ইরান বনাম ইজরায়েলই হোক বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রযুক্তি পথে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে গেলেই কি সভ্য হওয়া যায়? মিসাইল, ট্যাঙ্ক, ড্রোনই কি সো কলড নগর-কেন্দ্রিক সভ্যতার মাপকাঠি!!! কলমে মণিশংকর চৌধুরী।
‘আপনি নরমাংস খেয়েছেন?’ শ্লেষ মেশানো প্রশ্ন ছুড়ে দিল ‘পৃথ্বীশ’। উত্তরে ‘মনমোহন মিত্র’ বললেন, ‘সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। শুনেছি নরমাংস সুস্বাদু। কিন্তু আমি খাইনি।’ পৃথ্বীশের পালটা, ‘এই ক্যানিবলিজমকে আপনি সভ্যতার কোন স্তরে ফেলবেন?’ শুনেই মনমোহনবাবুর চোখেমুখে ফুটে উঠল তীব্র ঘৃণা, রাগ। বললেন, ‘সভ্য কোথায়, বর্বর! বারব্যারিক! সভ্য কী জানেন, সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ যে আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে, একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসী সমেত একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর সভ্য কারা জানেন, যাঁরা এই অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। উইদাউট টার্নিং এ হেয়ার।’
উপরোক্ত সংলাপ এবং চরিত্র ‘আগন্তুক’ ছবির। সত্যজিত রায়ের অমর কীর্তি। তৈরি ১৯৯১ সালে। ধৃতিমান চ্যাটার্জি পর্দার পৃথ্বীশ। মনমোহন মিত্র ওরফে নিমো বা মিস্টার নো বডির পর্দা কাঁপানো অভিনয়ে উৎপল দত্ত। সেসময় সবে বিশ্বায়নের হাওয়া বইছে। বণিকদের মনে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বা বলা ভালো বাণিজ্যিক কুটুম তৈরির তাড়না। না, আমি চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ নই। সমালোচকও নই। মানিকবাবুর ছবি নিয়ে আঁতলামো করব, সেই বান্দাও নই। আমি আর পাঁচটা সেন্ট পার্সেন্ট ভেতো (এক্ষেত্রে ভাতপ্রিয়) বাঙালির মতোই সত্যজিৎ-প্রেমী। শুধু মনে হয়, প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে ‘মিস্টার নো বডি’র মাধ্যমে যে মোক্ষম সওয়ালটি তিনি করেছিলেন তা তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার কঙ্কালসার চেহারার নগ্ন-উলঙ্গ রূপ সামনে নিয়ে এসেছিল। আজও তা প্রাসঙ্গিক। সত্যিই তো, সভ্য কে? আলতামিরার গুহায় যারা বাইসন এঁকেছিল, নাকি যারা আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে, একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসী সমেত একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে!!!
ইরান বনাম ইজরায়েলই হোক বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রযুক্তি পথে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে গেলেই কি সভ্য হওয়া যায়? মিসাইল, ট্যাঙ্ক, ড্রোনই কি সো কলড নগর-কেন্দ্রিক সভ্যতার মাপকাঠি!!! আমি জানি না। জাতীয়তাবাদের নামে যুদ্ধ, অর্গানাইজড রিলিজিয়ানের নামে জেহাদ, অস্ত্রের বেসাতি কি সভ্যতা? জানি না! আদৌ উত্তর আছে কি, তাও জানি না। রিল এবং রিয়েলে যুদ্ধজিগিরের মাঝে কি কেউ সেই আলতামিরার গুহাবাসীকে মনে রেখেছে, তাও জানি না। তবে এটা বলতে পারি, একজনও যদি মিস্টার নো বডির মতো প্রশ্ন তুলতে পারে, সভ্য কে? তাহলে হয়তো এখনও না-মানুষ না হওয়ার একটি ক্ষীণ আশা আছে।
যুদ্ধ কি আদিম যুগে হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী। তবে আণবিক যুগের এই সর্বগ্রাসী ক্ষিদে হয়তো ছিল না। ছিল না আত্মভূক সর্পের মতো মানবজাতির খিদে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি, গাজার ধ্বংসস্তূপ। কীভাবে ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ ক্রমশ ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। দু’পক্ষই লাগামছাড়া আক্রমণ চালাচ্ছে। কীভাবে ইরানের সামরিক ঘাঁটি এবং পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার লক্ষ্য করে আকাশপথে হামলা চালানো হয় ইজরায়েলের তরফে। এই হামলার জেরে মৃত্যু হয়েছে ইরান সেনার চিফ অফ স্টাফ মহম্মদ বাঘেরি, রেভোলিউশনারি গার্ডসের কমান্ডার হোসেন সালামি, ইরানের এমার্জেন্সি কমান্ডের কমান্ডার এবং দুই শীর্ষ সেনা আধিকারিকের। পাশাপাশি ৯ জন পরমাণু বিজ্ঞানীকে নিখুঁত পরিকল্পনায় হত্যা করে ইজরায়েল।
পরোক্ষে ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, চিনও। গতকালই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, আগামী সপ্তাহেই ইরান-ইজরায়েল সংঘাতের এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। কার্যত যুদ্ধের ‘ডেডলাইন’ দেন তিনি। ধমকির সুরে ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের প্রতি ট্রাম্পের বার্তা— গুড লাক। আর এসবের মাঝে ‘মিডিয়া ওয়ার’। বাস্তবের চাইতে কয়েকগুণ বেশি বারুদের গন্ধ সংবাদমাধ্যমগুলিতে। কে কত বেশি ধ্বংসে সক্ষম, তা নিয়ে আলোচনা। একটি মিসাইল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেউই বলছে না, নেতানিয়াহু, খামেনেই, পুতিন ছাড়াও এই দুনিয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের। পশু-পাখির, কীট-পতঙ্গের। এই দুনিয়া সেই আলতামিরার বাইসনের। তাই এই রক্তলোলুপ যুদ্ধবাজদের রাজত্বে আজ একজন মিস্টার নো বডির খুব প্রয়োজন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.