মানুষের কাজে না-লাগিয়ে নিজের শরীরকে মৃত্যুর পর মাটিতে পুঁতে ফেলে বা পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলার মধ্যে ভয়াবহ যে-অপচয় রয়ে যায়, তার তুলনা মেলা ভার। তবে, মানুষের কল্যাণে নিজেকে সঁপে দিয়ে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন ‘মহানায়ক’। তাই এই জীবন ও এই শরীরকে অবহেলা করলে হবে না! লিখলেন ঋত্বিক মল্লিক।
বিলাসবহুল ক্রুজে চুপ করে শুয়ে থাকার সঙ্গে শবদেহের খুব কিছু ফারাক বোধহয় নেই। শুধু মাথা তার কাজ থামিয়ে শাটার নামিয়ে দিয়েছে, আর বদলে যাচ্ছে পেশির ধরন। তবে এমন জাহাজে শেষ পর্যন্ত শুয়ে থাকতে চাই, সেখানকার যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হবে কোনও অজানা শীতল ল্যাবরেটরিতে। সেখানে বৈজ্ঞানিকদের এমন সুযোগ দেওয়া যাবে, যা জীবিত অবস্থায় সম্ভব নয়। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, যেভাবে দু’-হাজার বছর ধরে শবদেহ নিজেদের মেলে ধরেছে ব্যবচ্ছেদের টেবিলে, মানুষের রোগমুক্তি আর দীর্ঘ জীবনের কামনায়, ঠিক সেভাবেই মৃত্যুর পর কাজে লেগে পড়তে চান মেরি রোচ। তাঁর লেখা ‘Stiff: The Curious Life of Human Cadavers’ বই ভরে উঠেছে সেই কর্মমুখর জীবনের (না কি মৃত্যুর) উদ্যাপনে।
যতই মানি যে, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে; উপবিষ্ট মশার উড়ে যাওয়ার যে সংগীত– তার অপচয় যেমন আমাদের নজর এড়িয়ে যায়, বিনয় মজুমদারের মতো কবি ছাড়া সেই অপচয়ের কথা যেমন কেউ বলে না, তেমনই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘অপচয়’ নিয়েও আমরা ততটাই উদাসীন। মানুষের কাজে না-লাগিয়ে নিজের শরীরকে মৃত্যুর পর মাটিতে পুঁতে ফেলে বা পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলার মধ্যে ভয়াবহ যে-অপচয় রয়ে যায়, তার তুলনা মেলা ভার। তবে এই প্রসঙ্গে একটা খটকাও রয়েছে মেরি রোচের মনে। অনেকেই হয়তো মনে করেন, মৃতদেহের যথাযথ সৎকার না-করা আসলে সেই ‘মৃত’ ব্যক্তির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা।
তাই এই বই, বা ধরুন, এই লেখাটিকেও মনে হতে পারে ‘ডিস্রেসপেক্টফুল’, কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, এই বই মৃত্যু নিয়ে নয়, মৃতদেহ নিয়ে। তবু মেরি রোচ বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যানাটমি ল্যাবে যথাযথভাবে পালিত হওয়া ‘মেমোরিয়াল সার্ভিস’-এর প্রসঙ্গ। সেখানে অনেক সময় মৃতের পরিবারের সদস্যদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিক্ষক এবং ছাত্রদের পক্ষ থেকে জানানো হয় সম্মান ও কৃতজ্ঞতা। অনেক ছাত্রই নাম দেন মৃতদেহের, খুব যত্ন আর সাবধানতার সঙ্গে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি স্পর্শ করেন যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মৃতদেহটি। মেরি প্রশ্ন করেছিলেন ম্যাথিউ নামের এক ছাত্রকে, “যে-শরীরের সঙ্গে এত গভীর যোগাযোগ হল, ডিসেকশন ক্লাস শেষ হয়ে গেলে তাকে কি ‘মিস’ করো?” উত্তরে সেই ছাত্রটি জানান যে, এক অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করে ছেড়ে যেতে।
আপনি যদি টাইম মেশিনে করে হাজির হন ১২ শতকের আরবে, দেখবেন কোনও কোনও বিশেষ জায়গায় কিছু লোক মাঝে-মাঝে একটা ঝোলা ব্যাগ আর প্রচুর অর্থ নিয়ে জড়ো হচ্ছে। কারণটা না-জানলে এবং ঠিকঠাক জায়গাটা না-জানলে আপনি হয়তো কিছুই বুঝতে পারবেন না। আসলে এই লোকগুলো পেতে চাইছে মধুমাখা মানুষের একখণ্ড মাংস। ৭০-৮০ বছর বয়স হয়ে গেলে আরবের কিছু মানুষ মনে করত তাদের শরীর বৃথা নষ্ট না-করে মানুষকে বঁাচানোর কাজে লাগাবে। সবরকম খাদ্য ত্যাগ করে তারা শুধু মধু খেত এবং স্নান করত মধুতে। মাসখানেক বাদে বর্জ্য পদার্থ হিসাবে নিঃসৃত হত শুধু মধু এবং এর কিছু দিন বাদে মধুতে জারিত এই শরীর ছেড়ে পরলোকে যাত্রা করত। এই মধুমাখা শরীর তখন একটি পাথরের কফিনে রেখে দেওয়া হত আরও মধুতে চুবিয়ে। কফিনের গায়ে লেখা থাকত তারিখ আর সাল।
১০০ বছর পরে এই পাথরের কফিন থেকে বের করা হত এই ‘mellified man’-কে, যার অন্য নাম ‘Human Mummy Confection’। এই ‘কনফেকশন’ থেকে এক খণ্ড অংশ খেলে ভাঙা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা শরীরের গভীর ক্ষতর উপশম হয়। আবার এই রেসিপি পাওয়া যায় ১৫৯৭ সালে চিনের বিখ্যাত ন্যাচারালিস্ট লি শি-চেন সংকলিত ‘চাইনিজ মেটিরিয়া মেডিকা’-এ। ষোড়শ, সপ্তদশ এমনকী অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে ওষুধ তৈরিতে মমি করে রাখা শবদেহের যে যথেষ্ট ব্যবহার ছিল, সেই সময়ের রসায়ন বইগুলিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
দ্বাদশ শতকের আরবের মতো নিজের মৃত শরীর কাজে লাগানোর জন্য উৎসর্গ করা এখন আর খুব অবাক করে না। ব্যাপকভাবে না-হলেও, অনেক সচেতন ব্যক্তিই মরণোত্তর দেহদানের সম্মতি দিয়ে যায়। তবে মেরি রোচ এই বিষয়ে এক অদ্ভুত তথ্য রেখেছেন আমাদের সামনে। তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, অ্যানাটমির শিক্ষকদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক বেশি। অ্যানাটমির অধ্যাপক এইচ. প্যাটারসন মনে করেন, “I’ve enjoyed teaching anatomy, and look, I get to do it after I die.” তঁার মতে রেনেসঁাসের সময়ে পাডুয়া আর বোলোগনার অ্যানাটমির শিক্ষকরা যখন বুঝতে পারতেন যে, মৃত্যু আসন্ন, তখন তঁাদের ‘সেরা’ ছাত্রকে ডেকে পাঠাতেন এবং তৈরি থাকতে বলতেন দেহ-ব্যবচ্ছেদের জন্য। তঁাদের করোটি বা কঙ্কাল তঁারা দিয়ে যেতেন প্রদর্শনের লক্ষ্যে। এখনও পাডুয়ার মেডিকেল কলেজে এরকম কিছু সাজানো করোটি দেখতে পাওয়া যায়।
রে ব্রাডবেরি এমন এক ব্যক্তির সন্ধান দেন– যে, নিজের শরীরের কঙ্কাল নিয়ে মুগ্ধ ছিল। তার মনে হয়েছিল এত দিন ধরে যে তার শরীরকে ধরে রেখেছিল, তার সঙ্গে রইল মৃত্যু পর্যন্ত, তাকে জীবদ্দশায় আর দেখার সুযোগ হবে না। সে চেয়েছিল মৃত্যুর পর তার কঙ্কাল যেন টাঙিয়ে রাখা হয় সাধারণ জীবিত মানুষজনের দেখার জন্য। বেঁচে থেকে হয়তো তেমন কিছু করা হয়ে ওঠেনি, কিন্তু মৃত্যুর পর তার কঙ্কাল বেঁচে থাকুক অমর হয়ে। রোচের এই বইটি পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল আমার স্কুলে বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল রুমে টাঙিয়ে রাখা কঙ্কালের কথা! ছোটবেলায় তো ভয় পেতাম ওই ঘরের আশপাশে যেতে।
পরে অবশ্য ভয়ের জায়গা নিল রহস্য। মনে হত, কে এই ব্যক্তি, কেমন লোক ছিল, কী করত জীবিতকালে, কীভাবে এসে হাজির হল প্রায় দু’-শতাব্দী প্রাচীন এই বিদ্যালয়ে? বইটি পড়তে পড়তে এমন অমরত্বের লোভ মাঝে মাঝে জেগে উঠছে বইকি!
লেখক রূপে মেরি রোচেরও যে এমন কথা মনে হবে, সে আর আশ্চর্য কী! তিনি চেয়েছিলেন মস্তিষ্ক দান করে যেতে। এই মর্মে তিনি চিঠি লেখেন হার্ভার্ড ব্রেন ব্যাঙ্কের ডিরেক্টরকে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল যে, লোকে মস্তিষ্ক দান করে অনেক কারণে। কিন্তু তিনি মনে করেন মানসিক অসুস্থতা নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে মনুষ্যমস্তিষ্কেরই একমাত্র প্রয়োজন। বিভিন্ন কারণে অন্য প্রাণীর মস্তিষ্ক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো যায় ঠিকই, কিন্তু একমাত্র মানুষেরই মনখারাপ হয়, অবসাদে বিষণ্ণতায় ভোগে, আত্মহত্যা করতে চায়। মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর “অ্যালজাইমার’স” বা ‘স্কিজোফ্রেনিয়া’ হয়েছে বলে তো শোনা যায়নি আজ পর্যন্ত। তাই এক্ষেত্রে দরকার মানুষেরই মাথা, বিশেষ করে তা যদি হয় মানসিক রোগে আক্রান্ত লোকের, তাহলে তো কথাই নেই।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে– বেঁচে থেকে আপনি হয়তো কাটিয়ে দিয়েছেন খুব মামুলি একটা জীবন। শোকে, তাপে, মানসিক চাপে জর্জরিত হয়ে দেখেছেন আপনার সঙ্গেই পৃথিবীতে থাকা অন্য লোক বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে, ভোগ করেছে যাবতীয় আলো। আপনি মনে-মনে ভেবেছেন– ‘এই জীবন নিয়ে এই জন্মে কিছুই করা হল না’, সাধারণের ভিড়েই রয়ে গেলেন, কীটপতঙ্গের মতো তুচ্ছ হয়ে। এই বই আপনাকে জানাবে যে জীবন এখানেই শেষ নয়। আরও মহৎ জীবনের স্বাদ পাওয়ার আর-একটা সুযোগ আপনি পেতে পারেন শেষ মুহূর্তেও। শুধু কোনওমতেই নষ্ট করা যাবে না আপনার এই নশ্বর শরীরকে। ‘মৃত্যু’ আপনাকে শেষ সুযোগ দেবে, মানুষের কল্যাণে নিজেকে সঁপে দিয়ে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন ‘মহানায়ক’। মেরি রোচের বইয়ের থেকে চারটি বাক্য এখানে রাখতে চাই: ‘Get involved with science. Be an art exhibit. Become part of a tree. Some options for you to think about.’ জীবিত শরীর যতই একঘেয়েমিতে ভরা হোক, প্রাণহীন সমুদ্রে ভেসে চলা ক্রুজে আপনি কিন্তু ঝলমল করবেন এক অদ্ভুত মায়াবী রোমাঞ্চকর আলোয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.