জগজিৎ সিং মানেই গজল। আর, সুরে বিষণ্ণতার লহরী। অমন হৃদয়বিদারক কণ্ঠ না ইহজগতে আর কারও ছিল, না আর কোনও দিন হবে! ভালবাসা, প্রেমিকা, সুরা, রাত্রি ইত্যাদি পেরিয়ে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা, সামাজিক প্রতিকূলতা, ধার্মিক কটাক্ষ বা রাজনৈতিক বিদ্রুপও যে গজলের ভাষ্য হতে পারে, তা উঠে আসে তাঁর একাধিক কম্পোজিশনে। সাতের দশকে গজলে ফিউশনও আসে তাঁর হাত ধরেই। ১০ অক্টোবর ছিল ওঁর মৃত্যুদিন। লিখছেন অগ্নিভ চক্রবর্তী।
দর্দ সে মেরা দামন ভর দে ইয়া আল্লা
ফির চাহে দিওয়ানা কর দে ইয়া আল্লা।
ভারতীয় গজল সংগীতে ‘দর্দ ভরি আওয়াজ’-এর সমার্থক নিঃসন্দেহে জগজিৎ সিং। অমন হৃদয়বিদারক কণ্ঠ না ইহজগতে আর কারও ছিল, না আর কোনও দিন হবে! অনেক প্রখ্যাত গজল সংগীতশিল্পীকেই এই দেশ পেয়েছে। তবে তঁার গজলের প্রতি যে অভিনব ‘approach’ বা নিজস্ব যে ‘unconventional style’ তা অন্যদের মধ্যে অমিল। এক-একটি ‘নজম’ বা গজল তঁার প্রাণজুড়ানো ব্যারিটোনে যখন নিখুঁত সুর পেত, কবির কলমেও বুঝি প্রাণসঞ্চার হত। একা হাতে বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকার পাতা ঘেঁটে খুঁজে বের করতেন কবি-শায়েরদের লেখা। অনুমতি নিতেন তঁাদের থেকে। তারপর সযত্নে সুর করে, রেকর্ডিং করতেন সেসব গান।
এমনভাবে কত সাধারণ লেখা কালজয়ী হয়ে গিয়েছে তাঁর ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠের মহিমায়! কত স্বল্প পরিচিত, অখ্যাত কবি প্রচারের আলো দেখেছেন জগজিৎ সিং তাঁর লেখা গজল গেয়েছেন বলে। ভালবাসা, প্রেমিকা, সুরা, রাত্রি ইত্যাদির বাইরে গিয়ে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা, সামাজিক প্রতিকূলতা, ধার্মিক কটাক্ষ বা রাজনৈতিক বিদ্রুপ জাতীয় বিষয়ও যে গজলের ভাষ্য হতে পারে, তা উঠে এসেছিল তাঁর একাধিক কম্পোজিশনে। সাতের দশকে গজলে ফিউশনও আসে তাঁর হাত ধরেই।
সংগীত যদি জীবনের প্রথম প্রেম হয়, তবে ‘রেসিং’ ছিল তাঁর জীবনের দ্বিতীয় প্রেম। ঘোড়দৌড় ভীষণ ভালবাসতেন। নিয়মিত ‘রেস’ খেলতেন। নিজের কাছেই আট-দশটি ঘোড়া ছিল। মুম্বইতে সেসব ঘোড়া ছুটত শীতকালে, বর্ষায় পুনেতে আর গরমকালে আবার বেঙ্গালুরুতে। শুধু এ-দেশেই নয়, বিদেশে গেলেও ‘রেসিং’-এর নেশাটা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত। ১৯৮৫ সাল নাগাদ, তখন তাঁর আসন্ন ‘আ সাউন্ড অ্যাফেয়ার’ অ্যালবামের রেকর্ডিংয়ের কাজ চলছে। এমন সময় গলার আওয়াজ বসে গেল জগজিৎজির। কারণ, তাঁর ঘোড়দৌড়ের প্রতি উন্মাদনা। রেসিং নিয়ে তিনি রীতিমতো মেতে সে-সময়। তাঁর ঘোড়া লিড নিয়ে রেস জিতে গেল, আর তখন তাঁর উচ্ছ্বাস দেখে কে!
বাঁধভাঙা আনন্দে ভীষণ চিৎকার করে জয় উদ্যাপন করে পরদিন খেয়াল করলেন তঁার গলার স্বর-ই উধাও! এরপর চার মাস লেগেছিল জগজিৎজির নিজের গানের গলা ফিরে পেতে! এমনই ছেলেমানুষি ছিল নিজের শখের প্রতি। সিরিয়াস গানের ফাঁকে মজার চুটকি বা জোক্স বলে শ্রোতাদের মন মাতিয়ে দেওয়াও ছিল ওঁর লাইভ কনসার্টের বিশেষ অংশ। ভাবতে অবাক লাগলেও এমন প্রাণখোলা, হাসি-ঠাট্টা প্রিয় মানুষটির শেষ জীবন কিন্তু ছিল যথেষ্ট বিরহের।
শুধুমাত্র এ-দেশের ‘গজল-সম্রাট’ বললে অর্ধেক বলা হয়, তিনি একই সঙ্গে ‘বিরহ-সম্রাট’ও। শুধু তাঁর অদ্বিতীয় গায়নশৈলীর জোরে তিনি পারতেন শ্রোতার হৃদয়ে বিরহ গেঁথে দিতে। ‘কৌন আয়েগা ইহাঁ’, ‘তেরি খুশবু মেঁ বসে খত’, ‘আপনি আখোঁ কে সমন্দর মে’, ‘ঘম কা খাজানা’, ‘বে সবব বাত’, ‘হাত ছুটে ভি’, ‘উও রুলা কর হাস না পায়া’– এমন প্রতিটি গানে তঁার স্বকীয় ব্যাকুলতা ছত্রে-ছত্রে ফুটে উঠেছে। অমন করুণ সুরের কম্পোজিশন, আর তঁার ব্যারিটোনের জাদু চোখে যে-জল আনে, তা প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব না। দুঃখ যেন তঁার কণ্ঠে নতুনভাবে প্রকাশের ভাষা পেয়েছে। সুরের ভাষায় শ্রোতার অন্তরের অন্তস্থলে কীভাবে ছুরিকাঘাত করতে হয়, সে-জাদু অনায়াস রপ্ত করেছিলেন তিনি। ভরা অডিটোরিয়ামে অঝোর ধারায় ভাসত শ্রোতাদের চোখ শুধু তাঁর গায়কীর জাদুতে। যখন তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘এক আহ্ ভরি হোগি/ হামনে না শুনি হোগি/ যাতে যাতে তুমনে আওয়াজ তো দি হোগি…’ তখন আপনজন বিয়োগের বিরহ কয়েক গুণ হয়ে মন ভারাক্রান্ত করবেই। তাই তাঁর রোম্যান্টিক গানের চেয়েও বিরহের গজল আরও বেশি করে সংগীতপ্রেমীদের ভালবাসা কুড়িয়েছে।
ফিল্মি গানে গজলের অমন সাবলীল ব্যবহার তাঁর আগে কেউ করেছেন বলে মনে পড়ে না। আটের দশকে মূলধারার গানে গজলের যে-জোয়ার এসেছিল, তার পথিকৃৎ যে এই জগমোহন সিং ধীমান তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পরপর ১৯৮১ এবং ’৮২ সালের তিনটি ছবি ‘প্রেম গীত’, ‘আর্থ’ ও ‘সাথ সাথ’ মিলিয়ে প্রায় একডজন গান সুপারহিট। কাইফি আজমি,
জাভেদ আখতার, কুলদীপ বা ইন্দিভারের লেখায় গানগুলো অধিকাংশই গজলধর্মী। অমন জলদগম্ভীর স্বরে যখন ‘তু আপনি দিল কি জবাঁ ধড়কনো কো গিন কে বতা…’ ধরেন, তখন প্রেমিক-হৃদয়ের চঞ্চলতা ধরা দেয় তাঁর ‘ধড়কনো’ শব্দ উচ্চারণে সামান্য জোড় দেওয়ায়। কিংবা ‘হাম লবোঁ সে কেহ্ না পায়ে উনসে হালে দিল কভি’-র পরের লাইনে ‘অউর ওহ সমঝে নেহি ইয়ে খামোশি ক্যায়া চিজ হ্যায়…’ গাওয়ার সময় ‘খামোশি’ শব্দের উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে সামান্য সময়ের জন্য যখন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক থেমে যায়, তখন ওই শূন্যতা– ‘খামোশি’ শব্দটিকে– অপূর্বভাবে জাস্টিফাই করে। এমনকী, এই দশকের শুরুর দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত
‘তুম বিন’ ছবির ‘কোই ফরিয়াদ’-ও ওঁর কণ্ঠে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
অন্যদিকে, ১৯৭৯ সালের সঞ্জীব কুমার, শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে ব্যবহৃত গান ‘বাত নিকলেগি তো ফির…’ তৈরির নেপথ্য কাহিনিটিও বেশ মজার। কোনও লেখা তঁার মন ছুঁয়ে গেলে, তা নিয়ে কীরকম নাছোড়বান্দা হতে পারতেন, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এ গল্প। ‘বাত নিকলেগি তো ফির…’ মূল নজমটি এককালে ‘শমা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে, তা নজরে আসে জগজিৎজির। তখন সংগীত পরিচালক রূপে একটি অ্যালবাম করছিলেন তিনি। ভূপিন্দর সিংয়ের কণ্ঠে তখন এই গান রেকর্ড হয়। কিন্তু সেই অ্যালবামের কাজ মাঝপথে আটকে গেলে গানটি আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বেহতি হ্যায়’-খ্যাত ছবির লেখক অর্জুন দেব রক্ষা-র আগামী ছবি ‘সাশা’-র জন্য ফের রেকর্ড করা হয় গানটি। সেই ছবিও দুর্ভাগ্যবশত মুক্তি পায়নি। শেষমেশ এইচএমভি থেকে ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত এল পি ‘দ্য আনফরগেটেব্ল’-এ স্থান পায় এই অনবদ্য নজমটি। এমন কঠিন নজমের এত সাবলীল গায়কী ও সুরারোপ এক অদ্ভুত আশ্চর্যের নিদর্শন।
পাঞ্জাবে সংগীতশিল্পীকে বাহবা দেওয়ার মূলত দু’টি অদ্ভুত রকমের রেওয়াজ আছে। যঁারা সর্দার, তাঁরা তারস্বরে ‘যো বোলে সো নিহাল…’ বলে সাবাশি দিয়ে থাকেন, কিংবা শিল্পীকে টাকার নোট দিয়ে বাহবা দেন। ১৯৫৬ সালে জগজিৎজি তাঁর জন্মস্থান শ্রীগঙ্গানগরেই প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বাহবা কুড়োন। ‘কি তেরা অ্যায়তবার’ গানটি করে শ্রোতাদের থেকে পান ১৫৬ টাকা। সেই প্রথম পেয়েছিলেন সাফল্যের স্বাদ, করতালি। কিশোরকুমারের যেমন সায়গল, তেমনই মহম্মদ রফিকে ‘আইডল’ মেনে চলতেন জগজিৎজি। কলেজের অনুষ্ঠানে প্রায় চার হাজার শ্রোতার সামনে ‘প্যয়াসা’-র ‘ইয়ে দুনিয়া আগর মিল ভি যায়ে তো ক্যয়া হ্যায়’ শুনিয়েও ছিলেন। ঘনিষ্ঠদের মতে, জগজিৎজি ছিলেন সেই সময়কার “India’s most recognizable salable rockstar!” লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তাঁর অ্যালবাম ‘সজদা’
সে-বছর বিক্রির সংখ্যা ৪ লক্ষ ছাড়িয়েছিল।
যা ১৯৯১ সালের নন-ফিল্মি তালিকায় ‘বেস্টসেলার’। মোট ১৬টি গানের সংকলন এই অ্যালবামের প্রথম গান ‘দর্দ সে মেরা দামন ভর দে’-তে সুরারোপ করেন জগজিৎজি স্বয়ং।
সংগীত-জীবনের একদম শুরুর দিকে ব্রিটানিয়া কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার দেবুপ্রসাদ দত্তর স্ত্রী চিত্রা সোমের সঙ্গে আলাপ হয় জগজিৎজির। তখন সবে কিছু প্লেব্যাকের সুযোগ আসতে শুরু করেছে তাঁর কাছে। কেরিয়ারের বেশ একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। চাকরির পাশাপাশি রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগ– শখের বিষয় ছিল দেবু দত্তর। নিজের বাড়ির বৈঠকখানায় আস্ত ফোর চ্যানেল রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল। তঁার হাত ধরেই প্রথম বিজ্ঞাপনী জিঙ্গল রেকর্ড করেন চিত্রা। পরবর্তীকালে ‘জিঙ্গল কুইন’ নামে খ্যাতও হন তিনি। জগজিৎ সিংকেও তথাকথিত ‘প্রথম ব্রেক’ দেন দেবু দত্তই। সেটা ১৯৬৭ সাল। তখন দেবু-চিত্রা’র একমাত্র কন্যা মণিকার বয়স আট। পরের বছর দম্পতির পারস্পরিক মনোমালিন্যের কারণে মনিকাকে নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন চিত্রা। ’৬৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাঁদের। এই ঘটনার অনেক আগেই একাধিকবার চিত্রার কাছে বিবাহের প্রস্তাব রাখেন জগজিৎজি। সম্মত হননি চিত্রা। বিচ্ছেদের পর ফের যখন প্রস্তাব রাখলেন, তখন আর চিত্রা না করেননি।
গুরুজনের আশীর্বাদ প্রয়োজন বলে অনুমতি নেন দত্তবাবুর কাছ থেকেও। এমনই ছেলেমানুষসুলভ সরল মন ছিল মানুষটার। সেবছরই মিনিট দুয়েকের এক ছোট্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন জগজিৎ-চিত্রা। মণিকার কাস্টডিও তখন মায়ের কাছেই। এরপর এক অদ্ভূত সংগীতসাধনায় ডুব দিলেন দুজনে। ভারতীয় সংগীত পেল এক অনন্য জুটিকে। এরই মধ্যে তাঁদের জীবনে এলো ‘বাবু’। জগজিৎ-চিত্রার পুত্র বিবেক পৃথিবীর আলো দেখল ২০ আগস্ট, ১৯৭০। অন্যদিকে ‘দ্য আনফরগেটেবল্স’ দিয়ে শুরু এই সুপারহিট জুটির যাত্রা একে-একে ‘আ মাইলস্টোন’ (১৯৮০), ‘দ্য লেটেস্ট’ (১৯৮২), ‘একস্ট্যাসিস’-এর (১৯৮৪) মতো অনবদ্য সব অ্যালবাম উপহার দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। প্লেব্যাক, লাইভ কনসার্ট থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত রেকর্ড– সব ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় হতে থাকল জগজিৎ-চিত্রা জুটি। তাঁদের যুগলবন্দিতে জন্ম নিল ‘সির্ফ শবনম হি শানে’, ‘দুনিয়া জিসে কেহতে হ্যায়’, ‘আয়ে হ্যায় সমঝানে লোগ’, ‘উস মোর সে শুরু করেঁ ফির ইয়ে জিন্দগি’, ‘কিয়া থা প্যার জিসে’, ‘দিল এ নাদান তুঝে হুয়া’, ‘বহোত পেহলে সে উন কদমোঁ’র মতো একের পর এক অনন্য মাইলস্টোন।
১৯৯০, ২৮ জুলাই। সে-রাতে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জগজিৎজি। সেখানে তঁাকে অভিনেত্রী অঞ্জু মাহেন্দ্রু অনুরোধ করেন ‘দর্দ সে মেরা দামন ভর দে’ গানটি গাইতে। গান গাওয়ার মুডে ছিলেন না, তবুও উপস্থিত সকলের অনুরোধ ফেলতে না-পেরে তিনি গানটি ধরেন। গাইতে গিয়ে সংগীতে বিভোর জগজিৎজির দু’-চোখ ভেসে যাচ্ছিল অশ্রুধারায়। গানের শেষ দু’টি লাইন ছিল– ‘ইয়া ধরতি কে জখমো পর মরহম রখ দে/ ইয়া মেরা দিল পত্থর কর দে ইয়া আল্লা’। স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁর জীবনের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনার খোঁজ তিনি শীঘ্রই পেতে চলেছেন। অনুষ্ঠান শেষই হতে চলেছে– এমন সময় এল সেই খবর। লন্ডনে পথ দুর্ঘটনায় প্রয়াত জগজিৎ-চিত্রা পুত্র বিবেক সিং! পুত্রের শেষযাত্রায় পরিচিতদের তিনি বলেন, “সে রাত্রে ভগবান সত্যিই আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। অওর মেরা দামন দর্দ সে ভর দিয়া…’।
চিত্রা সিং তাঁর মাত্র কুড়ি বছরের সন্তানের এমন আচমকা মৃত্যু সইতে পারেননি। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে গান গাওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দেন। জগজিৎজি সংগীতে ডুবে গিয়েই নিজে সামলে ওঠার চেষ্টা করেন। এই ‘শক’ কাটিয়ে সংগীতে ফিরতে তাঁর প্রায় মাস ছয়েক লেগেছিল। তখন গিয়ে ফের কনসার্ট শুরু করেন। তবু পুত্রবিয়োগের শোক জীবনেও সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
তিনি কনসার্টে ফিরলেন ঠিকই, তবে শ্রোতারা পেলেন এক আহত পিতা, এক অন্য শিল্পীকে। তাঁর গানে ধরা দিল পুত্রশোকে কাতর এক অপরিচিত জগজিৎ সিং। মাস ছয়েক পর, ছেলেকে উৎসর্গ করে, একটি অ্যালবাম প্রকাশ করতে সম্মত হলেন। এইচএমভি থেকে থেকে প্রকাশিত সেই ‘সামওয়ান সামহোয়্যার’ অ্যালবামের প্রচ্ছদে পুত্রের ছবি ছাড়া আর কিছু রাখতে চাননি তিনি। কিন্তু জীবনের কষ্ট কি এখানেই পিছু ছেড়েছিল তঁার? না।
২০০৯ সালে আত্মহত্যা করলেন কন্যা মণিকা। ফের ভেঙে পড়েন শিল্পীযুগল। দুই পুত্র আরমান ও উমেরকে রেখে মণিকার হঠাৎই আত্মঘাতী হওয়া যথেষ্ট আহত করে জগজিৎজিকে। যাঁকে কন্যাসম ভালবাসায় বড় করে তুলেছিলেন তিনি। মনের পাশাপাশি এমন সব গুরুতর ধাক্কার প্রভাব পড়েছিল তার শরীরেও। একাধিক অসুস্থতা জড়িয়ে ধরে তাঁকে। তার মধ্যেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন অনুষ্ঠানও। ২০১১-তে তাঁর ৭০তম জন্মদিনে সিদ্ধান্ত নেন এবার বছর জুড়ে মোট ৭০টি কনসার্ট করবেন। ইংল্যান্ড সফরের পরে গুলাম আলির সঙ্গে রীতিমতো মুম্বইয়ে তাঁর অনুষ্ঠানও করার কথা ছিল।
২১ সেপ্টেম্বর রাতে গুলাম আলির সঙ্গে প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানটি বাতিল করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায় স্ট্রোক হয়ে লীলাবতী হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে তাঁকে। ঘণ্টা দেড়েক আগেই বন্ধু জসবীর সিংকে বলেছিলেন, ‘এবার আমি বাকি জীবনটা খোলা হাওয়ায় বাঁচতে চাই’। ১৮ দিন হাসপাতালে কোমায় কাটাতে কাটাতে লড়াই চালিয়ে যান মনের দিক থেকে ক্ষতবিক্ষত ভারতীয় গজলের অদ্বিতীয় সম্রাট। কন্যাবিয়োগের পর আর মাত্র দুটো বছর বঁাচতে পেরেছিলেন। ১০ অক্টোবর আশ্বিনের শারদপ্রাতে ৮টা দশ নাগাদ প্রয়াত হন জগজিৎ সিং।
অশীতিপর চিত্রা এখন যেখানে থাকেন– সেখানে আর কোনও সুর বাজে না। যে-কষ্ট, শোক জগজিৎ পেয়েছিলেন, তিনি সয়েছেন তারও বেশি। তাঁর নিঃসঙ্গতার সঙ্গী দুই নাতি, আরমান ও উমের, একাকিত্ব আর জগজিৎজির সুর ও স্বর। যে প্রাণখোলা, হাসি-ঠাট্টা প্রিয় মানুষটির হৃদয়-নিংড়ানো স্বর, গায়কিতে মাতোয়ারা কোটি কোটি শ্রোতা, তাঁর ব্যক্তিজীবনের বিরহ হার মানায় ওঁর বিরহগাঁথা স্বকীয় কণ্ঠশৈলীকেও।
তুমহে ঢুঁঢ রাহা হ্যায় প্যার
হাম ক্যায়সে করে ইকরার
কে হাঁ তুম চলে গয়ে…
তথ্যঋণ: Baat Niklegi Toh Phir: Sathya Saran
Kagaz Ki Kashti documentary
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.