সুজনকুমার দাস: কলকাতা ও বাংলার দুর্গাপুজো এখন কেবল ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, এটি এক বিশাল অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরীক্ষাগার। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দুর্গাপুজো পশ্চিমবঙ্গের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ২.৬ শতাংশ জুড়ে রেখেছে। ২০২৫ সালে পুজোয় মোট অর্থনৈতিক লেনদেনের বাজারমূল্য ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ভাবা যায়, কয়েক দিনের এক উৎসব গোটা বছরের অর্থনীতিকে এমনভাবে নাড়া দিতে পারে!
দুর্গাপুজো শুধু প্রতিমা বা প্যান্ডেল নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পুজোকে কেন্দ্র করে
ফ্যাশন, টেক্সটাইল, জুতো, প্রসাধনী, খুচরো বাজার, রেস্তোরাঁ, হোটেল, ট্যুরিজ্ম, সিনেমা
ও বিনোদন শিল্প– সব কিছুরই চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দুর্গাপুজোর সবচেয়ে বড় দিক হল, আয়ের বণ্টন। আধুনিক খুচরো বাজারে যেখানে পুঁজির কেন্দ্রীকরণ বাড়ছে, সেখানে দুর্গাপুজো বিপরীত স্রোতে কাজ করে। উৎসবকেন্দ্রিক আয় সরাসরি পৌঁছয় সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের কাছে। প্রত্যেকেই এই সময় বিশেষ আয়ের সুযোগ পায়। প্রতিমাশিল্পী, ঢাকি, প্যান্ডেল মিস্ত্রি, আলো-সাজসজ্জার শ্রমিক, নিরাপত্তাকর্মী– হাজার হাজার মানুষের অস্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি হয়। বড় ব্র্যান্ডের পাশাপাশি হকার, ছোট দোকান, মিষ্টির দোকান, এমনকী চায়ের স্টলও আয় বাড়িয়ে নিতে পারে। এই টাকার স্রোত কেবল শহর নয়, জেলা শহর ও মফস্সলকেও স্পর্শ করে।
উৎসবের সময় সাধারণ খুচরো বাজারের জমজমাট দৃশ্য কেবল আবেগ নয়, অর্থনীতিরও এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। তবে এটাও দেখা যাচ্ছে যে, বড় মল ও অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম ক্রমশ বাজার দখল করছে। এর ফলে রাস্তার হকার বা পাড়ার দোকান যে পরিমাণ লাভ একসময় পেত, এখন তা কমে যাচ্ছে। এই বাস্তবতাকেও অস্বীকার করা যায় না।
কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতিটি দুর্গাপুজো কমিটিকে ‘অনুদান’ দিয়ে আসছে।
এ-বছর সেটা বেড়ে হয়েছে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। পুজোতে সরকারি এই অনুদানের পক্ষে
ও বিপক্ষে দু’-রকমের মতামত আছে। সমালোচকদের মতে এই অর্থ স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা কৃষিতে ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু অনুগামীদের যুক্তি– এই টাকা শেষ পর্যন্ত স্থানীয় অর্থনীতিতেই ফেরে এবং একাধিক স্তরে মানুষের আয় বাড়ায়। পুজো কমিটিগুলো আলো, সাজসজ্জা, নিরাপত্তা, প্রতিমা বা সাউন্ড সিস্টেমে খরচ করে, তবে সেই অর্থ শেষ পর্যন্ত স্থানীয় শ্রমিক, সরবরাহকারী বা দোকানদারের হাতে পৌঁছায়। বাজারে চাহিদা বাড়ে, ফলে অর্থনীতি অনেক বেশি গতি পায়। অর্থনীতির ভাষায়, এটি এক ধরনের ‘কেইনসিয়ান মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট’।
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে সবই যে ভালো হয়, তা নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে রাজ্যের
ভাল হলেও পরিবেশ দূষণ একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। প্রতিমা ভাসানে জলদূষণ, প্লাস্টিকের ডেকোরেশন, অযথা বিদ্যুৎ খরচ এসব নিয়ে প্রতি বছর সমালোচনা হয়। ‘গ্রিন প্যান্ডেল’ বা ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি প্রতিমা’-র উদ্যোগ থাকলেও তা এখনও ব্যতিক্রম। ‘উৎসব অর্থনীতি’-কে যদি দীর্ঘমেয়াদে সচল রাখতে হয়, তবে পরিবেশবান্ধব বিকল্পই একমাত্র পথ।
২০২১ সালে ইউনেস্কো দুর্গাপুজোকে ‘Intangible Cultural Heritage of Humanity’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের। এর ফলে কলকাতার দুর্গাপুজো আন্তর্জাতিক মানচিত্রে এক বিশেষ স্থান দখল করেছে। বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে হোটেল, ট্যুর-ট্রাভেলস, রেস্তোরাঁ ও বিনোদন শিল্পে। যদি সঠিক ব্র্যান্ডিং হয়, তবে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে প্রচুর বিদেশি এলে পর্যটন শিল্প চাঙ্গা হবে। ‘ব্র্যান্ড বেঙ্গল’
গড়ে তুলতে এই উৎসবের মতো সম্পদ আর কিছু নেই।
কিন্তু পুজোর রূপান্তর কেবল অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এখনকার দুর্গাপুজো প্রযুক্তিনির্ভরও বটে। প্যান্ডেলে এআই-ডিজাইন্ড লাইটিং, ড্রোন শো, 3D ম্যাপিং, এমনকী সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য আলাদা ইনস্টলেশন আর্ট দেখা যাচ্ছে। দুর্গাপুজো তাই এক ধরনের টেক-ফেস্ট, যেখানে সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটছে।
অন্যদিকে, তরুণ উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপদের জন্যও এই উৎসব সুযোগ তৈরি করছে। নতুন প্রোডাক্ট, ফুড ব্র্যান্ড বা ডিজিটাল কনটেন্ট এই সময় বাজারে লঞ্চ হয়। কাজেই বললে অত্যুক্তি হবে না যে, দুর্গাপুজো আসলে এক ধরনের বাজার গবেষণার মঞ্চ।
এছাড়া দুর্গাপুজোর অর্থনীতিতে মহিলাদের অবদানও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিমা বা প্যান্ডেলের কাজে তারা না-থাকলেও, ঘরোয়া প্রস্তুতি, প্রসাদ, জামাকাপড়ের ব্যবসা কিংবা ছোটখাট উদ্যোগ– এসবের বড় অংশ মহিলাদের হাতে তৈরি হয়। সুতরাং দুর্গাপুজো কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মহিলা ক্ষমতায়নের পথও সুগম করে।
বর্তমানে দুর্গাপুজো কেবল কলকাতার নয়, বিশ্বের বাঙালিদের উৎসব। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, টোকিও বা দুবাইয়ে প্রবাসী বাঙালিরা পুজো আয়োজন করে। অনেক সময় কলকাতার মণ্ডপের সঙ্গে ডিজিটাল লাইভ সংযোগ রাখে। এর ফলে দুর্গাপুজো এক গ্লোবাল কালচারাল নেটওয়ার্কে রূপ নিচ্ছে। আর কলকাতা শহরও পুজোর সময় হয়ে ওঠে নগর ব্যবস্থাপনার এক পরীক্ষাগার। ট্রাফিক সামলাতে জিপিএস ম্যানেজমেন্ট, ড্রোন নজরদারি, মোবাইল অ্যাপ ব্যবহৃত হচ্ছে। এক অর্থে দুর্গাপুজো স্মার্ট সিটি ম্যানেজমেন্টের বাস্তব উদাহরণ।
তবে উৎসব অর্থনীতি কেবল আনন্দ নয়, চাপও তৈরি করে। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার দুর্গাপুজোতে নতুন জামাকাপড়, গয়না, গ্যাজেট বা বেড়ানোর খরচ মেটাতে ঋণ নেয় বা সারা বছরের সঞ্চয় শেষ করে ফেলে। এতে একদিকে বাজার চাঙ্গা হয় ঠিকই, কিন্তু অন্যদিকে অনেকেরই ব্যক্তিগত অর্থনীতি টালমাটাল হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, উৎসব-পরবর্তী সময়ে অনেক পরিবারকে মাসের পর মাস কিস্তি শোধ করতে হয়। ফলে দুর্গাপুজো যে অর্থনৈতিক উল্লাস আনে, তা কখনও কখনও পরিবারের জন্য দীর্ঘস্থায়ী চাপও বয়ে আনে। সুতরাং নিজের আয় বুঝে ব্যয় করে উৎসবের আনন্দে শামিল হওয়া উচিত। ক্ষমতার বাইরে গিয়ে পুজোর খরচ না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
পরিশেষে, দুর্গাপুজো বাঙালির কাছে শুধু দেবীর আরাধনা নয়, এটি বাংলার সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উৎসব। উৎসবের আনন্দ যেমন আড্ডা, ভিড়, নতুন জামা আর রঙিন আলোয় ধরা দেয়, তেমনই এর পিছনে লুকিয়ে থাকে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ। দুর্গাপুজো তাই কেবল ধর্মীয় আবেগের উৎস নয়, বাংলার অর্থনীতির একটি শক্তিশালী ইঞ্জিন– যা সমাজের প্রতিটি স্তরে আনন্দ ও আয় বয়ে আনে। আর তাই বিজয়া দশমীর দিন চোখে জল এলেও, অর্থনীতির গতিবেগ মনে করিয়ে দেয়– মায়ের আগমন কেবল শান্তি নয়, সমৃদ্ধিরও বার্তা বহন করে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.