ভিড় বনাম ব্যক্তি। জনতা বনাম রাজনীতিবিদ। সংঘ বনাম শিল্পী। এমন দ্বৈরথ প্রায় দেখা যায়। ভিড়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বনামের, না কি সমন্বয়ের?
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক লুডউইগ ভিট্বগেনস্টাইনের লেখা ও ভাবনার সঙ্গে অনেকে পরিচিত। অনেকে তেমনভাবে হয়তো পরিচিত নয়। তাতে কিছু যায়-আসে না। বিষয় যেহেতু ভিড়ের মধ্যে ‘একা’ হওয়া বা একাকিত্বের সন্ধান, ভিট্বগেনস্টাইনের নামটা মনের মধ্যে ঢুকে পড়ল, কেননা তিনি খুঁজে ছিলেন ভিড়ের মধ্যে নিঃসঙ্গতা এবং নিঃসঙ্গতার মধ্যে ভিড়, ভাবনার ভিড়, চিন্তার সমাবেশ, বিচিত্র বিবেচেনার ঠাসাঠাসি।
তাঁর সমালোচকরা অবশ্য বলেছেন, তিনি কোনওটাই পাননি। না পেয়েছেন ভিড়ের মধ্যে নিঃসঙ্গতা, না পেয়েছেন নিঃসঙ্গতার মধ্যে ভিড়। আসলে তাঁর এই চাওয়া ও ভাবনার মধ্যেই একটা পাগলামি আছে। আর সেই পাগলামির কারণ হল, যুদ্ধের সময় তাঁর মাথায় একটা বুলেট ঢুকে যায় এবং বুলেটটা মাথার মধ্যে থেকেই যায়! ভিট্বগেনস্টাইনের এই বিদ্রুপাত্মক সমালোচনাকে চিরকালীন দার্শনিক দোলাচলে পাঠিয়ে দিয়েছেন এ-যুগের আর-একজন বিখ্যাত চিন্তাবিদ ভলফ্রাম আইলেনবার্গার তাঁর ‘টাইম অফ দ্য ম্যাজিশিয়ান্স’ বইয়ের একটি বাক্যে: ‘দিস ইজ নট এনটায়ারলি কারেক্ট অর্ এনটায়ারলি ফল্স।’
ভিড়ের মধ্যে একাকিত্ব রবীন্দ্রনাথও চেয়েছেন আজীবন। যত বেড়েছে তাঁর খ্যাতি, যত প্রসারিত হয়েছে তাঁর সঙ্গ-প্রার্থীদের সংখ্যা, ততই যেখানে রবীন্দ্রনাথ সেখানেই তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মানুষের সমাবেশ। তাঁর সান্নিধ্যের, সাহচর্যের, নৈকট্যের আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এইটাই অনিবার্য যে, তাঁর ব্যক্তিগত ‘পরিসর’ বলে এক-এক সময়ে কিছু থাকত না। সেই অবস্থার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য ক্ষমতা অর্জন করলেন নিজের মধ্যে– ভিড়ের মধ্যে একা হওয়ার ক্ষমতা।
তৈরি করলেন নিজের মধ্যে দু’টি সত্তা– একটি রবীন্দ্রনাথ বাইরের। অন্যটি অন্তরের। এবং তাঁর এই নিবিড় সত্তা ভিড়ের মধ্যেও নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে একা হতে পারল। এইভাবেই তিনি রক্ষা করেন তাঁর নিজস্ব ভাবনার গহিন পরিসর। নিজের সম্বন্ধে এই অন্তরসত্যটি তিনি প্রকাশ করেছন তাঁর ‘গীতবিতান’-এর ভূমিকার গানে একটি মাত্র পঙ্ক্তিতে: ‘বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা’। ওই ভূমিকা-গীতিরই আরও একটি পঙ্ক্তিতে তিনি জানাচ্ছেন, জীবনের সমস্ত ভিড় অতিক্রান্ত তাঁর ‘নিভৃত প্রহরের’ কথাও।
ভিড়ের মধ্যে মানুষের একাকিত্বের চরম নিদর্শন সম্ভবত কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের নিঃসঙ্গতা। চারধারে রণহুংকারের মধ্যে অর্জুনের মনে জাগল এমন কিছু দার্শনিক প্রশ্ন, যার উত্তর দিতেই যুদ্ধক্ষেত্রে তৈরি হল মায়াময় নিভৃত-প্রহর অর্জুন ও কৃষ্ণর মধ্যে, যা যুদ্ধের সমস্ত আস্ফালন থেকে বিচ্ছিন্ন। কোনও দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর পেতে নয়, প্রেমের চিঠি লিখতে কামানের পাশে দাঁড়িয়ে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বারবার হয়েছেন দলবিচ্ছিন্ন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লেখা তঁার প্রেমের চিঠি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, চারধারে মৃত্যু মিছিলের মধ্যেও কত বিচ্ছিন্ন হতে পারে মানুষ প্রেমিকাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সঙ্গিনী হওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.