রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: অনেক দূরের সময়। বহু দূরের দেশ। রাত নেমেছে নরওয়ের গ্রামে। ভয়ংকর শীতল রাত। কোথাও কি আছে প্রাণের চিহ্ন এই বিপুল বিস্তৃত শৈত্যের মধ্যে? আছে, এখানেও আছে প্রাণ। দূরে অন্ধকারের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জ্বলছে মশালের আগুন। যে-আগুন জানাচ্ছে এই শীতার্ত অনিশ্চিত অন্ধকারের মধ্যে মানুষের বসবাস, বাড়ি, আশ্রয়, আহ্বান, আশ্বাস, উষ্ণতা! এসব কিছু বোঝায় ওই জ্বলন্ত মশাল। যার নরওয়েজিয়ান নাম, ‘Brandr’।
কিছু দিনের মধ্যে, মধ্যযুগের ইংরেজিতে, যখন হয়তো ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার লিখছেন তাঁর ‘দ্য ক্যান্টেরবারি টেলস্’, তারই কাছাকাছি সময়ে, ‘brandr’ শব্দটা শেষ ‘আর’-টাকে ঝেড়ে ফেলে ‘brand’ হয়ে ঢুকে পড়ল ইংরেজি ভাষায়, বোঝাতে ‘নিশানার আলো’ বা টর্চ এবং পরিচয়ের ‘ছাপ’। কেমন পরিচয়? কোন পরিচয়? গায়ের পোড়া দাগ, যে-চিহ্ন থেকে বোঝা যাবে গ্রামের গরু-বাছুর, মোষ-ঘোড়া, গাধা-ভেড়া-শুয়োর, যাদের এককথায় বলা হয় ‘ক্যাটল’ বা গবাদি পশু, তাদের মালিক কারা। এদের গায়ে এক-এক মালিকের এক-একরকম পোড়ানো দাগ বা ‘ব্র্যান্ড’।
একটি প্রশ্ন জাগছে মনে: কৃষ্ণর ঠিক কত গরু ছিল? অন্য রাখালদেরও গরু ছিল। সবাই একসঙ্গে বেরত গরু চরাতে। যে-যার গরু আলাদা করত কীভাবে? বাঁশির ডাকে গরুরাই কি চিনে নিত নিজেদের মালিকদের? গরুর গায়ে আগুনের পোড়া দাগের কোনও সংস্কৃত আছে কি?
তবে প্রাচীনকালে ভারতে অপরাধীদের চিরকালের জন্য দাগিয়ে দেওয়া হত তপ্ত লোহার চিহ্ন গায়ে এঁকে দিয়ে। এবং সেই ব্র্যান্ডের নাম, কলঙ্কচিহ্ন। গৌরবের কোনও ‘ব্র্যান্ড’ ভারত তখনও ভাবতে পারেনি। ভেবেছে অনেক পরে। গৌরবের ‘ব্র্যান্ড’ বা প্রতীকী চিহ্নগুলি জন্মাল ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, নেদারল্যান্ডস, উত্তর জার্মানিতে। আমেরিকায় এবং সারা বিশ্বে আরও পরে। এবং ক্রমাগত বদলাতে লাগল ব্র্যান্ডের অর্থ, মূল্য, মানুষের মনের উপর তার অধিকার এবং আচ্ছন্নতার প্রভাব। পরিবর্তিত হতে লাগল পণ্যের বাজারে ব্র্যান্ডের পরিসর, প্রসার, প্রতাপ। ব্র্যান্ড জন্মেছিল বটে ‘মার্ক অফ আ প্রোডাক্ট’ হয়ে। কিন্তু ব্র্যান্ডের নিজস্ব পরিচিতি, খ্যাতি, সম্মান, সভ্যতা ও মূল্যবোধের সঙ্গে তার প্রসারিত সম্পর্ক, এবং ব্র্যান্ডের ‘ইমোশানাল কানেকশন’ বা আবেগের সম্পৃক্তি– এসব কিছুর উপর গবেষণা, আলোচনা ও গ্রন্থ প্রকাশের ফলে ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠল সারা বিশ্বব্যাপী এক নতুন আলোড়ন, উদ্ভাস এবং অবিশ্বাসী প্রভাব। পুজোর কলকাতার দিকে তাকিয়ে দেখুন। শহরের মুখ বলতে এখন শুধু ব্র্যান্ডের বাদ্যি! ব্র্যান্ডের প্রচার ও প্রাবল্য। ব্র্যান্ডের বিহ্বল বিতরণ ও আরাত্রিক।
তবে এটাও ঠিক, প্রায় প্রতিটি ব্র্যান্ডের সৃজন ও সাফল্যের নেপথ্যে আছে এক-এক অসাধারণ মানুষের অসামান্য অবদান ও শ্রম। এবং প্রতিটি ব্র্যান্ডের আছে তার নিজস্ব রূপকথা। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হয়, ব্র্যান্ডের রূপকথা, রূপকুমার এবং রূপকুমারীদের নিয়ে একটি আস্ত বই লিখতে। অথচ আমি জন্মেছিলাম এক প্রায় ব্র্যান্ডহীন ব্রিটিশ কলকাতায়। পুজোর পোশাকের জন্য তখন বাড়িতে দর্জি এসে মাপ নিত। আর বাজার থেকে ব্র্যান্ডহীন ছিট কেনা হত। তবে হ্যাঁ, ব্র্যান্ড বলতে ‘পলসন’ বাটার খেয়েছি, হুডখোলা ‘অস্টিন’ গাড়িতে চলেছি, “ফারপো’জ”-এর কেকের গন্ধ শুঁকেছি। অনেক পরে ঠোঁটে পেয়েছি ‘চারমিনার’ সিগারেট, জিভে পেয়েছি ‘ওল্ড মঙ্ক’ রাম। আমার চোখের সামনে জন্মেছে উত্তমকুমারের স্পেশাল ‘U’-কাট ব্র্যান্ড। চোখের সামনে বসন্ত চৌধুরী ফিরিয়ে এনেছেন বাঙালির ধুতি-শালের মহার্ঘ মর্যাদা। আর কাননদেবীর ‘প্রায়’ স্লিভলেস টপকে সুচিত্রা সেন নিয়ে এলেন ‘প্রায় কলার-তোলা’ ব্লাউজ– এসব ঘটেছে। এবং তারপর হালের ব্র্যান্ড-প্লাবনে ভেসে-যাওয়া বাঙালি, তাও দেখছি।
ব্র্যান্ড ছাড়া এদের মুখে কথা নেই। নিজের নাম, নিজের পদবি, নিজের পরিবার, নিজের পরিচয়, এসবের কোনও বালাই নেই যেন! নিজের মন, রুচি, ভাবনা, কান্তিবোধ– সব ভেসে গিয়েছে ব্র্যান্ডের তোড়ে। এখনকার বাঙালি, যার যেমন পরিচিতি, স্বপ্নের তাড়না বা ট্যাঁকের জোর, তার তেমন চাহনি-বিন্যাস– কব্জির ঘড়িতে, গ্যারেজের গাড়িতে, আবাসনের নামে, শার্টের বুকপকেট বা কলারে, পায়ের জুতোয়, সেলফোন এবং ল্যাপটপের লোগোয়, কলমের মাথায় বা গায়ে– এমন ব্র্যান্ডবহ্নিত বাঙালি আমার যৌবনে দেখিনি, যেমন দেখছি বিদায়বেলায়। ক’দিন আগেই এক বাঙালির সঙ্গে দেখা হল, যাঁর চশমা এসি গাড়ি থেকে বেরিয়েও ঝাপসা হয় না। সত্যিই চমক লাগানো তাঁর ব্র্যান্ডেড দৃষ্টিদ্যুতি!
এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল কয়েকটি বাঙালির কথা, যাঁরা কোনও বাজারি ব্র্যান্ডের তোয়াক্কা না করে, তৈরি করেছিলেন নিজেদের ব্র্যান্ড। প্রথমেই মনে পড়ে রাজা রামমোহন রায়ের কথা। ইংল্যান্ডেও স্যুট-বো-টাই পরেননি তিনি। পরতেন তাঁর নিজস্ব স্টাইলের পাগড়ি ও পোশাক। রামমোহনকে আমরা অন্য পোশাকে ভাবতেও পারি না। বঙ্কিমচন্দ্রর ফ্যাশন স্টেটমেন্ট ভাবুন! সম্পূর্ণ নিজস্ব। নিজের ব্র্যান্ড, নিজে তৈরি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ছবিটি ভাবলেই ফুটে ওঠে তাঁর ঢিলে আলখাল্লা ঢাকা মূর্তি। তবে অন্তত ছ’-ফুট দুই-তিন না হলে, আর রবীন্দ্রনাথের মতো সবদিক থেকেই তুল্য বরণীয় না হলে ওই পোশাক কাকের ময়ূরপুচ্ছ ধারণ হবে। আমার চোখে শ্রেষ্ঠ বঙ্গ-ব্র্যান্ডের সৃজনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ফতুয়া। ধুতি। চাদর। আর পায়ে শুঁড়ওয়ালা বিদ্যাসাগর-চটি।
‘ব্র্যান্ড’ প্রসঙ্গে আর-এক অনন্য মানুষের কথা মনে পড়ে গেল সবশেষে। মার্লন ব্র্যান্ডো। নামের মধে্য সচেতন সযত্নে রক্ষা করেছেন তিনি ‘ব্র্যান্ডো’ শব্দটিকে, ব্যাক্তিগত নামের ‘জার্মানিক’ অর্থে– যে-অর্থ হল, ‘তরোয়াল’। আর কোনও পরিচয় বা ব্র্যান্ড-চিহ্নের প্রয়োজন আছে কি তাঁর, যাঁর নাম ধারে কাটে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.