আমেরিকাকে চাপে রাখতে চিন এই মুহূর্তে সেই মাচা, যেখানে লতিয়ে বাড়ছে ভারতের অর্থনীতি। শুল্কযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ৫০ শতাংশ কমলে, বেকারত্বের হার বাড়বে প্রবলভাবে। ভারতের এই চিন-নির্ভরতা বিপদ ডেকে আনবে না তো? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
চওড়া হাসি শেষ পর্যন্ত কে হাসবেন–নরেন্দ্র মোদি, না, শি জিনপিং, পরে বোঝা যাবে। তবে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, চিনা প্রেসিডেন্টের দুই হাতেই মোয়া।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছোড়া শুল্ক-শেল শি জিনপিং নিজের মতো করে সামাল দিচ্ছেন। তিনি যে পুরোপুরি চিন্তামুক্ত, নিশ্চিতই তা নয়। কিন্তু উৎফুল্ল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তঁার শরণাগত হয়েছেন বলে। অদূর অতীতের অমীমাংসিত তিক্ততা ভুলে ভারত তঁার কাছে এসেছে। ট্রাম্পের তৈরি করা শুল্কযুদ্ধ মোদির কাছে সর্বনাশের সংকেত বয়ে আনলেও
শি-র কাছে তা পৌষমাসের আমেজ।
তিয়ানজিনে একজনই কানছোঁয়া হাসি হাসতে পেরেছেন। শি জিনপিং। ভারতের অন্ধ অনুগত গোদি মিডিয়া মোদির জ্যাকেটের রং, উজ্জ্বল মুখ, দৃপ্ত পদক্ষেপ, উষ্ণ আলিঙ্গন ও লাল কার্পেটের দৈর্ঘ্য নিয়ে গদগদ হলেও মোক্ষম প্রশ্নগুলোর একটিরও অবতারণা করেনি। সেই দায়িত্ব পালন করেছে বিরোধীরা। ড্রাগনের কাছে হাতির নিঃসংকোচ সমর্পণের উল্লেখ করে তারা বলতে দ্বিধা করেনি, স্বঘোষিত ৫৬ ইঞ্চি ছাতির মালিকের স্বরূপ তিয়ানজিনে উন্মোচিত হয়েছে।
সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদ নিয়ে চিনের দ্বিমুখী নীতি ও দ্বিচারিতার সমালোচনা করে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী চিনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর যা বললেন, কোনও ভারতীয় নেতার কণ্ঠ থেকে এই প্রথম তেমন কিছু উচ্চারিত হল! সবাইকে অবাক করে মোদি জানালেন, ভারত ও চিন দুই দেশই সন্ত্রাসবাদের শিকার! সন্ত্রাসের অঁাতুড় পাকিস্তানকে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর
সময় চিন নানাভাবে সাহায্য করেছে, যার উল্লেখ ভারতীয় সেনানায়করাই করেছেন। মোদি
সে-প্রসঙ্গ তোলেননি। পাকিস্তান-চিন যুগলবন্দির উল্লেখও করেননি! গালওয়ানে ভারতের জমি দখল উপেক্ষা করে তিনি লাল ফৌজকে ক্লিনচিট দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কেউ আমাদের জমিতে ঢোকেনি। ঘঁাটি গেড়ে বসেও নেই। চিনের মোকাবিলায় কেন তিনি বারবার এভাবে কুঁকড়ে যান, কাদের স্বার্থে, সেই প্রশ্ন উঠলেও রহস্য এবারও উদ্ঘাটিত হল না। তিয়ানজিন দেখাল, মোদির ভারতের যাবতীয় হম্বিতম্বি শুধু পাকিস্তানকে ঘিরে। চিনের কাছে জবুথবু।
অথচ ঘটনা হল, পূর্ব লাদাখের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, এতকাল যেখানে ভারতীয় সেনা টহল দিয়ে এসেছে, এখন ‘নো এন্ট্রি’-র আওতায়। স্থিতাবস্থা ফেরানোর নামে ভারত-চিনের বোঝাপড়ায় তৈরি ‘বাফার জোন’-এ জওয়ানরা যেতে পারে না। চিরন্তন চারণভূমি মেষপালকদের হাতছাড়া। ব্রহ্মপুত্রের উপর বিশ্বের বৃহত্তম বঁাধ নির্মাণ ভারতের জন্য যে-বিপদ ডেকে আনতে চলেছে, এক ঘণ্টার আলোচনায় সে নিয়ে আদৌ কথা হয়েছে কি না, জানা যায়নি। আমেরিকার উপর চাপ সৃষ্টির জন্য চিন-ভারত-রাশিয়ার ত্রিদেশীয় কৌশলগত অক্ষ তৈরির প্রচেষ্টা ছাড়া বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ভারতের উপকার কতটা হবে, সে বিষয়ে অনেক সন্দেহ জিইয়ে রেখে দেশে ফিরলেন মোদি।
সেই সঙ্গে শুরু শঙ্কার দিনও। শঙ্কা ভারতীয় অর্থনীতির অতিরিক্ত চিন-নির্ভরতা ঘিরে।
শুল্কযুদ্ধ শুরুর পর মোদি-কণ্ঠে নিত্য স্বদেশিয়ানার যে-বাণী উচ্চারিত, যার সঙ্গে সংগত করছে আরএসএসও, তা ছেলেভুলানো গীত বিনা অন্য কিছু নয়। দেশের অবুঝ জনতাকে স্তোক দিতে তা কার্যকর হলেও ভারত-চিন বাণিজ্য বহরে চোখ মেললে বোঝা যাবে, চিন গালিভার, মোদির ভারত লিলিপুট! পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। ট্রাম্প এখন পাগলামি করছেন ঠিকই, কিন্তু গত চার বছর ধরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারই ভারতের এক নম্বর গন্তব্য।
শুধু তাই নয়, ওই দেশে ভারতের রপ্তানির বহর আমদানির থেকে অনেক বেশি। তাদের মহানুভবতা হোক কিংবা ভারতের শুল্কনীতি (ট্রাম্প যা ভাঙতে চাইছেন), বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দেশের সেই পরিচয় দিয়েছে। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে ভারত-আমেরিকার মধ্যে মোট বাণিজ্য হয়েছে ১৩১.৮৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভারত সে-দেশে রফতানি করেছে প্রায়
৮৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানির পরিমাণ ৪৫.৩৩ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য
উদ্বৃত্ত প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার। শুল্কযুদ্ধের দরুন রপ্তানি অর্ধেক কমে গেলে কী হাল
হতে পারে, এখনই সেই ছবি আঁকা অপ্রয়োজনীয়। কারও কারও আশঙ্কা, বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি কমতে পারে ২ শতাংশ পর্যন্ত।
ওই হিসাব এখন থাক। বরং দেখা যাক, ভারতের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কড়া ওষুধের প্রয়োগ
শি জিনপিংয়ের চোখ কেমন চকচকে করে তুলেছে। কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে মোদিকে কীভাবে দিক্ভ্রান্ত পথিকের মতো শি জিনপিংয়ের আঙিনায় টেনে এনেছে।
ভারতের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক পার্টনার চিন। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে দুই দেশের মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১২৭.৭৫ বিলিয়ন ডলার। ভাবা যায়, এই বিপুল বাণিজ্যের মধ্যে ভারতের রফতানির পরিমাণ মাত্র ১৪.২৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ ওই সময় চিন থেকে ভারত আমদানি করেছে ১১৩.৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৯৯.২৫ বিলিয়ন
ডলার। ঘাটতির এই বহর বছর-বছর লাফিয়ে বেড়ে চলেছে।
এবার একটু অন্যভাবে ভেবে দেখুন। বণিকমহলের শঙ্কা, শুল্কযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে। সেই বাজার ধরে নেবে চিন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশ। রফতানি ৪০ বিলিয়ন ডলার কমা মানে– অর্ধ কোটি বেকারের জন্ম হওয়া। নতুন বাজার ধরা চাট্টিখানি কথা নয়। চিন আমদানি ৫০ শতাংশ বাড়ালে ভারতের রফতানি ২০-২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে। সেই বদান্যতার বদলে তারা তাদের রফতানি কোন মূল্যে কতখানি বাড়িয়ে নেবে, কারও জানা নেই। চিন এই মুহূর্তে সেই মাচা, যেখানে লতিয়ে বাড়ছে ভারতের অর্থনীতি। টেলিকম, ইলেকট্রনিক্স, সেমিকন্ডাক্টর, সোলার প্যানেলের মতো নবায়নযোগ্য শক্তি, লিথিয়াম ব্যাটারি সেল, ফার্মাসিউটিক্যালস, কেমিক্যালস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি, নির্মাণ শিল্প, রেয়ার আর্থ বা বিরল খনিজ পদার্থের জন্য চিনের দিকে হাপিত্যেশ করে চেয়ে থাকা ছাড়া ভারতের উপায় নেই।
এই পরমুখাপেক্ষিতার অবসান ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বা ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর মতো ছেলেভুলানো স্লোগানে ঘটে না। স্বনির্ভরতার হাঁক দেওয়া সহজ, কিন্তু আত্মনির্ভর হওয়া কঠিন। সেই হিম্মতই ভারতের নেই। গত ১১ বছরে সেই চেষ্টাও করা হয়নি। গালওয়ানের পর চিনকে শিক্ষা দিতে তাদের পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। তার উত্তরে চিনের রাষ্ট্রদূত কী বলেছিলেন, একটু স্মরণ করে দেখুন। ট্রাম্পকে চাপে ফেলতে চিনের কোলে চেপে মোদি এখন নিজেকে আরও নড়বড়ে ও করুণার পাত্র করে তুললেন কি না– সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। শি জিনপিং তো এখন হাসবেনই।
হাসতে পারে পাকিস্তানও। সন্ত্রাসবাদ রাষ্ট্রীয় নীতি বলে যে পাকিস্তানের সঙ্গে ২০১৬ থেকে ভারত বাক্যালাপ ও বাণিজ্য বন্ধ রেখেছে, যাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নতির বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই, মুখ দেখাদেখির বালাই নেই, পহেলগঁাও কাণ্ডের পর যাদের জল বন্ধ করে নরেন্দ্র মোদি হুংকার দেন– ‘রক্ত ও জল একসঙ্গে বইতে পারে না’– সেই দুর্বিনীত প্রতিবেশীর একনম্বর মুরুব্বির কোলে উঠে বঁাচার আকুতি জানানো ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেখে শাহবাজ শরিফের ঠোঁটের কোণেও মুচকি হাসি খেলে যেতে পারে। ভারতের বিপন্নতা তঁার হর্ষের কারণ হলে, তার দায় নরেন্দ্র মোদি এড়াতে পারবেন না।
জর্জ ফার্নান্ডেজকে মনে আছে নিশ্চয়ই? ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী? সে-বছর তিনিই প্রথম প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান নয়, ভারতের এক নম্বর শত্রু চিন।’ দশ বছর পর ২০০৮ সালেও একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন তিনি। ‘এনিমি নাম্বার ওয়ান’-কে বিশ্বাসের মাশুল নেহরুকে দিতে হয়েছিল। মোদিকেও। গালওয়ানের পর ভারতকে আরও একবার তার মাশুল দিতে হলে ইতিহাস কিন্তু নরেন্দ্র মোদিকে ক্ষমা করবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.