ডায়েরি লিখতেন কাফকা। সচেতনভাবে যা রবীন্দ্রনাথ লেখেননি। কেউই লেখে কি এখন? যা কিছু ব্যক্তিগত, তার মুখোমুখি হতে ভয় হয়?
মনখারাপে মুষড়ে পড়া পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ছে। মনখারাপ, বিষণ্ণতার একটা বড় কারণ হতে পারে কাউকে মনের কথা বলতে না-পারার বেদনা। এমন কোনও ভাবনা থেকেই
হয়তো কেন্দ্র দেশের স্কুলগুলিকে সম্প্রতি এই নির্দেশিকা পাঠিয়েছে, পড়ুয়াদের মনখারাপ সারাতে, তাদের মুক্ত করতে অবসাদ থেকে, যেন তাদের ডায়েরি লিখতে শেখানো ও উৎসাহিত করা হয়।
কেন্দ্রের এই নির্দেশিকা কারও-কারও মনে আনতে পারে ১৯০৯ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে চেক লেখক ফ্রান্ৎজ কাফকার বিপুল ডায়েরি-গুচ্ছর কথা, যার কেন্দ্রীয় বিষয় বলা চলে মনখারাপ, বিষণ্ণতা, অবসাদ, যা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল কাফকার মন, ১৪ বছর ধরে ক্রমাগত দিনলিপি লিখে যাওয়ার পরেও! কাফকার ৪১ বছর জীবনের শেষ বছর হল ১৯২৩ থেকে ১৯২৪। তঁার মন এত দূর বিষাদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত, দিনলিপি লেখাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে কাফকার ডায়েরি পৃথিবীকে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে ডায়েরির ‘সাহিত্যিক মূল্য’ কোন অবিশ্বাস্য শিখরে পৌঁছতে পারে। এবং ডায়েরির সংজ্ঞা কত দূর বদলে যেতে পারে। কাফকার ডায়েরি কোনও অর্থেই শুধুমাত্র সীমিত নয় দিনলিপিতে।
যে-ঘটনা ঘটেনি, ঘটতে পারত, যে চিঠি কোনও দিন কারও কাছে যাবে না, যে বাস্তব ঘটবে না কোনও দিন, যে-বাস্তব একান্তভাবে তঁারই ব্যক্তিগত, অসম্ভব মর্তভূমিতে, যে-গল্প তঁার মনেই থেকে গেল এবং যেসব ভাবনা নিরন্তর তারল্যে মিশে যাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে– এসব কাফকার ডায়েরির ক্রমান্বিত অবসাদের অঙ্গ। ১৯২৩ সালের ২২ জুন, কাফকা তঁার শেষ দিনলিপিতে এক যন্ত্রণাকাতর মন নিয়ে লিখলেন এই বাক্যটি: ‘And so on to infinity’– এভাবেই পৌঁছে যেতে হবে অনন্তে। প্রশ্ন হল, সেখানে পৌঁছেও কি পাওয়া যাবে অবসাদের অবসান?
গত ১০০ বছর ধরে আমরা ক্রমাগত সরে এসেছি ডায়েরি থেকে।
তার প্রধান কারণ, মানুষ ক্রমশ বর্তমানকে সামলাতে যতটা ব্যস্ত, ততটাই ব্যস্ত এবং উৎসাহী তার ভবিষ্যতের প্রতি। ‘ডায়েরি’ মানেই তো যা কিছু অতীত হয়ে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে তাকে বেঁধে রেখে, মনে রেখে, পুরনোর মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা। মানুষের সেই সময় আর নেই, এই গতি এবং এগিয়ে যাওয়ার যুগে। আমরা ঢুকে পড়েছি এমন এক গতিময়, বর্ণময়, বিচিত্র বিনোদনে ভরা আধুনিকতার– যার চোখে তেমন কোনও মূল্য নেই অতীত অঁাকড়ে পড়ে থাকার। আরও একটি কারণে ডায়েরি লেখার অভ্যাস থেকে সরে এসেছে মানুষ। ডায়েরি লেখা মানেই অত্যন্ত ব্যক্তিগত কথা লেখা, আসল ‘আমি’-র সামনে দঁাড়ানো।
জীবনে যত বাড়ছে জটিলতা, ততই দূরায়ত হচ্ছি আমরা আমাদের মধ্যে ওই ‘আসল’ আমিটা থেকে। আধুনিক যুগে তাই ডায়েরি থেকে দূরে থাকতেই চেয়েছে মানুষ। ডায়েরি লেখার ঝুঁকি নিতে হাত কঁাপে, মন ভয় পায়। রবীন্দ্রনাথ লেখার কোন ক্ষেত্রে প্রবেশ করেননি? কিন্তু একটিমাত্র জায়গায় থমকে গিয়েছেন। দিনলিপি। হয়তো এই এখানেও তঁার ‘আধুনিকতা’। বুঝতে পেরেছিলেন, এ-যুগ ডায়েরির নয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.