Advertisement
Advertisement
Income Inequality Index

আয়-বৈষম্য সূচকে ভারতের বিস্ময়কর উন্নতি, তবু ওরা থাকে ওপারে!

অর্থনীতিতে ‘আয়’ আর ‘জীবনযাত্রার মান’ সমার্থক নয়।

India's surprising improvement in income inequality index
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:July 15, 2025 9:13 pm
  • Updated:July 15, 2025 9:13 pm  

‘জিনি সূচক’ একটি সীমিত পরিমাপক, যা শুধুমাত্র আয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য বোঝায়। কিন্তু এখনকার অর্থনীতিতে ‘আয়’ আর ‘জীবনযাত্রার মান’ সমার্থক নয়। বিশ্বব্যাঙ্কের তরফে প্রকাশিত এপ্রিল মাসের আয়-বৈষম্য সূচকে ভারতের বিস্ময়কর উন্নতি ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। তাই কি? প্রকৃত অর্থে যদি বৈষম্য হ্রাস হত, তবে শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষার মানে এত ব্যবধান থাকত? লিখছেন সুজনকুমার দাস। 

Advertisement

বিশ্বব্যাঙ্কের ‘Spring Poverty and Equity Brief’ রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছিল চলতি বছরের এপ্রিল মাসে, যেখানে ভারতের আয়-বৈষম্য সূচকে (‘জিনি ইনডেক্স’) বিস্ময়কর উন্নতির দাবি করা হয়েছে। অথচ, তখন এই রিপোর্ট নিয়ে না সরকার, না গণমাধ্যম– কোনও পক্ষেই বিশেষ হইচই হয়নি। তবু তিন মাস পর, এই জুলাই মাসে, আচমকা বিভিন্ন সরকারি ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে উচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রচার শুরু হয়েছে, যেন এটাই সদ্যপ্রাপ্ত এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই ‘সময়’ বেছে নেওয়া মোটেই কাকতালীয় নয়। আসন্ন সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন, মূল্যবৃদ্ধি ঘিরে জনমনে অসন্তোষ, এবং সরকারের ভাবমূর্তি পুনর্গঠনের কৌশলগত প্রয়োজনে এখন এই তথাকথিত ‘সমতার সাফল্য’ সামনে আনা হয়েছে বলেই মনে হয়। তথ্যপ্রবাহের এমন ‘সময়ের হিসাব কষে’ ব্যবহারের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বার্তা নির্মাণের একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা।

এটি এক ধরনের ‘issue framing’– যার মাধ্যমে জনগণের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। ভারত এখন আর শুধু বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি নয়, বরং বিশ্বের চতুর্থ সর্বাধিক সমতা-সম্পন্ন দেশ রূপেও উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, ভারতের জিনি সূচক এখন ২৫.৫, যা আয়ের বৈষম্য পরিমাপের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এই স্কোর অনুযায়ী, ভারত শুধুমাত্র স্লোভাক রিপাবলিক, স্লোভেনিয়া এবং বেলারুশের পরে অবস্থান করছে, এবং জি৭ ও জি২০-র সব দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে। উন্নত অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই সূচক ৪১.৮, চিনের ৩৫.৭ এবং ফ্রান্স-জার্মানি-জাপানের স্কোরও ৩১ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। এই প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য বড় সাফল্য, বিশেষত যখন দেশের জনসংখ্যা, বৈচিত্র এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর জটিলতা বিবেচনায় নেওয়া হয়।

‘জিনি সূচক’-এর মান যত কম হয়, ততই আয়ের সমতা বেশি ধরা হয়। ভারতের ক্ষেত্রে ২০১১ সালে এই সূচক ছিল ২৮.৮, যা ২০২২ সালে নেমে আসে ২৫.৫-এ। অর্থাৎ, গত এক দশকে ভারতে আয়ের বৈষম্য কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দরিদ্র জনগণের জন্য সুনির্দিষ্ট সরকারি সহায়তা এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দিকটি। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ১৭১ মিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্রসীমার নিচ থেকে উঠে এসেছে। এমনকী, তিন ডলারের নিরিখেও দারিদ্রের হার এখন মাত্র ৫.৩ শতাংশ।
এই তথ্যে একদিকে সরকার নিজেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আর্থিক ন্যায় ও অন্তর্ভুক্তির

চ্যাম্পিয়ন রূপে তুলে ধরছে, অপর দিকে এই পরিসংখ্যান নিয়ে উঠে আসছে একাধিক প্রশ্ন ও সংশয়। ভারত যদি সত্যিই এতটা সমতাভিত্তিক হয়ে থাকে, তবে কেন এখনও শিশু অপুষ্টি, নারী শ্রমশক্তির কম অংশগ্রহণ, গ্রামীণ বেকারত্ব ও শহুরে অনিশ্চিত কাজের হার এত বেশি? আর এই সংখ্যাগুলি কি বাস্তবে সমাজে বিদ্যমান প্রকট বৈষম্যকে আড়াল করছে না?
প্রথমত, জিনি সূচক একটি সীমিত পরিমাপক, যা শুধুমাত্র আয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য বোঝায়। কিন্তু এখনকার অর্থনীতিতে ‘আয়’ আর ‘জীবনযাত্রার মান’ সমার্থক নয়। ধরুন, একজন বছরে ৬০,০০০ টাকা আয় করে, কিন্তু সরকারিভাবে ফ্রি রেশন ও সহায়তা না পেলে সংসার চালানো কঠিন হত। আর একজন পঁাচ লাখ টাকা আয় করে নিজেই সব পরিষেবা কেনে। তাহলে কি এই দু’জনকে সমানভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত বলা যায়?

না, কারণ একদিকে জীবনধারণ নির্ভর করে সরকারের ভরতুকির উপর, অন্যদিকে একজন নিজের উপার্জনে স্বাধীন। ‘জিনি সূচক’ কেবল আয় মাপে, কিন্তু বোঝে না কার আয় কতটা ‘স্থায়ী’ বা ‘স্বাধীন’। ভারতের অনেক দরিদ্র পরিবার ভরতুকির মাধ্যমে আয় কিছুটা বাড়িয়েছে ঠিকই, তবে সেটা কি দীর্ঘমেয়াদে তাদের আত্মনির্ভর করেছে?

‘টেকসই উন্নয়ন’ মানে শুধু সহায়তা নয়, বরং এমন ক্ষমতায়ন, যাতে মানুষ ভবিষ্যতেও নিজের উপার্জনে সেবা নিতে পারে। সরকারি নীতির সফলতা রূপে প্রচারিত হয় জনধন অ্যাকাউন্ট, আধার, ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার এবং আয়ুষ্মান ভারত। কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জনধন অ্যাকাউন্ট থাকা মানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নয়, যদি না সেই অ্যাকাউন্টে নিয়মিত সঞ্চয় করার ক্ষমতা থাকে, বা ঋণ পাওয়ার সুযোগ থাকে। আধারভিত্তিক ভরতুকি বিতরণে বহু ক্ষেত্রেই ভুলভ্রান্তি, নাম কাটাকাটি, এবং প্রযুক্তিগত বিভ্রাট ঘটেছে, বিশেষত আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের আওতায় লাখ লাখ কার্ড ইস্যু হলেও বহু গ্রামীণ অঞ্চলে মানসম্মত চিকিৎসাকেন্দ্র বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই, ফলে ‘স্বাস্থ্য বিমা’ বাস্তবে অনেকক্ষেত্রেই প্রতীকী।

এছাড়া পরিসংখ্যানের নেপথ্যে ‘দারিদ্ররেখা’ যে কতটা ন্যূনতম ও বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন, সেটাও ভেবে দেখা উচিত। দিনে ১৮০-২০০ টাকা দিয়ে যদি কেউ জীবনধারণ করে, সেটাকে কি আমরা গর্ব করে দারিদ্র-নিরসন বলব? বিশেষত, এমন এক দেশে যেখানে সবজি, ওষুধ, পরিবহণ খরচ লাগাতার বেড়ে চলেছে, সেখানে এই দারিদ্রসীমার মানদণ্ডই প্রশ্নবিদ্ধ।

অর্থনৈতিক সমতার পাশাপাশি আরও গভীর কিছু সমস্যাও আলোচনায় আসা উচিত। কেন ভারতের কর্মসংস্থানে অস্থায়ী ও অনিরাপদ গিগ কাজের অংশ এত বেশি? কেন নারী শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ এখনও ২৫ শতাংশের নিচে? কেন উচ্চশিক্ষায় অনুপাতগতভাবে এখনও বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় সবচেয়ে কম উপকার পাচ্ছে? প্রকৃত অর্থে যদি বৈষম্য হ্রাস হত, তবে শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষার মানে এত ব্যবধান থাকত কি? শহুরে বস্তি এলাকা এত সংকটগ্রস্ত থাকত কি? এর পাশাপাশি, নতুন প্রজন্মের জন্যও আর্থিকভাবে উন্নীত হওয়ার পথ এত কঠিন হয়ে উঠত কি না সে-প্রশ্ন আসবে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, এই তথাকথিত সমতার ছবিকে ব্যবহার করে সরকার নীতি সমালোচনার জায়গা হ্রাস করতে পারে। আয় বৈষম্য কমছে– এই যুক্তি তুলে ধরে অনেকে নীতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে যেতে চাইতে পারে। কিন্তু সমতা তখনই ‘অর্থবহ’, যখন তা আয়ের বাইরেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ, জাতিগত ও ভৌগোলিক সুযোগের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। ভারত এখন যেসব সামাজিক-অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত– বেকার তরুণ, কৃষক ঋণ, শহুরে আবাসনের সংকট– তা জিনি সূচকের এই নম্বর দিয়ে আড়াল করা যাবে না।

সুতরাং, ভারতের ‘সমতা’ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার আগে এসব প্রশ্ন তোলা জরুরি– এই সমতা কি ‘টেকসই’ বা সাস্টেনেব্‌ল? এই উন্নয়ন কি অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ, না কি শুধুই পরিসংখ্যানগত? এবং সরকার যেসব কাঠামোগত বৈষম্য এড়িয়ে যাচ্ছে– তাতে ভবিষ্যতের অর্থনীতি আরও অনিয়ন্ত্রিত ও অসম না-হয়ে পড়ে! যদি রাষ্ট্র সত্যিই ন্যায্যতার পথে এগতে চায়, তবে তা শুধু ভরতুকি দিয়ে নয়– বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর মৌলিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার মধ্য দিয়েই সম্ভব। এই স্বীকৃতি তখনই বাস্তবিক অর্থে মূল্যবান হবে, যদি তা আত্মতৃপ্তি নয়, বরং আরও ন্যায়সংগত সমাজ গঠনের চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হয়।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, শ্রীপৎ কলেজ
[email protected]

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement