আসিরীয় সভ্যতার প্রতি পাতায় বিস্ময়
ঋত্বিক মল্লিক: মনে করুন- জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থর একেবারে প্রথম কবিতার শেষ দু’টি পঙক্তি: “পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল,/ এশিরিয়া ধুলো আজ বেবিলন ছাই হয়ে আছে।” এশিরিয়ার ধুলো থেকে আবার গড়ে তোলার এই গল্পই বলব আজ। বলব এমন এক শিশুর কথা, যে স্বপ্ন দেখত, হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন কোনও নগরীকে খুঁজে বের করবে মাটির তলা থেকে।
আসলে, সবেমাত্র সে পড়ে শেষ করেছে আরব্য রজনীর গল্প, রঙিন হয়ে উঠেছে তার কল্পনার দুনিয়া। ছোটবেলা থেকেই সে বইপোকা, দেশ-বিদেশের কথা জেনেছে বই থেকেই। কিন্তু তার বড় হওয়া খুব মসৃণ ছিল না। তবে সেসব কথা এখানে বলার নয়। আমরা একেবারে চলে যাব একটি দৃশ্যে, যেখানে এই শিশুটি বড় হয়ে গিয়েছে। তাঁকে এখন লোকে চেনে হেনরি লেয়ার্ড (১৮১৭-১৮৯৪) নামে। দেখা যাচ্ছে – তিনি বন্ধুদের সঙ্গে পরিকল্পনা করছেন কীভাবে ইউরোপ থেকে বেরিয়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া, প্যালেস্তাইন দিয়ে পৌঁছনো যায় মেসোপটেমিয়া আর বাগদাদে।
তারপর একদিন সত্যিই তিনি বেরিয়ে পড়লেন দেশ ছেড়ে। পথে অবিশ্বাস্য সব অভিজ্ঞতা পেরিয়ে এসে হাজির হলেন টাইগ্রিস নদীর ধারে জনপদ মোসুলে। পথে অবশ্য দেখা হয়েছিল ইস্তানবুলের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্ট্র্যাডফোর্ড ক্যানিংয়ের সঙ্গে। এর ফলে কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছে তাঁর গতিবিধি।
আমরা এই গল্প শুরু করব যখন মোসুলে পৌঁছে লেয়ার্ড গেলেন এই অঞ্চলের গভর্নর মহম্মদ পাশা-র কাছে। তিনি শুনেছিলেন যে, পাশা ছিলেন ভয়ংকর নিষ্ঠুর, বদরাগী আর খুনে প্রকৃতির লোক। যখন দেখা হল পাশার সঙ্গে, লেয়ার্ড দেখলেন কুৎসিত, বেঁটে, মোটা একটা লোক যার চোখ একটাই, কানও একটাই। পাশাকে দেখে এতটুকুও ভরসাযোগ্য বলে মনে হয়নি লেয়ার্ডের। স্বাভাবিকভাবেই আসল কারণটা চেপে গেলেন তিনি, শুধু বললেন, এখানে এসেছেন শিকারের উদ্দেশ্যে এবং তিনি নিমরুদের আশপাশের জঙ্গলে যেতে চান।
১৮৪৫ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে তাঁর ডায়েরিতে যে-এন্ট্রি রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, গোপনে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টাইগ্রিস নদীতে তিনি ভেসে পড়েছেন নিমরুদের দিকে। সাত ঘণ্টা সময় লাগল মোসুল থেকে নিমরুদ পৌঁছাতে।
তখন সুর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে এসেছে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, গোটা গ্রামে কোথাও বিন্দুমাত্র আলোর চিহ্ন নেই, এমনকী কোনও কুকুরের ডাকও শোনা যাচ্ছে না। ঠিক করলেন, নৌকাতেই রাত কাটিয়ে পরের দিন ঢুকবেন এই গ্রামে। ঠিক তখনই দূরে একটি ভাঙাচোরা বাড়ির খুপরিতে আলো দেখা গেল। লেয়ার্ড সদলবলে হাজির হলেন সেখানে। দেখলেন এক আরব পরিবার রয়েছে সেখানে। প্রাথমিক ভয়ভীতি কাটিয়ে সেই আরব পরিবারটি স্থান দিল লেয়ার্ডদের। তার পরের দিন এই পরিবারের প্রধান পুরুষ আওয়াদের সাহায্যেই জোগাড় করে ফেললেন বেশ কিছু লোক – তারা উঠে এল নিমরুদে একটি বড়সড় উঁচু ঢিপির ওপর। সামান্য খোঁজাখুঁজি করতেই পরপর পাওয়া যেতে লাগল কিউনিফর্ম লিপিতে খোদিত বেশ কিছু টালির মতো ফলক।
লেয়ার্ড বুঝলেন এত দিনে একেবারে ঠিক জায়গায় এসে হাজির হয়েছেন। এমন সময় আওয়াদ তাঁকে নিয়ে গেলেন এমন একটা জায়াগায়, যেখানে মাটির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আছে অ্যালাবাস্টারের কিছুটা আশ। খুব সাবধানে খুঁড়ে বের করা হলে দেখা গেল তার গায়েও রয়েছে কিউনিফর্ম লিপিতে কিছু লেখা। এইভাবে সেই দিনই দশটা স্ল্যাব তাঁরা পেলেন। লেয়ার্ড নিশ্চিত হলেন যে, এটি কোনও গ্রামের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং লম্বাটে চেহারার এই ঘরটি কোনও রাজপ্রাসাদের অংশ। এইরকম ঘর নিশ্চয়ই আরও আছে এখানে।
পরের দিন আরও লোক জোগাড় করে চলল অভিযান। সেদিন রাতে তিনি লিখলেন তাঁর ডায়েরিতে – ‘Before evening I found myself in a room panelled by slabs about eight feet high. The bottom of the chamber was paved with smaller slabs. They were covered with inscriptions on both sides. In the rubbish near the bottom of the chamber I found several objects in ivory upon which were traces of gliding.’
লেয়ার্ড যে পাশাকে মিথ্যে কথা বলেছিলেন, সে-খবর ঠিকই পৌঁছবে একদিন পাশার কানে। তাই কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি ফিরে গেলেন প্যাশার সঙ্গে দেখা করতে। বললেন, আবিষ্কারের গল্প, ভাব করলেন এমন, যেন ঘটনাচক্রে হয়ে গিয়েছে সব। পাশার সন্দেহ জাগল, লেয়ার্ড নিশ্চয় এসেছেন সোনার খোঁজে। লেয়ার্ড কথা দিলেন যদি তিনি সোনা পান, তাহলে সে সোনা তুলে দেবেন পাশারই হাতে। পাশা এবার নিজের বিশ্বস্ত এক লোককে পাঠাল লেয়ার্ডের সঙ্গে। মোটকথা আর কোনও বাধা রইল না লেয়ার্ডের।
ফিরে এসে আবার কাজে যোগ দিলেন, আরও অনেকগুলো পাথরের দেওয়াল খুঁজে পেলেন, খুঁজে পেলেন আরও কয়েকটা ঘর। এবং প্রচুর প্রত্নসামগ্রী। কিন্তু পেলেন না তেমন কোনও ভাস্কর্যের চিহ্ন। ডায়েরির হিসাব বলছে, সেদিন ছিল ২৮ নভেম্বর, সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হঠাৎই পাওয়া গেল একটি স্ল্যাব, যার মাঝখানে রয়েছে বাস-রিলিফে খোদাই করা একটি অস্পষ্ট ভাস্কর্য আর তার দু’দিকে উৎকীর্ণ লিপি। এই আবিষ্কার যেন বাড়িয়ে দিল সবার উৎসাহ। বৃষ্টিকে পরোয়া না করে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল কাজে, পাওয়া গেল আরও দুটো স্ল্যাব। এর মধ্যে বড় ফলকে রয়েছে যুদ্ধের দৃশ্য। ঠিক এর নিচে দেখা যাচ্ছে দুর্গের প্রাচীর আর তার ওপর রয়েছে এক নারীমূর্তি, অনেকটা যেন ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া গেল বিরাট আকারের আরও কয়েকটি মুর্তি। দক্ষিণ-পূর্ব প্রাচীরের কাছে পাওয়া গেল হাঁটু মুড়ে বসে থাকা এক সিংহকে আর একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় এক জোড়া ডানাওয়ালা দৈত্যাকার খাঁড়ের মুর্তি। এই মুর্তি দু’টির অবস্থান থেকে আন্দাজ করা যায় যে, এখানেই সম্ভবত ছিল এই মৃতনগরীর দ্বার। এইভাবে আরও অনেকগুলো মুর্তি আবিষ্কৃত হতে লাগল। ২০ ফেব্রুয়ারি ঘটল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি। লেয়ার্ডের কাছে দু’জন ঘোড়া ছুটিয়ে এসে খবর দিল, তারা ভগবানের দেখা পেয়েছে। লেয়ার্ডও দৌড় লাগালেন খনন স্থানের দিকে। দেখলেন বিরাট এক মানুষের মাথা পাওয়া গিয়েছে, ‘…the head must belong to a winged lion or a bull. The expression was calm yet majestic. I was not surprised that the Arabs had been amazed and terrified at the apparition. The gigantic head, blanched with age, might well have belonged to one of those fearful beings in the legends of their countries.’ এর পর যত খনন চলল, ততই পাওয়া যাতে লাগল আরও বড় বড় হলঘর, দেওয়ালে খোদিত রাজারাজড়া থেকে। সাধারণ নরনারীর নানা মূর্তি, তাদের গায়ে এমব্রয়ডারি করা অসাধারণ পোশাক আর অলংকার। ধীরে-ধীরে জেগে উঠল কোন সুদূর অতীতের এক আসিরীয় প্রাসাদ। প্রায় সাড়ে আট বছর পর লেয়ার্ড ফিরলেন তাঁর বাড়ি। ইতিমধ্যেই তিনি ‘বিখ্যাত’ হয়ে গিয়েছেন তাঁর দেশে। যে-কাকা তাঁকে একসময় প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন এই দুর্গম অজানা পথে যাত্রা করার ক্ষেত্রে, তিনিও লেয়ার্ডের খ্যাতিতে মুগ্ধ। যে অক্সফোর্ডে নিতান্ত অনিচ্ছায় আইন পড়তে গিয়ে জীবনের যন্ত্রণাময় শীতল রাত্রিগুলি কাটিয়েছিলেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রদান করল সাম্মানিক ডিগ্রি। কিন্তু মন তাঁর পড়ে আছে ব্যাবিলনের প্রাচীন নগরে। এর মধ্যে কীভাবে পাহাড়প্রমাণ বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে সব প্রত্নসামগ্রী এসে পৌঁছেছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামে, আবার কীভাবে তিনি ফিরে যাওয়ার রসদ জোগাড় করলেন- সেসব কথা এই অল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়। শুধু উল্লেখ থাকুক, ১৮৪৯ সালের অক্টোবর মাসে তিনি আবার এলেন মোসুলে। তাঁকে পেয়ে আনন্দে ভেসে গেল স্থানীয় আরবরা।
এবার তাঁর গন্তব্য মোসুলের একেবারে কাছে, টাইগ্রিস নদীর বিপরীত দিকে কিউয়ুনজিক বা নিনেতে-র পাহাড়ে। শুরু হল খননকার্য। সেখানে প্রথমেই পাওয়া গেল দুটো হলঘরের হদিশ। সেখানে ঢোকামাত্রই দেখা গেল সমস্ত মেঝে বোঝাই হয়ে আছে ন-ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চি বর্গাকার পোড়ামাটির ফলকে। তার ওপর নানা কিছু লেখা কিউনিফর্ম লিপিতে। সেয়ার্ডের মনে হল তিনি বোধহয় ঢুকে পড়েছেন আসিরীয় রাজার রেকর্ড রুমে। সেখান থেকে এরকম ২৬ হাজার ফলক তিনি উদ্ধার করলেন। পৃথিবীর আদিতম লেখালিখির নমুনা হাতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন তিনি। পাঠিয়ে দিলেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পাঠোদ্ধারের জন্য। প্রায় দু’-মাইল খনন করে ৭১টি হলঘর তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন, যার দেওয়ালে ছিল মহান আসিরীয় রাজাদের যুদ্ধবিগ্রহের খবর, দৈত্যকার ডানাওয়ালা ষাঁড়, আর সিংহ, আর অজস্র উৎকীর্ণ লিপিতে পূর্ণ বিরাট এক লাইব্রেরি। আসিরীয় সভ্যতার এক একটি পৃষ্ঠা খুলে গেল বর্তমান পৃথিবীর কাছে। ১৮৫১ সালের জুলাই মাসে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে তিনি ফিরে আসেন নিজের দেশে।
নিমরুদ আর নিমেভে-র এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন একাধিক বই, ঐতিহাসিক গুরুত্বর কথা মাথায় রেখেও বলা যায় যে, এসব বই ভ্রমণ সাহিত্য হিসাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্ভারের মধ্যেই স্থান পাবে। মাত্র দশ বছর আগে উগ্র ধর্মীয় আগ্রাসনে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে প্রাচীন সভ্যতার এই অভাবনীয় স্থানটি, শুধু রয়ে গেল ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা প্রত্নসামগ্রী আর অস্টেন হেনরি লেয়ার্ডের এই সাক্ষ্য।
লেয়ার্ডের কবিবন্ধু ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডরের কবিতার অংশ দিয়ে শেষ করি –
My song shall rise
Although none heed or hear it;
rise it shall
And swell along the wastee of Nineveh
And Babylon, until it reaches to thee,
Layard, who rissest cities from dust
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.