Advertisement
Advertisement
CJI BR Gavai

আমাদের মুখেই জুতো এসে পড়ল

জুতো ছুড়ে সনাতন ধর্মকে বাঁচানোর চেষ্টার দাবি অভিযুক্ত আইনজীবীর!

Editorial on shoe thrown at CJI BR Gavai

ফাইল ছবি

Published by: Amit Kumar Das
  • Posted:October 10, 2025 2:55 pm
  • Updated:October 10, 2025 2:55 pm   

রাজদীপ সারদেশাই: মনের মধ্যে যে-প্রশ্নটি সমানে কৌতূহল জাগাচ্ছে, সেটি দিয়েই শুরু করি। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে যে-ব্যক্তি জুতো ছুড়ে মেরেছেন, তাঁর নাম রাকেশ কিশোর না হয়ে যদি রহিম খান হত, তাহলে বিষয়টি কোন দিকে গড়াত? অনুমেয়, শাস্তি না পেয়ে ছাড়া পেতেন না ভদ্রলোক। আরও বড় কিছু ঘটতে পারত– যদি রহিম খানের বিরুদ্ধে ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’, ‘পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট’ ধারায় মামলা করা হত! আর যদি এই ‘কল্পিত’ রহিম খান কাশ্মীরি মুসলিম হতেন, তাহলে তো তাঁর বিরুদ্ধে প্রযোজ্য হতে পারত ‘আনলফুল প্রিভেনশন অ্যাক্টিভিটিজ অ্যাক্ট’। প্ররোচনা ছড়ানোর জন্য এসব কথা বলছি না। বলছি এ কারণে যে, বিভেদে শতচ্ছিন্ন আমাদের এই সামাজিক প্রতিবেশ ঘৃণায় এমনই ভরে গিয়েছে যে, স্থূল দাগের ‘জনাদেশ’ এখন একটি ফৌজদারি মামলার গতিপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অনায়াসে ও আকছার।

Advertisement

কী করে ঘটনার সূত্রপাত, তাহলে সেটা এবার দেখা যাক।
খাজুরাহো মন্দিরে বিষ্ণুর একটি ভগ্নস্বাস্থ্য মূর্তির মেরামতির আর্জি জানিয়ে জনস্বার্থ মামলা দাখিল করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি বি. আর. গাভাই সেই মামলা মুলতবি করে দেন এই যুক্তিতে যে, এটি আসলে ‘পাবলিসিটি ইন্টারেস্ট লিটিগেশন’! মানে, জনস্বার্থের চেয়ে প্রচারের আলোয় থাকতে চাওয়া এখানে মুখ্য। সেজন্য প্রধান বিচারপতি, আবেদনকারীর উদ্দেশে, এমন মন্তব্যও করেন যে, ‘দয়া করে ভগবানকেই গিয়ে বলুন না তিনি যেন নিজে থেকেই কিছু ব্যবস্থা করে নেন। আপনি বলছেন, আপনি ভগবান বিষ্ণুর নিষ্ঠ ভক্ত। তাহলে মন পেতে আপনি বললে নিশ্চয় ভগবান শুনবেন। প্রার্থনা করুন।’ যে-কণ্ঠে এসব কথা বলেছিলেন প্রধান বিচারপতি, তা ব্যঙ্গাত্মক। এর দরকার ছিল বলে মনে করি না। কিন্তু ভুললে চলবে না, এই কথাগুলি আসলে ‘অবজারভেশন’ বা পর্যবেক্ষণ। ‘রায়’ নয়। প্রধান বিচারপতি এই মামলায় আগ্রহী হননি, কারণ, খাজুরাহোর ভগ্নস্বাস্থ্য দেবমূর্তির হাল ফেরানোর দায়িত্ব ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’-র।

দুর্ভাগ্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা প্রতিটি বিষয়ের ভাল-মন্দ নির্ধারণে ব্যস্ত থাকে, তাদের হাতে এত সময় কখনওই থাকে না যে, কোনও কিছু ঠান্ডা মাথায় পড়ে বিচার করে দেখবে! তাছাড়া, এই বোদ্ধাদের রাজনৈতিক পরিচয়টি উজ্জ্বল। রাজনীতির শক্তিকে এরা অস্ত্রের মতো ধারালো করে তুলেছে। দক্ষিণপন্থী শিবিরে বিরাজ করে যেসব গোষ্ঠী বা ব্যক্তিমানুষ, তাদের উপর প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হল ক্ষারের মতো জ্বলুনিধরা। কোনও কোনও গোষ্ঠীর মাথায় কেন্দ্রের হাতও ছিল। ফলে এমন সুচারুভাবে দ্রোহের পরিবেশ গড়ে তোলা হল, এমন করে সুরসমন্বয়সাধন করা হল, প্রধান বিচারপতি বলতে বাধ্য হলেন, তিনি আদতে সব ধর্মের অন্তঃশক্তিতে বিশ্বাসী। সব ধর্মের পীঠস্থানে তিনি যেতে পছন্দ করেন। তিনি প্রকৃতপক্ষেই একজন‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষ।

কিন্তু এতেও বা কাজ হল কই! না জনচিত্ত শান্ত হল, না দ্রোহের আগুনে জলসিঞ্চন করা গেল। বরং সমাজমাধ্যম ছেয়ে গেল প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বানানো নানাবিধ মিম, হ্যাশট্যাগ ও ইউটিউব ভিডিওয়। প্রধান বিচারপতিকে অশালীনভাবে তিরস্কার করতে কারও বাধল না এতটুকু। আর, এই উত্তপ্ত পরিবেশেই ঘটে সেই ভয়ংকর কাণ্ড। ৭১ বছরের রাকেশ কিশোর, পেশায় অ্যাডভোকেট, এক পাটি জুতো ছুড়ে মারেন প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে, আর বলেন– ‘সনাতন ধর্মের অপমান হিন্দুস্তান সহ্য করবে না।’ প্রধান বিচারপতি গাভাই অবশ্য সংযম ধরে রাখেন। না কোনও মন্তব্য, না কোনও কড়া পদক্ষেপ! কিছুই তাঁর দিকে থেকে আসেনি। ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কোনও মামলাও দায়ের করতে চাননি। রাকেশ কিশোর বেকসুর ছাড়া পান ও তুমুল খ্যাতি চাখতে-চাখতে মন্তব্য করেন– ‘দরকারে আবারও এমনটা করব’– মানে, জুতো ছুড়ে মারবেন প্রধান বিচারপতিকে।

দিল্লি পুলিশের তরফে ‘সুয়ো মোটো’ করা হয়নি। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে রাকেশ কিশোরের আস্ফালন আরও বেড়ে যায়। স্পষ্টতই তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু কে বলবে সেটা, কে তার বিচার করবে! বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি ‘নায়ক’ হয়ে গেলেন রাতারাতি। ভেবে দেখলে, এতে অবশ্য অবাক হওয়ারও কিছু নেই। এমন ঘটনা ঘটার পরেও কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী লক্ষণীয়ভাবে নির্বাক রইলেন। প্রধানমন্ত্রীর টুইট করতে লেগে গেল প্রায় ৮ ঘণ্টা। সেখানে লেখা হল– ‘কাজটি অতীব নিন্দনীয়। প্রত্যেক ভারতবাসী এতে ক্ষুণ্ণ ও ক্রুদ্ধ হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রীর কড়া প্রতিক্রিয়াকে স্বাগত জানাতেই হয়। তবে ভুললে চলবে না, ২০১৯ সালেও তিনি অনুরূপ উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন বিজেপির এমপি প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিরুদ্ধে। প্রজ্ঞা আলোকিত করে তুলেছিলেন নাথুরাম গডসের ভাবমূর্তি। আর, প্রধানমন্ত্রীর কথায় ছিল এমন ইঙ্গিত যে, গান্ধীজির ভাবমূর্তিকে নিম্নগামী করার জন্য কোনও দিনই পুরোপুরি ক্ষমা করা সম্ভব নয় প্রজ্ঞাকে। অথচ, এরপরেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কঠোর পদক্ষেপ করা হয়নি। বিজেপির এই দর্পিত এমপি পুরো মেয়াদ সম্পূর্ণ করেন। সংঘ পরিবারের সঙ্গে পরে প্রজ্ঞার দূরত্ব বাড়লেও মনে রাখতে হবে গডসে-র চিন্তাপ্রণালী থেকে সংঘ কিন্তু মুক্ত নয়। অ্যাডভোকেট কিশোরও সে-ই বিশ্বাসভূমি থেকে জাত। তিনি নিজেকে সনাতন ধর্মের একজন প্রতিরক্ষাকর্মী ভাবেন, ভাবেন যে, তাঁর হাতেই সনাতন ধর্মের ভাল-মন্দ নির্ভর করছে। গান্ধীঘাতক গডসের সঙ্গে তাঁর একটিই তফাত। তিনি বন্দুক নন, তুলে নিয়েছেন তুলনায় অনেক কম বিপজ্জনক অস্ত্র– জুতো। জুতো ছুড়েই তিনি
রাগ দেখিয়েছেন।

দুটোই কিন্তু অসংযমী মনোভাবের লক্ষণ। ব্যাপারটি খুব সোজা। যে বা যারা হিন্দুত্বের অবমাননা করছে বলে মনে হবে, এই স্ব-নিয়োগী প্রতিরক্ষাকর্মীরা, আক্রমণ চালাবে তার বা তাদের বিরুদ্ধে। এদের সঙ্গে মৌলবাদী মুসলিম ধর্মান্ধদের কতখানিই বা তফাত? এ দেশের যেখানে তাকাও, দেখবে, কারও না কারও ধর্মীয় আবেগে হাত পড়ছে, এবং শুদ্ধিকরণের অজুহাতে হিংস্রতার আশ্রয় নেওয়া হয়ে উঠছে একটি সহজাত প্রতিক্রিয়া। অথচ হিংসার নিন্দা করতেই তো বরাবর শিখে এসেছি আমরা। এবার যদি বিপরীতে তাকাই, দেখব, প্রধান বিচারপতি গাভাইয়ের পরিবার ‘দলিত আন্দোলন’-এর সঙ্গে জড়িত ছিল, তাই তিনি হয়ে উঠেছেন ‘সহজ লক্ষ্যবস্তু’ বা ‘সফ্‌ট টার্গেট’। মানে, তাঁর থেকে প্রত্যাশিতই যে তিনি সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করবেন! বছরখানেক আগে গাভাই যখন ‘বুলডোজার’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, বুলডোজার চালিয়ে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া সংবিধানসম্মত নয়, তখনও তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় রুক্ষ আক্রমণের সামনে পড়েন। বলা বাহুল্য, যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসনের বিরুদ্ধে বুলডোজার সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ ছিল। তা, প্রশাসনপুষ্ট মাসলম্যানরা না ক্ষমা চাইতে জানে, না আদেশ অমান্য করতে শিখেছে!

অ্যাডভোকেট কিশোরের ছোড়া জুতো আসলে আমাদেরও মুখে এসে পড়েছে। তিনি ‘সনাতন’ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে চেয়েছেন– সংবিধানকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পরিসরে। তিনি শুধু প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতো ছোড়েননি, বরং এও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, আমাদের বিচার বিভাগ যদি যুক্তি ও সমতা, ন্যায় ও স্বচ্ছের পক্ষে দাঁড়ায়, যা কি না বিচার বিভাগের থেকে প্রার্থনীয় ও প্রত্যাশিত– তাহলে আবারও তিনি জুতো ছুড়ে সেই বিন্যাসকে আহত করবেন। অর্থাৎ অ্যাডভোকেট কিশোর ভয়ের আবহ তৈরি করতে চাইছেন। দাবিয়ে রাখার নীরব হুমকি দিচ্ছেন বিচার বিভাগের উদ্দেশে।

মনে হতে পারে, অ্যাডভোকেট কিশোর হয়তো-বা অস্থিরমতি। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, একবগ্গা। কিন্তু তা নয়। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, তিনি হুড়ুমতালে কিছু করেননি। যা করেছেন, ভেবেই করেছেন, এবং তা একটি ‘পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট’ বা ‘রাজনৈতিক বার্তা’-কে জনমানসের সামনে তুলে ধরে, ফুটিয়ে তোলে। এ দেশে সংবিধান ও আইন যেভাবে তৈরি হয়েছে– তাতে সমানাধিকার প্রাধান্য পায়। কিন্তু অ্যাডভোকেট কিশোরের মতো মানুষ সেই সমীকরণকে তছনছ করে দিয়ে এটা প্রতিষ্ঠা করতে চান যে, এই দেশ আসলে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’, এখানে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের স্বার্থেই দেশের আইন ও বিচারকে চলতে হবে।

এ কারণেই অ্যাডভোকেট কিশোরের করা কাজটি আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বইয়ে দেয়। এই দেশের সমাজব্যবস্থা বহুস্তরিক। এই দেশে নানা ধর্মের সহাবস্থান। আইনকে তাই ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের উপরে রাখতে না পারলে মুশকিল। হিংসায় প্ররোচনা জোগাতে পারে এমন যে কোনও ঘটনার বিরুদ্ধে আমাদের প্রত্যেককে রুখে দাঁড়াতেই হবে।

পুনশ্চ এ লেখার গোড়ায় বলেছিলাম, মনের মধ্যে একটি কৌতূহল তৈরি হয়েছে। লেখাটি শেষ করতে চাই অনুরূপ একটি কৌতূহলের কথা জানিয়ে। যাঁরা মনে করেন, প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে জুতো নিক্ষেপ করা বীরত্বের কাজ, তাঁরা বলুন তো– ভারতীয় মুসলিমদের কি ছাড়পত্র দেবেন– যদি অদূরভবিষ্যতে তাঁরা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সেসব বিচারপতির দিকে জুতো ছোড়েন– যাঁরা কিনা অযোধ্যার রাম মন্দিরের রায় দিয়েছিলেন?

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ