিক বিচারের অপেক্ষায় রয়েছি। বিচার, আইনের উপরে অগাধ আস্থা রয়েছে। মায়ের কাছে বিচার চাইব। সঠিক বিচার। আর বলব র্যাগিংয়ের বিনাশ করো মা! যেন আমার মতো সন্তানহারা আর কেউ না হন। ওদের এমন শাস্তি দাও, যেন বিশ্ব চমকে যায়, এরকম অত্যাচার কেউ না করতে পারে।’’
বিচার, অপেক্ষা আর শোকস্তব্ধ পরিবেশ পেরিয়েও বারবার ঘুরেফিরে আসে সেদিনের কথাও। সন্তানহারা বাবা বলছেন, ‘‘জানেন, সেদিন ওকে অত্যাচার করছিল। টের পাচ্ছিলাম। ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। যারা অত্যাচার করছিল ওরা ফোনে কথা বলেছিল। ছটফট করছিলাম। কত গাড়িকে বললাম, আমাকে যাদবপুর নিয়ে চলো। কেউ যেতে চাইল না। অবশেষে একজন রাজি হলেন। তখন শুনছি, আমার ছেলে নাকি উপর থেকে পড়ে গেছে।’’ কারণ যাই হোক, বিচার এখনও অধরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.