ফাইল ছবি
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: বিয়ে কালজয়ী ‘সংস্থা’, সন্দেহ নেই। এবং আসল গোলমালটা সেখানেই। এই বিশ্বে এমন কিছুই নেই, যা কালজয়ী। কাল বা সময় যেমন বদলাচ্ছে, সেই সঙ্গে বিয়েরও রূপ পরিবর্তন হচ্ছে। উত্তর ইউরোপে বিয়ে বদলাতে-বদলাতে এমন বিলীন বিন্দুতে পৌঁছেছে, তাকে আর ‘বিয়ে’ বলা যায় না। তবে অত দূরে যাওয়ার দরকার নেই। বাঙালি বিয়ের কথাই ধরা যাক।
আমার দাদামশাই বিশ বছর বয়সে ন’-বছরের মেয়েকে বিয়ে করলেন। তার ১২-১৩ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সে পোয়াতি হল না। দাদামশাই আর দেরি না করে, পুত্রসন্তানের প্রবল প্রার্থী হয়ে, আরও একবার বিয়ে করলেন। এবং এই বিয়ে থেকে দু’-কন্যার জনক হলেন। আমার মা ও মাসির জন্ম হল। দাদামশাই আরও একবার বংশধরের জন্য বিয়ের তোড়জোড় করছেন। ৩০ বছর বয়সে মধুমেহ রোগ তাঁর সেই মধুর স্বপ্ন চিরতরে নিভিয়ে দিল। তখনও ‘ইনসুলিন’ নামের যুগাবতারের আবির্ভাব হয়নি।
এবার আমার ঠাকুরদার বিবাহিত জীবনে যাওয়া যাক। আমার ১২ বছরের ঠাকুমা আমার বাবার জন্ম দিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই সূতিকা ব্যামোতে মারা গেলেন। এবং আমার দূরদ্রষ্টা পিতামহ বাবাকে আদরে-যত্নে বড় করার জন্য বিন্দুমাত্র দেরি না করে আর একটা বউ নিয়ে এলেন ঘরে। এবং তাঁদের প্রায় বছরে-বছরে ছেলেমেয়ে হতে লাগল। এবং আমার বাবার আদর-যত্ন সেই তোড়ে ভেসে গেল। আমি বড় হয়ে কোনও দিন ঠাকুরদা-ঠাকুমাকে সরাসরি কথা বলতে দেখিনি। তাঁরা সর্বদা কথা বলতেন পরস্পরের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের কিংবা বউমাদের ‘থ্রু’ দিয়ে। এবং ভাববাচ্যে। যেমন, ‘তোমাদের মাকে বলো, এক কাপ চা কখন পাওয়া যাবে?’ তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে ঠাকুমার উত্তর, ‘তোমাদের বাবাকে বলো, এই তো চা খেল, আবার চা!’ এক বাড়ি ছেলেমেয়ে, বউমা, নাতি-নাতনি নিয়েও বিয়ের এই ফসিল নিজের চোখে দেখেছি।
এবার একটা ডাহা সত্যি কথা বলছি, যা যারপরনাই নির্মম। ঠাকুরদা মারা গিয়েছেন। ঠাকুমা সংসারের কাজ করে যাচ্ছেন। আমি ঠাকুরদার প্রাণহীন দেহের খানিক দূরে ‘সমারসেট মম’-এর ‘কেক্স অ্যান্ড এল’ পড়ছি আইএ পরীক্ষা দেওয়ার পরে– যে গল্পের নায়ক টমাস হার্ডি এবং হিউ ওয়ালপোল। এবং নায়িকা বহুগামিনী রোজি। স্পষ্ট মনে আছে, ঠাকুরদার শবদেহের পাশে বসে পড়ছি সেই দৃশ্য, যেখানে রোজি তার ব্রা ছিঁড়ে স্তন দু’টি বের করে টমাস হার্ডি-র দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘টেক মি অ্যাজ আই অ্যাম।’ এরপর কয়েকটি মহাবাক্যে রোজির স্তন দু’টিকে উৎসবায়িত করছেন মম। আমার মধ্যে সঞ্চারিত হল এই বোধি, বিয়েতে এই প্যাশন থাকতে পারে না। কখনও থাকতে পারে না।
কিছু দিন পরেই আমার দর্শনের অধ্যাপক বিশ্বনাথ সেন আমার হাতে দিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘ম্যারেজ অ্যান্ড মরাল্স’। এবং আমাকে কলার ধরে চড় মারল রাসেলের এই বিশ্বব্যাপী বাক্য: ‘Familiarity dulls the edge of passion’। নারী-পুরুষের চূড়ান্ত ‘ফ্যামিলিয়ারিটি’ জন্ম দেয় ‘ফ্যামিলি’ নামের একটি বিষময় ভিড়ের। এবং সেই ভিড়ের চাপে প্রথম যা নিভে যায়, তা সম্পর্কের অন্তরবহ্নি, যৌনতাড়না। পৃথিবীর যে কোনও বিয়ে যে কোনও সমাজব্যবস্থায় নিজের মধ্যেই ধারণ করে সেক্সুয়াল প্যাশনের অনিবার্য অবসানের বীজ। সন্তান ও সেক্সের এই অন্তর্লীন লড়াই, বিরোধিতা, তার একটা ক্লাসিক উদাহরণ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেক্সলাইফ, বা নরম ভাষায়, দাম্পত্যজীবন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর স্ত্রী সারদাসুন্দরীর ১৫টি সন্তান হল: প্রথমটি কন্যাসন্তান, নামকরণের আগেই মারা যায়। তারপর এই স্রোত: দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, বীরেন্দ্রনাথ, সৌদামিনী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সুকুমারী, পুণ্যেন্দ্রনাথ, শরৎকুমার, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারী, সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, বুধেন্দ্রনাথ। স্ত্রীর যৌবন যেন নেতিয়ে না পড়ে সে-কারণে দেবেন্দ্র ঠাকুরবাড়িতে সন্তানকে স্তন্যদান নিষিদ্ধ করেন। এবং এতগুলি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে বড় করার জন্য বিলিতি প্রথায় ‘ওয়েট-নার্স’ বা ‘দুধমা’ ভাড়া করেন। দেবেন্দ্র কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবন কাটাতে বেশিরভাগ সময়ই হিমালয়ের কাছে চলে যেতেন। জোড়াসাঁকোতে ফিরলে স্ত্রীর সংসর্গ প্রয়োজন হত।
দেবেন্দ্র সেক্স-লাইফের চমৎকার একটি বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর মেজেবউমা, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, জ্ঞানদানন্দিনী: ‘আমার মনে পড়ে বাবামশায় যখন বাড়ি থাকতেন আমার শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি ধোয়া সুতি শাড়ি পরতেন, তারপর একটুখানি আতর মাখতেন। এই ছিল তাঁর রাতের সাজ।’ এখানে সবথেকে জরুরি উক্তিটি হল, ‘ছেলেরা সব শুতে গেলে’। এই পরিসরটা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ছিল। সেটা তো বাড়ি নয়। দ্বারকানাথ নির্মিত প্রাসাদ। কিন্তু যে-বাড়িতে সেই একা হওয়ার জায়গা নেই, একাধিক সন্তান বাবা-মা’র যৌনজীবনে হাতুড়ি মারে না কি?
এবার আসি যৌন-তাড়না জুড়িয়ে যাওয়া দেবেন্দ্রনাথে। সমীর সেনগুপ্ত লিখছেন তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন’ বইয়ে: সম্ভবত ৪৯ বছর বয়সে ১৮৭৫-এর ১০ মার্চ সারদা দেবীর মৃত্যু হল। গত বছর সারদা দেবীর অবস্থা সংকটজনক হয়ে ওঠায় তাঁকে (দেবেন্দ্রনাথ-কে) টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। ৩ ডিসেম্বর দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁকে পুনরায় টেলিগ্রাম করলেন। সেই সংবাদ পেয়ে তিনি ডালহৌসি পাহাড় থেকে রওনা হলেন– কিন্তু তাও সোজা কলকাতায় ফিরলেন না। শান্তিনিকেতনে তাঁর সাধনক্ষেত্রে কিছু দিন কাটিয়ে তবে ফিরলেন। এবারে প্রায় দু’-বছর পরে, পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহে।
এবার আসি আমার নিজের জীবনের পরম সত্যে। যা আমার জীবনে ঘটেছে। এবং যা উপলব্ধ সত্যি। আমি প্রথম বিয়ে করি ১৬ বছরের এক মেয়েকে আমার ২৩ বছর বয়সে। এবং আমার মনে হয়, প্যাশন, খাঁটি যৌনতাড়না বাঁচিয়ে রাখতে, সন্তানহীন থাকতেই হবে। তত দিনে আমার বন্ধু এবং কলেজে সহকর্মী কেয়া চক্রবর্তীর প্রভাবে আমি সিমন দ্য বোভ্যোয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’ পড়েছি। এবং বুঝেছি, নারী-জীবনের একমাত্র সার্থকতা মা হওয়ার মধ্যে বা গভীরভাবে সংসারী হয়ে থাকার মধ্যে নয়। কিন্তু সন্তান না-হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে আমার দিক থেকে জুড়োতে লাগল। এবং বিয়ের ছ’-বছর পর থেকেই এই মিইয়ে যাওয়ার শুরু। তখন আমি গভীরভাবে প্রেমে পড়লাম ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের এক ঝকমকে ছাত্রীর। সেই প্রেম এবং সেই প্রাবল্য চলল আট বছর। এরপর আমি প্রথম বিয়ে থেকে মুক্ত হয়ে দ্বিতীয় বিয়েতে গেলাম।
একটা দরকারি তথ্য হল, আমার প্রথম বিয়ের ইচ্ছাকৃত সন্তানহীনতা। ফলে, বিয়েমুক্ত হতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। এরপর আমার প্রথম স্ত্রীর বিয়ে ঘটিয়ে আমি প্রায় আট বছরের প্রেমপ্লাবন পেরিয়ে বিয়ে করলাম এবং ছেলের বাপ হলাম। কিন্তু এই যে ছেলেকে বড় করার দায়িত্ব, তাকে কখনও ভুল পথে, কখনও ভুলে ঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়, এছাড়া প্রাত্যহিক নানা সাংসারিক শাখাপ্রশাখার ভিড়– যা সবার জীবনেই আছে। আমার জীবনেও এল। কী ভিড় কী ভিড়, মনে হল আমার।
আবার প্রেমে পড়লাম। এবার পরস্ত্রীর। এবং তীব্র কষ্ট পেলাম। প্রবল কষ্ট দিলাম। আর কোথায় যেন হারিয়ে গেল সেই আদিম প্যাশন। আমি পা ফেললাম অধ্যাপনা থেকে সাংবাদিকতায়। সাংবাদিকতা থেকে লেখা ও বাংলা ভাষার নেশায়। আর সেখান থেকে নিঃসঙ্গ স্বাধীনতার সেক্সুয়ালিটিতে। কী স্বার্থপর আমি। কষ্ট দিয়েছি অনেক। কষ্ট পাইনি, তাও নয়। সবথেকে যা আতঙ্কের, তা আমার অনিশ্চয়তা বোধ। কিন্তু ওই অনিশ্চয়তা বোধই আমার মধ্যে জাগিয়ে রেখেছে, এখনও আদিম তাড়না। সংসারে থাকলে যা নষ্ট হয়ে যেত। সংসার সীমান্তে যা বেঁচে রইল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.