Advertisement
Advertisement
Ahmedabad Plane Crash

আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনা: প্রশাসনিক গাফিলতির জবাব দেবে কে?

বারবার ঘটে চলা দুর্ঘটনা ঠেকাতে যা-যা করণীয়, সেটা আগে সরকার করুক।

Ahmedabad Plane Crash: Who will answer for administrative negligence
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 17, 2025 3:00 pm
  • Updated:June 17, 2025 5:25 pm  

দুর্ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষাই যে সরকার নেয় না, তার প্রমাণ আহমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গুপ্তকাশীগামী হেলিকপ্টার এবং পুণেতে সেতু ভেঙে পড়া। আমাদের দুর্ভাগ‌্য যে, দুর্ঘটনার পরই ত্রুটিগুলিকে আড়াল এবং দোষীদের বাঁচানোর চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। এই প্রশাসনিক গাফিলতির জবাব দেবে কে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।

আহমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালের বেডে শুয়ে বি. জে. মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারি পড়ুয়া ধ্রুবিন কাপাডিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলেছেন, ‘যা করতে হয় করুন, আর যেন এমন না ঘটে।’ এয়ার ইন্ডিয়ার লন্ডনগামী ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৮ আহমেদাবাদের মেঘানিনগরে বি. জে. মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়াদের মেসের ছাদে আছড়ে পড়ার পর গুরুতর জখম হয়েছেন ধ্রুবিন। দুর্ঘটনার বীভৎসতায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ওই যুবক ডাক্তারি পড়ুয়া হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অস্ফুট স্বরে প্রধানমন্ত্রীকে যে-কথাটা বলতে পেরেছেন, সেটাই এখন সারা দেশের আওয়াজ। বারবার ঘটে চলা এই দুর্ঘটনা, এই মৃত্যুমিছিল ঠেকাতে যা-যা করা দরকার, সেটা আগে সরকার করুক।

একটা দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যে সরকার কিছুই করে না, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তো আহমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার (Ahmedabad Plane Crash) ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই মিলল। কেদারনাথ থেকে গুপ্তকাশী যাওয়ার পথে পর্যটক বোঝাই বেল ৪০৭ হেলিকপ্টারটি তো গৌরীকুণ্ডের জঙ্গলের উপর ভেঙে পড়ল প্রশাসনের গাফিলতিতেই। যেখানে আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল, ঘন মেঘের জালে দৃশ্যমানতা ছিল না বললেই হয়, সেখানে কপ্টারটিকে ওড়ার অনুমতি দেওয়া হল কেন? ২০০১ সালে ঠিক এভাবেই খারাপ অাবহাওয়ার মধে‌্য ও দৃশ‌্যমানতা শূন‌্য থাকা সত্ত্বেও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা মাধবরাও সিন্ধিয়ার ছোট বিমান ওড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যেটি দুর্ঘটনায় পড়ে। মাধবরাও নিজেই এক সময় দেশের বিমানমন্ত্রী ছিলেন। গত ৩০ এপ্রিল চারধাম যাত্রা শুরু হওয়ার পর নাকি এটি পঞ্চম হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা! পঞ্চম দুর্ঘটনায় এক শিশু-সহ ছয় পর্যটক এবং পাইলটের মৃত্যুর পর এখন উত্তরাখণ্ডের সরকার বলছে আপাতত ওই এলাকায় হেলিকপ্টার পরিষেবা বন্ধ থাকবে। কেন্দ্রীয় বিমান মন্ত্রক সুরক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার পর ছাড়পত্র দিলেই ফের হেলিকপ্টার পরিষেবা চালু হবে। অর্থাৎ, এতদিন পর্যাপ্ত সুরক্ষা ছাড়াই ওই দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টার চলছিল! এই প্রশাসনিক গাফিলতির জবাব দেবে কে? ঘটনাচক্রে গুজরাতর মতো উত্তরাখণ্ডেও মোদির দলেরই সরকার।

পুণের পিম্পড়ি-চিঞ্চওয়াড় এলাকায় খরস্রোতা ইন্দ্রায়নী নদীর উপর পর্যটক বোঝাই সেতু ভেঙে পড়ার পর প্রায় তিন বছর আগে গুজরাতের মোরবিতে মাচ্ছু নদীর উপর সেতু ভেঙে পড়ার স্মৃতি ফিরে আসছে। ঠিক একই ভাবে প্রশাসনের চরম উদাসীনতায় মোরবি সেতুর উপর নিয়ন্ত্রণহীন ভিড় হয়ে গিয়েছিল পর্যটকদের। সেতু ভেঙে মৃত্যু হয়েছিল কমপক্ষে ১৪১ জনের। ব্রিটিশ অামলের সেতুটি ঘটনার কিছুদিন অাগেই মেরামত করা হয়েছিল। ত্রুটি ছিল মেরামতেই। পুনেতে ব্রিটিশ অামলের সেতুটি মেরামতই করা হয়নি। ‘বিপজ্জনক সেতু’ লিখে একটি বোর্ড টাঙিয়ে দায় সেরেছিল প্রশাসন। যদিও লোনাভলায় বেড়াতে অাসা পর্যটকরা নিয়মিত ভিড় করেন ওই সেতুতে। দুর্ঘটনার সময় ভিড়টা অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছিল। মহারাষ্ট্রেও ডাব্‌ল ইঞ্জিনের সরকার চলছে। প্রতিবেশী গুজরাতের মোরবি সেতু ভাঙার ঘটনা থেকে যে, কোনও শিক্ষাই মহারাষ্ট্র প্রশাসন গ্রহণ করেনি, তা বলা বাহুল‌্য।

অাহমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে কেন্দ্রীয় বিমান মন্ত্রকের সংস্থা ‘এয়ারক্রাফ্‌ট অ‌্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন বু‌্যরো’ (এএঅাইবি)। ‘ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন’-এর প্রোটোকল এবং ২০১৭ সালের বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত সংক্রান্ত বিধি মেনে এই তদন্ত হচ্ছে বলে কেন্দ্র জানিয়েছে। কিন্তু এই তদন্তের বিশ্বাসযোগ‌্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ কেন্দ্রীয় বিমান মন্ত্রকের অধীন সংস্থা ‘এএঅাইবি’ কীভাবে মন্ত্রকের গাফিলতির কথা বলবে, সেই প্রশ্ন রয়েছে। দেশে বিমান চলাচল এবং এয়ারলাইন্‌স সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘ডাইরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন’ (ডিজিসিএ)। এই ‘ডিজিসিএ’-ও কেন্দ্রীয় বিমান মন্ত্রকের অধীন।

ফলে ‘ডিজিসিএ’-এর বিরুদ্ধেও এএঅাইবি-র মুখ খোলার সম্ভাবনা খুবই কম। অতীতেও একই ঘটনা দেখা গিয়েছে। স্বচ্ছ তদন্তের স্বার্থে ‘এএঅাইবি’-কে কেন্দ্রীয় বিমান মন্ত্রকের অধীনে না-রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি সংস্থায় কেন পরিণত করা হয় না, সেই জবাব পাওয়া যায় না।

অাহমেদাবাদের ক্ষেত্রে যে বিমান রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বড় ত্রুটি ছিল, তা বিশেষজ্ঞদের ঘটনার প্রাথমিক বিশ্লেষণে উঠে অাসছে। সমগ্র ঘটনায় নাশকতাও থাকতে পারে। কিন্তু নাশকতার কারণটি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে না। পাইলট বা কো-পাইলটের ভুলের জেরে দুর্ঘটনা বলে একটি মহলের অভিমত রয়েছে। কেন ৬২৫ ফুট ওঠার পরেও বিমানের ল‌্যান্ডিং গিয়ার উঠল না এবং ডানার ফ্ল‌্যাপ খুলল না, সেই প্রশ্ন তুলছে এই মহলটি। বিমান দুর্ঘটনার পর সম্পূর্ণ দায় পাইলটদের উপর চাপিয়ে দেওয়া খুবই চিরাচরিত প্রথা। তাহলে অন‌্য সব গাফিলতি অাড়ালে চলে যায়। তদন্তও তাড়াতাড়ি শেষ হয়। সাম্প্রতিক, কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে যে, চালকের মৃতু‌্য হলেই তঁার ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা। গত কয়েক বছরে অামরা দেশে অনেক বড়-বড় ট্রেন দুর্ঘটনাও প্রত‌্যক্ষ করেছি। এর মধে‌্য করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাটি সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। এক্ষেত্রেও রেল কর্মী ও রেল প্রশাসনের গাফিলতির বিষয়টি সামনে এসেছিল। অাহমেদাবাদে গাফিলতির বিষয়টি খুঁজতে গেলে অাঙুল উঠবে ডিজিসিএ ও বিমান মন্ত্রকের দিকেও। সেটি কি মোদি প্রশাসন করতে দেবে?

মোদ্দাকথা, প্রশাসনিক শৈথিল‌্য ও গাফিলতি দূর করা না-গেলে দেশে রেল, ট্রেন, সেতু দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না। এক্ষেত্রে যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি রয়েছে– সেগুলি ক্রমশ দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এই প্রবণতা অাগের চেয়ে বেশি। সংস্থাগুলিতে নতুন কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে না বললেই হয়। কিছু ক্ষেত্রে অর্ধেকের বেশি পদ শূন‌্য। সর্বত্র বেসরকারিকরণের প্রচেষ্টা চলছে। বেসরকারি সংস্থাগুলি মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন‌্য কাজের গুণমান রক্ষায় অাপস করে।

যে অভিযোগ এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণের পরেও উঠেছে। কিন্তু এয়ারলাইন্‌সের ক্ষেত্রে গুণমানের সঙ্গে সামান‌্য অাপসের পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ‌্য। অাহমেদাবাদের দুর্ঘটনার পিছনে কী-কী প্রশাসনিক গাফিলতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি সক্রিয় ছিল, তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। কিন্তু অামাদের দুর্ভাগ‌্য যে, দুর্ঘটনার পরই ত্রুটিগুলিকে অাড়াল করার মরিয়া চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। দোষীদের বঁাচানোর চেষ্টা শুরু হয়। তদন্ত সৎ ও অান্তরিকভাবে করা না-গেলে, দোষীদের চিহ্নিত না করা গেলে, ত্রুটিগুলি সংশোধন করার চেষ্টা না-হলে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে না। ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট যে, দেশে রেল, বিমান সফর ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। রাস্তাঘাটে চলাফেরা এখন প্রাণ হাতে নিয়ে করতে হয়। দুর্ঘটনা ঘটলে মৃতু‌্যর সংখ‌্যা চেপে দেশের অগ্রগতি জাহির করে কাজের কাজ যে কিছুই হয় না, এই সত‌্যটা রাজনৈতিক কারণেই বোঝার চেষ্টা হয় না। মৃতু‌্যর সংখ‌্যা চেপে, প্রশাসনিক গাফিলতি অাড়াল করে শুধু ভাবমূর্তি নির্মাণের চেষ্টা চললে কখনওই দুর্ঘটনা বন্ধ করা যাবে না। সাধারণ মানুষকে সেই তিমিরেই থাকতে হবে।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement