Advertisement
Advertisement
Donald Trump

ট্রাম্পের তুঘলকি চরিত্রের কারণেই শুল্কযুদ্ধ, আশা-নিরাশার দোলাচল

সত্যিই শুল্ক চাপলে মোদি অন্তত নেহরুকে এবার দোষ দিতে পারবেন না!

Donald Trump implement tariffs on India
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:August 20, 2025 9:05 pm
  • Updated:August 20, 2025 9:06 pm   

ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুঘলকি চরিত্রের কারণেই এই শুল্কযুদ্ধে আশা-নিরাশার দোলাচল অব্যাহত। ৫০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণের কথা যেমন ঘোষণা করেছিলেন, তেমনই দুম করে তা ২৫ শতাংশে নামিয়ে দিতে কতক্ষণ! তবে সত্যিই শুল্ক চাপলে মোদি অন্তত নেহরুকে এবার দোষ দিতে পারবেন না! লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

বাকি আর মাত্র এক সপ্তাহ। দৈব সহায় হলে অন্য কথা, না হলে ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে চলার দিন শুরু হবে সাতদিন পর থেকে। মার্কিন মুলুকের বাণিজ্য দলের আসার কথা ছিল ২৫ আগস্ট। বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করতে। কোনও কারণ না-দেখিয়েই তা স্থগিত করা হয়েছে। কবে তঁারা আসবেন কেউ জানে না। এক অদ্ভুত টেনশনের মধ্য দিয়ে চলছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনার মাশুল ভারতকে কীভাবে দিতে হতে পারে এখনও তার কোনও সম্যক ধারণা নেই। না-থাকার একটা কারণ ট্রাম্পের তুঘলকি চরিত্র। কে বলতে পারে, হুট করে যেমন ৫০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তেমনই দুম করে তা ২৫ শতাংশে নামিয়ে দেবেন না? কথায় বলে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। ২৭ আগস্ট পর্যন্ত সেই আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকতে হবে। অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে সেই আশাও
জেগে থাকবে। কিন্তু তা যদি মরীচিকার মতো মিলিয়ে যায়, তাহলে নব্বইয়ের ঘরে সাপের মুখে পড়ে লুডোর কোন ঘরে যে বাণিজ্য-বহর ঝুপ করে নেমে আসবে কেউ জানে না। যুক্তরাষ্ট্রে ভারত বছরে ৮ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের মতো পণ্য রফতানি করে।

‘অবজারভেটরি অফ ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটি’-র (ওইসি) জানাচ্ছে, এই বছরের জুন মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত আমদানি করেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ, উদ্বৃত্ত বাণিজ্য ট্রাম্পের কোপে নিমেষের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতিতে পৌঁছে যেতে পারে!
মোদি কি কখনও ভেবেছিলেন তঁার জিগরি দোস্ত এমন অনিশ্চয়তার মুখে ভারতকে ফেলে দেবেন? ভাবেননি। সবরমতির তীরে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দোলনায় দোল খাওয়ার সময়েও কল্পনা করেননি গলওয়ানে ’৬২ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে লাল ফৌজ। বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের দু’-হাতে বুকে জড়িয়ে ধরা যে কূটনীতি নয়, সেই বোধ এগারো বছরেও মোদির হল না। দুর্ভাগ্য এটাই। ট্রাম্পের রোষানল থেকে বঁাচতে চিন ও রাশিয়া এখন তঁার ‘ওয়েসিস’। কিন্তু কতটা তারা ভারতের মুশকিল আসান হবে, আর কতটা নিজেদের আখের গোছাবে জানা নেই। ট্রাম্পের চাপে পুতিন ভারতকে তেল বেচা বন্ধ করেন কি না সেটা প্রাথমিক পরীক্ষা।

এই ‘মাখামাখি’-তে রুষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প-অনুগত বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো ‘দ্য ফাইন‌ানশিয়াল টাইমস’-এ এক নিবন্ধে কড়া ভাষায় লিখেছেন, ‘ভারত এখন রাশিয়ার তেলের আন্তর্জাতিক ক্লিয়ারিং হাউসের কাজ করছে। রাশিয়া ও চিনের সঙ্গে মাখামাখি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র‍্যাটেজিক পার্টনার থাকতে গেলে ভারতের উচিত ঠিকঠাক আচরণ করা।’
এমন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো পরিস্থিতির শঙ্কা ফিকি বা সিআইআই করেনি। দুই বণিকসভার মতে, ভারতীয় রফতানিকারকেরা বড়জোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির ঝাপটা সামলাতে পারবেন। ৫০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির সুনামির মোকাবিলা তঁাদের কম্ম নয়। অবস্থাটা ঘটিবাটি বেচে বিবাগী হওয়ার মতো!

অথচ মাত্র ছ’-মাস আগেও, এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে, ট্রাম্পের পুনরাভিষেকের পর হোয়াইট হাউসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে উৎফুল্ল মোদির ঘোষণা ছিল, আগামী পঁাচ বছরে দুই দেশের বাণিজ্য-বহর ৫০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছবে। হায় রে, তখন কি ভেবেছিলেন মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক!

ভারতের মোট জিডিপির ২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের অবদান। মোট রফতানির ১৮ শতাংশের অভিমুখও ট্রাম্পের দেশ। ২৫ শতাংশ শুল্কের কথা ট্রাম্প যেদিন ঘোষণা করেন, তখন অর্থনীতিবিদদের ধারণা ছিল, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপির হার সাড়ে ৬ থেকে নেমে বড়জোর ৬-এ দঁাড়াতে পারে। কিন্তু ৫০ শতাংশের মার? হিসাব কষতে অর্থনীতিবিদেরা হিমশিম খাচ্ছেন। ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’-এর (জিটিআরআই) অনুমান, সিদ্ধান্তের বদল না হলে পণ্য রফতানির হার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

জিটিআরআই একটা প্রাথমিক হিসাব কষেছে। তাতে অনুমান, ২৭ আগস্টের পর শুল্কহারে পরিবর্তন না-হলে জৈব রাসায়নিক রফতানিতে মোট শুল্ক ধার্য হবে ৫৪ শতাংশ, কার্পেটে ৫২.৯ শতাংশ, বস্ত্রে ৬০.৩, পোশাকে ৬৩.৬, তৈরি পোশাকে ৫৯, আসবাব ও বিছানায় ৫২. ৩ শতাংশ। অতিরিক্ত শুল্কের আওতার বাইরে এখনও পর্যন্ত রয়েছে ওষুধ ও ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্র। কিন্তু মারাত্মক ধাক্কা আসবে অটোমোবাইল, বস্ত্র ও পোশাক এবং গহনা শিল্পে। শেষের এই তিন শিল্প পুরোপুরি শ্রম নিবিড়। ধাক্কার সামাল দিতে হবে মোদি-রাজ্য গুজরাতকে। শুধু গহনা শিল্পেই গুজরাতে নিযুক্ত কমবেশি ২০ লাখ দক্ষ-আধা দক্ষ শ্রমিক। আমেরিকার বাজার বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় দিনে দুপুরে অঁাধার ঘনিয়েছে গুজরাতে। ‘বিকল্প’ বাজারের সন্ধান শুরু হয়েছে এখন থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর বলিরেখা এমনি-এমনি গাঢ় হয়নি।

জিটিআরআইয়ের মূল্যায়নে গহনা শিল্পের মতোই শঙ্কা শ্রম নিবিড় বস্ত্র উৎপাদন খাতে। বস্ত্র রফতানির ৪০ শতাংশের গন্তব্য আমেরিকা। ভারতের সেই বাজার পলকের মধ্যে চলে যাবে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ায়। কম্বোডিয়ার উপর আমেরিকা শুল্ক বসিয়েছে ১৯ শতাংশ, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের উপর ২০ শতাংশ। শুল্ক হারে হেরফের না-ঘটলে তৈরি পোশাকের বাজার বাংলাদেশে ও কার্পেট, রত্ন, দামি পাথরের উৎপাদন কেন্দ্র আমিরশাহিতে সরিয়ে নেওয়া যায় কি না সেই ভাবনা শুরু হয়েছে। ভারতের কার্পেটের সবচেয়ে বড়
বাজার আমেরিকা। সাড়ে ৫৮ শতাংশ রফতানি ওই দেশেই। এই শিল্পের তিন প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ তুরস্ক (শুল্প ১৫ শতাংশ), মিশর (১০ শতাংশ) ও কানাডা (০ শতাংশ)। চিংড়ি-সহ বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবার রফতানির ৩২ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে।

সেই বাজারের দখল নেবে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম। তাদের শুল্কহার
১৯ ও ২০ শতাংশ মাত্র। প্রথম দফার রাজত্বে ট্রাম্প জোর দিয়েছিলেন হার্লে ডেভিডসন মোটর বাইক, স্কচ হুইস্কির মতো পণ্যে। এবার চাপ কৃষি ও ডেয়ারি বাজার উন্মুক্ত করার। মোদি জানেন, এই দাবি মানা ও হঁাড়িকাঠে মাথা দেওয়া সমান। ভারতের কোনও দলের কোনও প্রধানমন্ত্রীরই হিম্মত নেই এই দাবি মানার। মাথা নোয়ানো মানে বুকে শক্তিশেল বেঁধা। সেটা করবেন না বলেই ‘সবুজ বিপ্লব’-এর জনক এম. এস. স্বামীনাথনের জন্ম শতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে বুক ঠুকে বলেছেন, কৃষক ও পশুপালকদের স্বার্থের সঙ্গে আপস করবেন না। তিনি বিলক্ষণ জানেন, মোট প্রবৃদ্ধির ২০ শতাংশ আসে কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্য থেকে। ডেয়ারি ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত ৮ কোটি মানুষ। জিডিপির ৫ শতাংশ এই শিল্পের অবদান। গ্রামীণ ভারতের ৮৫ শতাংশ ক্ষুদ্র কৃষক। সেই কবে গান্ধীজি বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া লিভস ইন ইট্‌স ভিলেজেস’। কৃষক ও পশুপালকদের খেপিয়ে গদি রাখা সম্ভব নয়।

রাশিয়া ও চিনের হাত ধরে বঁাচার তাগিদের পাশাপাশি স্বদেশিয়ানাকে অঁাকড়ে ধরার কথা বলেছেন মোদি। গলওয়ানের পর চিনকে শায়েস্তা করতেও এমনই হঁাক পেড়েছিলেন। স্লোগানধর্মী শব্দ ও বাক্যচয়নে পারদর্শী মোদি চিনা পণ্য বয়কটের হিড়িক তুলে ‘ভোকাল ফর লোকাল’ এর ডাক দিয়েছিলেন। কেউ শোনেনি। পাল্টা হুমকি দিয়েছিলেন চিনের রাষ্ট্রদূত। সেই স্লোগান এখন মোদি ফের নতুন করে শোনাচ্ছেন। ঠেলা সামলাতে জিএসটির সংস্কারের কথা বলছেন।

০ থেকে ২৮ পর্যন্ত মোট পাঁচটি কর হারের বদলে ৫ ও ১৮ শতাংশ দু’টি কর হার প্রবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নতুন দেশের বাজার ধরার আগ্রহ দেখিয়ে করতে চাইছেন নতুন বাণিজ্য চুক্তি। সফল হবেন কি না সময়ই তা বলবে। মোদির দুর্ভাগ্য, শুল্কযুদ্ধে ব্যর্থ হলে এই প্রথম তিনি জওহরলাল নেহরুকে দায়ী করতে পারবেন না। বলতে পারবেন না,এ ক্ষেত্রেও নেহরুই যত নষ্টের গোড়া!

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ