Advertisement
Advertisement
Hindi

সরকারি হিন্দি কতগুলি মাতৃভাষার সমষ্টি?

স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও আমরা জানতে পারলাম না প্রকৃত সংখ্যা!

How many mother tongues is official Hindi
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:August 18, 2025 1:46 pm
  • Updated:August 18, 2025 1:55 pm   

১৯৬১-র আদমশুমারিতে প্রধানত ৮টি মাতৃভাষার সমন্বয়ে অষ্টম তফশিলভুক্ত হিন্দি ভাষাকে গঠন করা হয়। কিন্তু এসব মাতৃভাষাও তো আরও অনেক লোকায়ত ‘মাতৃভাষা’ দিয়ে তৈরি। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে ৩৩টি ভাষার সমন্বয়ে ‘সরকারি হিন্দি’ তৈরি বলে দাবি করা হলেও– সংখ্যাটি হওয়া উচিত ২০৪। তাহলে বাকি ১৭১টি ভাষা গেল কোথায়? লিখলেন অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

‘এই সভার মতে বাংলা ভাষার বহুলতর প্রচারের জন্য নিম্নলিখিত ও অন্যান্য উপায় অবলম্বন করা উচিত– ক) বিশেষ প্রয়োজন ভিন্ন বাঙালী মাত্রেরই দৈনন্দিন কার্য ও ব্যবহারে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা কর্তব্য। খ) বাংলা দেশে প্রবাসী অন্য ভাষাভাষী ব্যক্তিগণের সহিত যতদূর সম্ভব বাংলা ভাষায় কথোপকথন ও চিন্তার বিনিময় কর্তব্য। গ) অ-বাঙালির মধ্যে ও বাংলার বাহিরে যাহাতে বঙ্গসাহিত্যের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি হয় তজ্জন্য উপযুক্ত ব্যাবস্থা করা কর্তব্য; যথা– পরীক্ষা গ্রহণ, পুরস্কার বিতরণ, বাংলা সাহিত্য আলোচনার প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও প্রতিযোগিতা নির্ধারণ প্রভৃতি।’ মনে হতেই পারে– এই সভা হয়তো গতকাল আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সভা আয়োজিত হয়েছিল ফাল্গুন ১৩৪৫ (১৯৩৮ সালে)– ৮৭ বছর আগে– বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ভবনে সুপণ্ডিত হীরেন্দ্রনাথ দত্তর সভাপতিত্বে। গৃহীত ৫টি প্রস্তাবের প্রথম প্রস্তাব ছিল এটি। আর, আমরা কী করলাম– হলুদ ট্যাক্সি চেপেই চালককে নির্দেশ দিলাম– ‘হাওড়া যানা হ্যায়, জলদি চলো’।

তা, জলদি-ই চলছে, তবে বাংলা ভাষার ব্যবহার নয়, বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসার নয়, অর্থনীতিতে বাংলা ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্রও নয়– ‘সরকারি হিন্দি’-র আগ্রাসন। যেমন: ১৪/০৯/১৯৪৯ তারিখে ‘হিন্দি ইন দেবনাগরী’ অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ঘোষণার পরই– ১৯৫২ সাল থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে হিন্দি প্রশিক্ষণ আরম্ভ হল– আর তার সঙ্গে পুরস্কার, আগাম ইনক্রিমেন্ট। হিন্দি কাজের বার্ষিক পরিকল্পনা, সেন্ট্রাল ট্রান্সলেশন ব্যুরো, হিন্দি ভাষায় লিখিত বইয়ের জন্য পুরস্কার, হিন্দি দিবস, হিন্দি মাস, অ-হিন্দিভাষী রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনুদান ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা চলতে থাকল। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরে হিন্দি বিভাগ পর্যন্ত খোলা হল। আর, এভাবেই দেশের প্রাত্যহিক অর্থনীতির সঙ্গে হিন্দির প্রচার ও প্রসার জুড়ে দেওয়া হল।
ওদিকে, দেশভাগ-উত্তর পাকিস্তান উর্দুকে ‘জাতীয় ভাষা’ ঘোষণা করার পরে, হিন্দির সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আবেগকেও জুড়ে দেওয়া গেল। স্বাধীনতার পর অনেক বিদ্যালয় উর্দু শেখানো পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। এবার যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে– দেশের বেশিরভাগ মানুষ হিন্দিকেই তাদের নিজেদের মাতৃভাষা বলে স্বীকার করে– এটা প্রমাণ করতে হবে– কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

ঠিক হল– আদমশুমারিকে হাতিয়ার করে এটা করা যেতে পারে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালের প্রথম আদমশুমারিতে নির্দেশ দেওয়া হল– আপনার মাতৃভাষা যদি হিন্দি, হিন্দুস্তানি অথবা উর্দুর মধ্যে যে কোনও একটি হয়, তাহলে আপনাকে ঘোষণা করতে হবে– আপনার মাতৃভাষা ‘হিন্দি’। আর, দ্বিতীয় ভাষার ক্ষেত্রে অন্য কোনও ‘ভারতীয় ভাষা’-কে উল্লেখ করতে হবে অর্থাৎ ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিসাবে ‘ইংরেজি’ ভাষা লেখা যাবে না। ১৯৬১-র আদমশুমারিতে প্রধানত ৮টি মাতৃভাষার (অবধী, ছত্তিশগড়ী, বাঙ্গারু, ব্রজভাষা, বান্দেলখান্ডি, হিন্দি এবং কনৌজী) সমন্বয়ে অষ্টম তফশিলভুক্ত হিন্দি ভাষাকে গঠন করা হল।

কিন্তু এসব ‘মাতৃভাষা’-ও তো আরও অনেক লোকায়ত মাতৃভাষার সমন্বয়ে গঠিত। যেমন: অবধী ১৬টি মাতৃভাষা, ছত্তিশগড়ী ১৬টি মাতৃভাষা, বাঙ্গারু ৪টি মাতৃভাষা, ব্রজভাষা ৫টি, বান্দেলখান্ডি ১২টি এবং হিন্দি ৪৩টি মাতৃভাষা নিয়ে গঠিত। অর্থাৎ ১৯৬১ সালের ‘সরকারি হিন্দি’ গঠিত হল প্রধানত ১৬+১৬+৪+৫+১২+৪৩+ কনৌজী– মোট ৯৭টি মাতৃভাষা নিয়ে। পরে এর সঙ্গে ৩৪টি মাতৃভাষা নিয়ে বিহারি, ৭৩টি মাতৃভাষা নিয়ে রাজস্থানি ও অন্যান্য ভাষাও যুক্ত হবে।

প্রশ্ন: তা-ই যদি হবে তাহলে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে কেন হিন্দির সঙ্গে আরও ৫৫টি ভাষা যুক্ত করে মোট ৫৬টি ভাষার নাম পাই? অনেক বেশিসংখ্যক ভাষার উল্লেখ থাকার কথা! তার কারণ, বিহারি ভাষার মাত্র ৮টি মাতৃভাষা, অবধীর ৩টি মাতৃভাষা, ছত্রিশগড়ীর ৩টি, বাঙ্গারুর ১টি, ব্রজভাষার ১টি, বান্দেলখান্ডির ২টি, হিন্দির ২টি এবং রাজস্থানির ১৩টি– মোট ৩৩টি মাতৃভাষার যোগফলে এই হিন্দি ভাষাটিকে গঠন করা হয়েছে। সহজ করে বললে ৯৭+৩৪+৭৩ মোট ২০৪টি ভাষার মধ্যে মাত্র ৩৩টি মাতৃভাষা স্বনামে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে টিকে আছে এবং অবশিষ্ট ১৭১টি ভাষার স্বনামে কোনও অস্তিত্বই নেই– যা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় ছিল।

এবার নাম আছে এমন দু’টি ভাষার উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৬১-তে রাজস্থানি ভাষার মধ্যে জয়পুরী ভাষা (৮১,৫১৪ জন বক্তা) যুক্ত ছিল। ২০০১ অথবা ২০১১ সালের অষ্টম তফশিলি সরকারি হিন্দিতে এই জয়পুরী ভাষার উল্লেখ নেই। আবার ১৯৬১ সালের হিন্দি– সেখানে খারিবোলি ভাষার বক্তাসংখ্যা ছিল ৫৯,৮৯,১২৮ জন।
২০০১ সালের আদমশুমারিতে তা কমে হল ৪৭,৭৩০ জন। অবশ্য ২০১১-তে একটু বেড়ে ৫০,১৯৫ জন হয়েছে।

কোথায় যাচ্ছে এই ভাষাগুলি? এত কমে যাচ্ছেই-বা কেন? সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। হয়তো বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষেরা নিজে থেকেই আদমশুমারির দেওয়া ফর্মে নিজের মাতৃভাষার বদলে হিন্দিকেই ‘মাতৃভাষা’ বলে দেখিয়েছেন! আর, তা যদি না-হবে, তাহলে বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে ১৯৯১ থেকে শুরু হওয়া ‘আদার্স’ অর্থাৎ নামহীন জনসমষ্টি, বিশেষ করে হিন্দির ক্ষেত্রে, এত লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ে কী করে? ১৯৯১ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে ১০,০০০ জনের কম বক্তা থাকলে সেই ভাষার নাম উল্লেখ না-করে তাকে উপযুক্ত ভাষার সঙ্গে ‘আদার্স’ হিসাবে দেখানো হবে। ১৯৯১-তে এই নামহীন ভাষার জনসমষ্টির সংখ্যা ছিল ৪৬,৪২,৯৬৪ জন। ১০ বছর পরে এই সংখ্যা ১,৪৭,৭৭,২৬৬ জন এবং শেষ আদমশুমারি ২০১১-তে বেড়ে গিয়ে সংখ্যাটা ১,৬৭,১১,১৭০ জন হয়ে গেল।

সংবিধান অনুযায়ী, ১০ হাজারের কম বক্তা আছেন এমন সব ভাষাগোষ্ঠীর মানুষই নামহীন হয়ে এই ‘আদার্স’-এর মধ্যে রয়েছেন– অর্থাৎ নামহীন ভাষাগুলির বক্তার সংখ্যা সবথেকে বেশি হতে পারে ৯,৯৯৯ জন। অর্থাৎ ১৯৯১-তে এই নামহীন ভাষার ন্যূনতম সংখ্যা ছিল ৪৬৫টি, ২০০১ সালে ন্যূনতম ১,৪৭৮টি এবং সবশেষে ২০১১-তে ন্যূনতম ১,৬৭২টি। এবার এই ২০ বছরে ১০,০০০ সংখ্যাটির লক্ষ্মণরেখা ক’টি ভাষা লঙ্ঘন করতে পেরে, নিজের নাম ফিরে পেয়েছে এবং ‘সরকারি হিন্দি ভাষা’-র সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে– দেখা দরকার। আমরা দেখতে পাচ্ছি ২০০১ নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ৩টি মাতৃভাষা, আর নামহীন হয়ে পড়েছে ‘সানরি’ মাতৃভাষাটি এবং ২০১১-তে যুক্ত হয়েছে ৮টি মাতৃভাষা এবং নামহীন হয়ে পড়েছে ‘খৈরারি’, যার বক্তা সংখ্যা ২০০১ সালে ছিল ১১,৯৩৭ জন।

এবার তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতেই পারি যে, প্রথমত, ১৯৯১ থেকে ২০০১– এই ১০ বছরে মাত্র ৩টি ভাষার বক্তাসংখ্যা ১০,০০০ গণ্ডি পার করতে পেরেছিল। দ্বিতীয়ত, ২০০১ থেকে ২০১১– এই ১০ বছরে মাত্র ৮টি ভাষা ১০,০০০-এর সীমা পার করতে পেরেছে। তৃতীয়ত, ‘সানরি’ এবং ‘খৈরারি’ মাতৃভাষা দু’টির ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেছিল যে, ওদের বক্তাসংখ্যা স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধি না-পেয়ে ১০,০০০ নিচে চলে গিয়েছিল। চতুর্থত, ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১-য় ‘আদার্স’-এর ন্যূনতম মাতৃভাষার সংখ্যা যথাক্রমে ৪,৬৫,১৪৭৮ এবং ১৬৭২টি ভাষা বলেছিলাম। সেটা ভুল! প্রকৃতপক্ষে এই ভাষাগুলির বক্তাসংখ্যা এতটাই কম যে, তারা এই ১০/২০ বছরেও ১০,০০০ অতিক্রম করতে পারেনি, এবং তাই হিন্দি ভাষার সঙ্গে নাম নিয়ে যুক্ত হতেও পারেনি। পঞ্চমত, প্রতি ১০ বছরে এক বিশালসংখ্যক নামহীন মাতৃভাষাকে ‘আদার্স’ শিরোনামে সরকারি হিন্দি ভাষার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। ষষ্ঠত, স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও আমরা জানতে পারলাম না– ‘সরকারি হিন্দি’ ভাষা ঠিক কতগুলি মাতৃভাষার সমষ্টি এবং এই ভাষার চরিত্রটিই-বা কী যে এত, এত মাতৃভাষা সহজেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে! তাহলে কি এটা কেবলমাত্র রাজনীতি? সপ্তমত, ভারতে কি মাতৃভাষার গণতান্ত্রিক অধিকার একটা পরিহাসে পরিণত হতে চলেছে? না কি ভাষিক আগ্রাসনের অধিকারই স্বাধীনতার অপর নাম?

(মতামত নিজস্ব)

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ