Advertisement
Advertisement
Tax

ফেলো কড়ি দাও কর

হলিডে হোমে ডালভাত রেঁধে খেলে কে-কার উপর ট্যাক্স চাপাচ্ছে?

History of India's Tax system
Published by: Amit Kumar Das
  • Posted:September 27, 2025 8:02 pm
  • Updated:September 27, 2025 8:02 pm   

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়: সাবেক সেল্‌স ট্যাক্সের আমল থেকেই, উড়ো খই একটা দরকারি বিষয় অবশ্যই। মনে আছে, কিছুকাল আগেই জোরদার তর্ক হয়েছিল, এমনি-এমনি পপকর্ন বিক্রি হলে কোনও ট্যাক্স লাগে না; তবে মশলা মাখিয়ে রঙিন ঠোঙায় ভরে দিলেই জিএসটি যোগ হবে, এমন নিয়ম কেন? থান কাপড়ে ট্যাক্স নেই কোনও। কিন্তু কাঁচি দিয়ে কেটে, যেমন-তেমন একটা রেডিমেড পোশাকের আকার দিলেই– ট্যাক্স!

Advertisement

সে অবশ্য বহুকাল আগের কথা। লোহালক্কড়, মশলাপাতি, অতি বিপজ্জনক বস্তু ছিল এসব; কীভাবে কাটলে, কীসের সঙ্গে কোনটা মেশালে কতটা ট্যাক্স যোগ হওয়া দরকার, তাই নিয়ে উকিল-মোক্তার-মুহুরি আর অফিসারদের নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব। আমজনতা এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি কোনও দিনই। আমরা শুধু জানতাম, সেল্‌স ট্যাক্স একরকম ‘পরোক্ষ কর’, যা আদায় করার দায়িত্ব রাজ্যের হাতে। কে না জানে, পরোক্ষ যা কিছু উৎপাত, তা অন্যের ঘাড়ে চালান করাই বুদ্ধিমানের পদ্ধতি। প্রথম যৌবনে, লিট্‌ল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের ছবির ব্লক বানিয়ে আনতে গিয়ে, ওসব কায়দাকানুন জানা হল। বিল না নিলে, খরচ কিছুটা কমবে। গুরুজনদের দেখাতে বিল কাটলেই ট্যাক্স যোগ হয়ে যাবে। কাগজ কিনতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা। চাপা স্বরে বিক্রেতা বোঝান, বিল দেওয়া-নেওয়ায় কত বাড়তি ঝামেলা, ফালতু খরচ বাড়বে। বৈঠকখানা বাজার কি কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে আমরা যে ভালমন্দ খেয়েদেয়ে ম্যাগাজিনের ফান্ড ভেঙে কিছু করছি না, কে কাকে বোঝাবে? কিছু গুরুজন আবার বলেন– ধুস, ওসব বাজে কথা। লজেন্স, বিস্কুট, সাবান-শ্যাম্পু, দাঁতের মাজন কিনলে বিল দেয় কে? মফস্‌সলের দোকানদারের মুখে শুনেছি, ফুউ… জাঙিয়ার আবার বুকপকেট!

চাঁদনি চক বা নিউ মার্কেট এলাকার বিখ্যাত ভোজনালয়ের বিলে অবশ্য বিক্রয় কর, মানে সেল্‌স ট্যাক্সের কলাম থাকত, দেখেছি। সাড়ে তিন দশক আগের কথা, দিঘার প্রায় সমস্ত হোটেলে, খাবার জায়গায় স্টিকার লাগানো দেখতাম– মুখের গ্রাসে বিক্রয় কর, স্বাধীন দেশের কলঙ্ক। এ-ও সেই আইনের কচলাকচলিমূলক ঝগড়া। রান্না করা খাবারে ট্যাক্স ছিল তখন। কিন্তু সে তো হাইফাই রেস্তোরাঁয় সুখাদ্যের উপর, পকেটে রেস্ত থাকলেই যেখানে ঢোকে লোকজন। হলিডে হোমে ডালভাত রেঁধে খেলে কে-কার উপর ট্যাক্স চাপাচ্ছে?

রেঁধেবেড়ে খেয়ে বেড়াতে যাওয়ার প্রজন্ম অস্তমিত, দিঘায় এখন কতশত বিলাসবহুল হোটেলের বর্ণাঢ্য বিভা; অন্য অনেক ট্যুরিস্ট স্পটেও তাই। অনেক মানুষের পকেটে প্রয়োজনের বেশি পয়সাকড়ি এসেছে, বিলাসব্যসন বেড়েছে। ঠিক এই সামাজিক বাস্তবতা থেকেই বাণিজ্যিক করের নানা পরিবর্তন থেকে কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের বিন্যাসের কথায় যেতে পারি আমরা।

বাণিজ্যিক করের সূচনা এই দেশে, ব্রিটিশ আমলে। ১৯৪১, মহাযুদ্ধের কালে। ১৯৫৪ সালে নতুন আইন আসে। ১৯৫৬ সালে এল ‘সেন্ট্রাল সেল্‌স ট্যাক্স’। রাজ্যই শুধু লাভের গুড় খেয়ে যাবে? কেন্দ্র নেবে না কিছু? অভিজ্ঞজন অবশ্য বলেন, কেন্দ্রই সর্বেসর্বা, তারাই কলকাঠি নাড়ায়। রাজ্যের হাতে আদায় করার মতো আছে দুর্বল কিছু বিষয়– কৃষি আয়কর, বহুতল ভবনের কর, প্রমোদ কর, এসব। সেল্‌স ট্যাক্স, মানে বাণিজ্যিক করেরই বেশি রমরমা, যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান। এ অবশ্য বিগত শতকের সাত কি আটের দশকের ভাবনা।

বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে বেকারভাতা দেওয়ার জন্য বৃত্তি কর চালু করল, যার ডাকনাম ‘প্রফেশন ট্যাক্স’। যে কোনও বৃত্তিধারী কি সংস্থার পকেটে অল্প চাপ দিয়ে কিছু আদায় করে বেকারদের সেবা, অনেকেই বললেন তখন, মন্দ কী? কেউ-কেউ অবশ্য ‘রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা চাই’-এর সুরে গাইলেন, রাজ্য যা-ই আদায় করুক, তা তিন-চারদিনের খোরাক, বড়জোর। কেন্দ্র না দেখলে, রাজ্য দুর্বল হয়েই থাকবে– দিল্লির চোখে রাজ্য সরকারগুলো যে প্রায় পৌরসভার মতো।

এসব টানাপোড়েনের মধ্যেই, গত নয়ের দশকের শুরুতে, সেল্‌স ট্যাক্সের তিনটে আইন একত্র করে একটিই আইন করা হল। তারও এক দশক বাদে, এই শতাব্দীর শুরুতে এল ভ্যাট, মানে ‘ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স’। মনে রাখা দরকার, মনমোহিনী তৎপরতায় এই দেশে যে বিশ্বায়ন এসেছে, দশক পেরিয়ে তাতে গতি এসেছে বেশ। ব্যবসায়ী, আইনজীবী, হিসাবরক্ষক, সকলেই সরলীকরণ চাইছেন। বিশ্বায়নের গুরুত্ব একটা গরিব দেশে ঠিক কতখানি, সে তো অন্যরকম বিতর্ক। ‘উন্নয়নশীল’ না বলে, ‘গরিব দেশ’ বলেই ফেললাম, বিশ্বায়নের গ্যাঁড়াকলে সাম্প্রতিক নানা হাহাকার অনুভব করে। ‘আত্মনির্ভরশীল’ হয়ে ওঠা এখনও অনেক দূরের পথ, জানি না কেউ কাউকে বাদ দিয়ে আগামী দুনিয়ায় বাঁচতে পারবে কি না। জিএসটি ২.০ এল হয়তো এজন্যই। কিন্তু সাধারণ মানুষ এতে উপকৃত হবে কতটুকু? ঘোষণাটি প্রধানমন্ত্রী কেন স্বাধীনতা দিবসেই করলেন, তা নিয়ে অনেকের কৌতূহল। জিএসটি প্রথম চালু হওয়ার সময়, মাঝরাতের টিভিতে কেমন ধামাকা হয়েছিল, মনে আছে? এসব আড়ম্বর নিতান্তই বাহ্যিক। ব্যাপারটা হওয়াতেই হত, ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’র কিছু করার ছিল না তাতে। সমস্তই বিশ্বায়নের নিয়ম মেনে। এককেন্দ্রিক ঝোঁক, এরই অঙ্গ। এক রাজ্য থেকে আর-এক রাজ্যে পণ্য পরিবহণে, চেকপোস্টের উৎপাত কেন থাকবে? যেখানে ইচ্ছা করে সিস্টেম গুলিয়ে দেওয়াই দস্তুর। আট বছর আগেই এসব হয়েছে। এবার ব্যবসায়ী বন্ধুবৃত্তে আর-একটু স্বস্তির বাতাস বইয়ে দেওয়াই কি উদ্দেশ্য? এই দ্যাখো, করের হার নিয়ে বিভ্রান্তি কমিয়ে দিলাম, এবার লাভের গুড় যেটুকু খাওয়ার, খেয়েদেয়ে, মুখ মুছে আমজনতাকে বোঝাও, তোমাদের জন্য আমরা আছি।

পেট্রোল, ডিজেল– এসবে জিএসটি কত, এখনও নির্ধারিত হয়নি। বিশ্বাসের ভিত্তিতে অডিট ব্যবস্থা, সেও যে কত দূর! ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট ব্যবস্থা পরিবর্তনেও সিদ্ধান্ত হয়নি কিছু। আরও বিপজ্জনক কথা বলছে সিএজি রিপোর্ট, দেশের অনেক রাজ্যই খুব খারাপভাবে ঋণ করে চলেছে। আগামী দিনের উন্নয়ন ভেবে নয়, এখনকার দায় মেটাতেই খরচ হচ্ছে সিংহভাগ। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, উন্নতির সুফল পেয়েছে। উপভোক্তা প্রধান রাজ্য বলেই। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন, আর্থিক ঘাটতির সীমা বেঁধেছিল ৩.৫ শতাংশে। বিগত অর্থবর্ষে বারোটি রাজ্য এই সীমালঙ্ঘন করেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য তো বটেই– অসম, বিহার, হিমাচল, এমনকী পাঞ্জাবও রয়েছে সেই দলে। দানধ্যানের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে, কেউ কম যায় না। কৃষকদের ঋণ মকুবে দিলদরিয়া কেউ, কোনও রাজ্যে আবার মহিলাদের বাসে যাতায়াতে টিকিট লাগে না। আমাদের রাজ্যের উন্নয়ন প্রকল্পের সমালোচনায় অনেকেই তৎপর। কিন্তু এই ঝোঁক যে সমস্ত দেশেই প্রকট, এই অবস্থার যে পরিবর্তন দরকার, আমরা ভাবব না?

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ