কান্না এক ধরনের প্রাকৃতিক থেরাপি। বলছেন মনোবিজ্ঞানীরা। মুম্বইয়ের ‘ক্রাইং ক্লাব’ সেই চাপ মুক্তির একটি স্বাভাবিক, সুন্দর পরিসর দিয়েছে।
লর্ড আলফ্রেড টেনিসনের ‘হোম দে ব্রট হার ওয়ারিয়র ডেড’ কবিতাটি অনেকেরই পড়া। এই কবিতার মধ্য দিয়ে টেনিসন মানুষের আবেগ প্রকাশের গভীরতা দেখিয়েছেন। কান্না সবসময় সহজে আসে না, অনেক সময় শোক তীব্র হলে মানুষ পাথর হয়ে যায়, অনুভূতিগুলি স্তব্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে শহিদ সেনার শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বিধবা স্ত্রী শেষে কঁাদলেন। সে-কান্না দুর্বলতা নয়, বরং গভীর মানবিকতার প্রকাশ।
কেঁদে হালকা হওয়া– এই বাক্যের সঙ্গেও আমরা প্রত্যেকেই কম-বেশি পরিচিত। তাই মুম্বই শহরে ডাক ছেড়ে কান্নার একটি ঠিকানা হয়েছে। জীবনের ব্যস্ততম রাস্তাঘাট, দৌড়ঝঁাপ আর নিরন্তর প্রতিযোগিতার ভিড়ের মধ্যেও প্রশান্তির টুকরো ঠিকানা। শুনতে যতই অদ্ভুত লাগুক, আসলে এ এক গভীর মানবিক প্রয়াস। কারণ, মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, কান্না শুধু আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং মানসিক ভারসাম্য রক্ষারও একটি কার্যকর উপায়। জাপানিরা বিশ্বাস করে, কান্না মানসিক চাপ কমাতে এবং আবেগের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ‘রুইকাতসু’ বা ‘টিয়ার-সিকিং থেরাপি’ সেই দেশে জনপ্রিয়। তার থেকেই এই ক্লাবের উদ্যোক্তারা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
আসলে, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন মানুষের কাছে আবেগ প্রকাশকে দুর্বলতা বলে মনে করা হয়। অফিসে প্রতিযোগিতা, সংসারে অশান্তি, সম্পর্কের অনিশ্চয়তা কিংবা ব্যক্তিগত সংগ্রাম– সবকিছুর চাপ জমে যায় মনের ভিতর। সমাজের চোখরাঙানি, আত্মসম্মানের ভয় বা লজ্জার কারণে মানুষ প্রায়শই কান্নাকে দমন করে রাখে। অথচ মনোবিজ্ঞানীরা বারবার বলেছেন, কান্না এক ধরনের প্রাকৃতিক থেরাপি। যা স্ট্রেস হরমোন কমায়, শরীর ও মনের উপর থেকে চাপ হালকা করে। মুম্বইয়ের ক্রাইং ক্লাব সেই চাপ মুক্তির একটি স্বাভাবিক, সুন্দর পরিসর করে দিয়েছে, যেখানে কান্না আর কোনও ‘লজ্জার বিষয়’ নয়, বরং মানুষের সহমর্মিতা ভাগ করে নেওয়ার একটি সেতুবন্ধন। কয়েকজন অচেনা মানুষ একসঙ্গে বসে চোখের জল ফেলছে, কিন্তু সেই অশ্রুতেই তৈরি হচ্ছে অদৃশ্য বন্ধন।
আমরা যতই প্রযুক্তিনির্ভর হই না কেন, আসল সত্যটি হল, মানুষের গভীরতম প্রয়োজন মানুষেরই সঙ্গ। একাকিত্ব ভর করার এই সময়ে ‘ক্রাইং ক্লাব’ সেই শূন্যতাকে কিছুটা হলেও পূরণ করছে। হালের শহুরে বাস্তবতায় এই ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যেমন নতুন ক্যাফে, ফিটনেস সেন্টার বা মল আমাদের আধুনিক জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে, তেমনই হয়তো একদিন কান্নার এই বিশেষ ক্লাবও সাধারণ জীবনের স্বাভাবিক অংশে পরিণত হবে। কারণ কান্না দুর্বলতা নয়, বরং শক্তি, যা মানুষকে ভিতর থেকে শুদ্ধ করে, নতুন করে বঁাচার শক্তি দেয়। মুম্বইয়ের এই নতুন প্রবণতা নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী, প্রয়োজনীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ। ক্রাইং ক্লাব দেখিয়ে দিল, অশ্রু লুকিয়ে রাখার নয়, বরং তা-ই হতে পারে মুক্তির রাস্তা। যদি এই ধারণা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তবে হয়তো আমরা আরও সুস্থ, ভারসাম্যপূর্ণ এবং সহমর্মী সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। আ মরি কান্নাভাষা!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.