Advertisement
Advertisement
Hool Day

‘হুল’ দিবসের অধিকার, অর্জন এবং অপ্রাপ্তি

সাঁওতাল বিদ্রোহ ইতিহাসের পাতায় পরিচিত ‘হুল’ নামে।

Hool Day and the Santal rebellion
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:July 8, 2025 5:31 pm
  • Updated:July 8, 2025 5:36 pm  

সাঁওতাল বিদ্রোহ ইতিহাসের পাতায় পরিচিত ‘হুল’ নামে। ‘হুল’-এর বয়স আর উন্নয়নশীল, ক্রমবর্ধমান এই দেশের স্বাধীনতার বয়স ৭৮ প্লাস। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রায় শতাব্দীকাল আগে, যখন উন্নত মানুষের ‘স্বাধীনতা’-র অর্থ অভিধান খুঁজে পায়নি, তখনই ‌‘কালো চামড়া’-র মানুষ বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল। এত দিন তাদের হাতের পেনসিল কী লিখছে? লিখছেন অভিমন্যু মাহাত

Advertisement

৩০ জুন আরও একটি ‘হুল দিবস’ অতিক্রান্ত হল। আরও প্রস্থ ‘উদ্‌যাপন’ হল সমাপ্ত। হাতে পড়ে থাকা পেনসিলের মতো ইতিহাসের সরণি ধরে বিনম্র প্রশ্নটা এই যে, কোথায় বদল হল? আদিবাসীরা না জাতে উঠল, না তাদের পাহাড়-জঙ্গলের অধিকার সুনিশ্চিত হল। নিজের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার, বা নিজস্ব জীবনযাপনের অধিকার– স্বাধীন একটি দেশে পাওয়া কি গেল? যদি না-পাওয়া যায়, তবে ‘স্বাধীনতা’ কাদের, এবং কীসের? স্বাধীনতা কি কেবলই খণ্ড ও ভগ্ন জনাংশের জন্যই বাস্তব? বাকিদের জন্য সেটি কেবলই ছবি ও ছড়া, পতাকা আর ক্রমপতনের অবক্ষয়ের রূপারোপ?

১৭০। ২০২৫ সালে ‘হুল’-এর বয়স। এদিকে উন্নয়নশীল, ক্রমবর্ধমান এই দেশের স্বাধীনতার বয়স ৭৮ প্লাস। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রায় শতাব্দীকাল আগে, যখন উন্নত মানুষের ‘স্বাধীনতা’-র অর্থ অভিধান খুঁজে পায়নি, তখনই ‌‘কালো চামড়া’-র মানুষ বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ‘কালো’ হয়েছিল আরও ‘কালো’।

সাঁওতাল বিদ্রোহ ইতিহাসের পাতায় পরিচিত ‘হুল’ নামে। কিন্তু এখনও অনালোকিত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম তির-ধনুক হাতে রুখে দাঁড়ানো তিলকা মুর্মু। যিনি ‘তিলকা মাঝি’ নামে পরিচিত। বলা ভালো, উপেক্ষিত শালগিরার নায়ক। তিলকা– এ নাম শুনলেই ব্রিটিশ শাসকরা প্রমাদ গুনত। পলাশ ফুলের মতো লাল চোখ দেখে ব্রিটিশ সেনাদের শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত বয়ে যেত। জাতিসত্তার জন্মগত অধিকার ও অরণ্য-জমি রক্ষায় তিনি যে শালগিরার আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তা নজিরবিহীন।

ব্রিটিশদের মদতে তখন ‘দিকু’-রা (বহিরাগতরা) অরণ্য ও জমিতে ‘সোনা’ দেখে ফেলেছে। বুঝেছে, গোটা কয়েক কালোকুলো অশিক্ষিত অসভ্যকে খেদাতে পারলেই স্বর্ণভাণ্ডার এসে পড়বে দখলে। তারা দেদার তখন ঢুকে পড়েছে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়। আর চালাচ্ছে অবাধে জমি লুট আর নিপীড়ন। গর্জে উঠেছিল গ্রামের মাঝি তিলকার কণ্ঠস্বর। যা ছড়িয়ে দিয়েছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিদ্রোহের আগুন।

ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের অকুতোভয় বাণী। যেখানেই সভা করেছেন, সেখানেই শালপাতায় আগ্নেয় কলমে লিখে ছড়িয়ে দিয়েছেন–ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে আদিবাসী ভাষায় স্লোগান। ধামসা বাজিয়ে জড়ো হত কালো চামড়ার মানুষ। দিকে-দিকে তখন আদিবাসীর স্বরে স্বাধীনতা রক্ষার রণভেরি।

তিলকা গড়ে তোলেন অরণ্যযুদ্ধে পটু গেরিলা বাহিনী। ১৭৭৮ সালে সহযোদ্ধাদের নিয়ে হানা দিয়েছিলেন রামগড়ের ব্রিটিশ ক্যাম্প, কোষাগারে। লুটপাটের অর্থ বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিরন্ন, ক্ষুধার্ত আদিবাসী গ্রামগুলিতে। এরপরেই তিলকাকে ‘খতম’ করতে ব্রিটিশ শাসক কোমর কষে।

১৭৮৩ সালে তিলকার নেতৃত্বে শুরু হয় ‘শালগিরা বিদ্রোহ’। প্রচুর সেনা এসে ঘিরে ফেলে সুলতানগঞ্জ ও ভাগলপুর। কিন্তু দমানো যায়নি দ্রোহকে। পাহাড়ের কোলে, গভীর অরণ্য থেকে গেরিলা কায়দায় সেনাদের মোকাবিলা করে তিলকার বাহিনী। ১৭৮৪ সালের জানুয়ারিতে সেনা অভিযানের তদারক করতে গিয়েছিলেন ক্লিভল্যান্ড সাহেব। তিলকার ধনুকে ঝলসে উঠেছিল মারণ বাণ। ক্লিভল্যান্ডের দেহে গেঁথে যায় সেই তির। চিকিৎসার জন্য তঁাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। সাদা চামড়ার শাসকরা সেই ভয়াবহ সাহসের প্রত্যুত্তরে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে।

একদিন শালগিরার নায়ককে ঘিরে ফেলে সেনারা। গুলিবিদ্ধ কালো চামড়া দেহটিকে দড়িতে বেঁধে একটি ঘোড়ার সঙ্গে জুতে দেওয়া হয়। ঘষটাতে-ঘষটাতে নিয়ে যাওয়া হয় ভাগলপুরে। রাস্তায় ছড়িয়ে গিয়েছিল বিদ্রোহীর আগুনে রক্তের বীজ। ততক্ষণে লন্ডনে দেহ রেখেছেন ক্লিভল্যান্ড সাহেব। ক্ষতিপূরণ করতে ব্রিটিশ শাসকের বাংলোর সামনে বটগাছের ডালে শালগিরার সেনাপতিকে ফঁাসিতে ঝোলানো হয়।

তিলকা চলে গেলেও শালগিরার আগুন নেভানো যায়নি। তিলকার রক্তের ধারা থেকে জন্ম দিয়েছিল স্রোতের মতো একের-পর-এক বিদ্রোহ। চুয়াড়, ভিল, চেরো, মুন্ডা, কোল বিদ্রোহ ইতিহাস গড়ে। আর ১৮৫৫ সালে ‘হুল’। ঔপনিবেশিক শাসন, জমিদার ও মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে সিধো মুর্মু, কানহো মুর্মু, চানকু মাহাতরা। ভগনাডিহির মাঠে সিধো, কানহোকে প্রকাশ্যে ফঁাসিতে ঝোলানো হয়েছিল। আর, চানকুকে গোড্ডা জেলার রাজকাছাড়ির কাজিয়া নদীর তীরে ফঁাসি দেওয়া হয়। তারপরেও কালো চামড়ার মানুষ পথেঘাটে, বন্দরে লড়াই করেছে। এসেছে স্বাধীনতা। কিন্তু কালো চামড়ার দ্রোহ উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে।

স্বাধীনতার বয়স ৭৮ বছর। এখন জল-জঙ্গল-জমিনের লড়াই জারি। প্রেক্ষাপট ভিন্ন নয়, শুধু শাসকের মুখোশ বদলে গিয়েছে। আদিবাসীরা এখন শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের ময়দানে এবং তা বাধ্যতামূলক। খনিজ সম্পদের দখল নিতে ক্রমান্বয়ে চলছে আদিবাসী উচ্ছেদ। একের-পর-এক পাহাড়, আদিবাসীদের মারাংবুরু সংস্কৃতির বিচারে নয়, তেজারতির পণ্য রূপে বিবেচিত হচ্ছে। কখনও বেসরকারি সংস্থা, কখনও সরকার নিজেই ‘উন্নয়ন’-এর লোভাতুর ভেরি বাজিয়ে অবাধে ভাঙছে পাহাড়, কাটছে বন। আদিবাসীদের বিরোধিতা এখন ‘মাওবাদী’ তকমা পাচ্ছে।

একদা ব্রিটিশ বলেছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’। এখন সরকার বলছে, বিচ্ছিন্নতাকামী, মাওবাদী। এই বাংলায় এক জমানায় জঙ্গলমহলের দ্রোহ ছিল পুলিশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মহাসংগ্রাম। এখন ছত্তিশগড় আদিবাসীদের বধ্যভূমিতে পরিণত। মাওবাদী দমনের নামে চলছে আদিবাসীদের হত্যালীলা। গত ১৬ মাসে ছত্রিশগড়ে ৪৫০ জনের বেশি মাওবাদী সন্দেহে নিহত। মানবাধিকার সংগঠনগুলির দাবি, নিহত অনেকেই নিরীহ আদিবাসী। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১৯৭ জনকে ‘মাওবাদী’ সন্দেহে খতম করা হয়েছে।

শোনা যাচ্ছে, মহিলাদের যৌন নির্যাতনের পর গুলি করার মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ছত্তিশগড়। এমনকী, শিশুরাও সেখানে অবধ্য নয়। আদতে ছত্রিশগড়ে মাটির নিচে থাকা খনিজ সম্পদের অধিকার চায়– কখনও রাষ্ট্র, কখনও রাষ্ট্রতোষক কর্পোরেটের। বনাধিকার আইন অনুসারে রাষ্ট্র আদিবাসীদের জমি গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া নিতে পারে না। কিন্তু অভিযোগ, সেসবের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। একটি তথ্য বলছে, মে মাসের ‘অপারেশন’-এর পরে বস্তারের ৫১টি জায়গা খনিজ উত্তোলনের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। ৯৩৭ হেক্টর বনভূমি থেকে ১.২৩ লক্ষ গাছ কাটা হবে।

এসব তথ্য ‘মাওবাদ’-এর নামে সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর বিকল্প শক্তিকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে দেওয়া নয়। প্রশ্ন অন্যত্র। রাষ্ট্র, সেই সাবেক থেকে এখনও পর্যন্ত, জল-জঙ্গল-পাহাড়ের আদি বাসিন্দা, আদিবাসীদের কাছে কখনও জানতে চায়নি– তারা আসলে কী চায়। তিলকা মাঝির আন্দোলনকে তো আর ‘মাওবাদ’ বলা যাবে না!

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন– এই যুদ্ধে কেউ জয়ী হয়নি, সবাই পরাজিত। লাখো-কোটি কালো চামড়ার শবরাশির উপরে দাঁড়িয়ে নির্মিত নাগরিক সভ্যতার জয়ডঙ্কা কখনও কি এমনই পরাজয়ের বাণী উচ্চারণ করবে?

[email protected]

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement