ফাইল ছবি
গত ১৭ বছরে নেপালে দশটি সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে। সাম্প্রতিক ঘটনা তারই একটা সংযোজন মাত্র। সুশীলা দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও আপাতত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হলেও নেপালের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উজ্জ্বল ঐতিহ্যেরই অংশ। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
কুর্সিতে বসেই নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান সুশীলা কারকি পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা করেছেন। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ‘জেন জি’-র সহিংস বিক্ষোভে সরকার পতনের পর নেপালও বাংলাদেশের পথে কি না, সেই প্রশ্ন যঁারা তুলছিলেন, তঁারা সম্ভবত একটি উত্তর পেলেন। নেপালে সংবিধানের বয়স মাত্র দশ বছর হলেও– সেখানে যে নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাজের বিভাজনরেখা ইতিমধে্যই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। অাধুনিক উদার গণতন্ত্রর লক্ষণ এটাই। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রক্ষমতার অাক্রমণকে রুখতে এবং রাষ্ট্রক্ষমতাকে একটি পরিধির মধে্য সীমাবদ্ধ রাখতে নাগরিক সমাজ সক্রিয় থাকবে ঠিকই, কিন্তু তারাও রাষ্ট্রের নির্ধারণ করা রাজনৈতিক সীমাকে অতিক্রম করবে না। সুশীলা ক্ষমতায় বসে সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন।
মাত্র ২৭ ঘণ্টায় ‘জেন জি’ বিক্ষোভে কাঠমান্ডুর তখ্ত বদল হওয়া এক অভিনব ঘটনা। সুশীলা নিজেও সে-কথা বলেছেন। এত অল্প সময়ের বিক্ষোভে সরকার পড়ে যাওয়ার নজির সম্ভবত বিশ্বে নেই। যদিও অন্তত ৩০ জন বিক্ষোভকারীর প্রাণ গিয়েছে। তবে ভূরি ভূরি গণ-অান্দোলনের ইতিহাস রয়েছে যেখানে, এর চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণ চলে গেলেও সরকারের গায়ে তা অঁাচড় কাটতে পারেনি। এই নেপালেই রাজতন্ত্রর বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ পঁাচ দশকের উপর অান্দোলন হয়েছিল, তাতে হাজার হাজার প্রাণ গিয়েছে।
২৭ ঘণ্টায় ‘জেন জি’-র বিক্ষোভের পর নেপাল যেভাবে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে, তাও এক বিরল ঘটনা। নেপালের জনসংখ্যার ২০ শতাংশই কাঠমান্ডু উপত্যকাকে ঘিরে থাকে। ফলে কাঠমান্ডুর রাস্তাঘাটে সবসময় থিকথিকে ভিড়। ‘জেন জি’-র বিক্ষাভ মিটতেই শহরের প্রাণকেন্দ্র থামেলে সাড়ে বত্রিশ ভাজার সেই চিরপরিচিত দৃশ্য। রাজপ্রাসাদের সামনে জমজমাট ক্যাসিনো। দরবার স্কোয়্যারে জনতার ঠেলাঠেলি। অর্থাৎ, ‘জেন জি’ যে অাচমকা নেপালের সমাজ-জীবনে বিরাট কোনও পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে, তেমন ইঙ্গিত নেই।
কাঠমান্ডুর রাস্তায় ‘জেন জি’ নামার সঙ্গে সঙ্গে গত বছরের অাগস্টের ঢাকার রাস্তার তুলনা চলে অাসছিল। একই সরলরেখায় এসে যাচ্ছিল ২০২২-এর জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় গোতাবায়ে রাজাপক্ষের প্রাসাদ দখলের ঘটনাও। কিন্তু কয়েকদিনের মধে্যই স্পষ্ট যে, পরপর শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের ঘটনা নির্দিষ্ট কোনও সূত্রের উপর দঁাড়িয়ে রয়েছে এমন নয়। অথবা এটাও বলার মনে হয় সময় অাসেনি যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ‘যুবকম্প’-র যুগ সমাগত। নেপালের নবীন গণতন্ত্র ‘জেন জি’-র অান্দোলনে প্রাথমিকভাবে একটু বেশি কেঁপে উঠলেও দ্রুত ধাক্কা সামলে নিয়েছে।
বাংলাদেশে মোল্লাতন্ত্রর সঙ্গে সেনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নেপালে যেটা অনুপস্থিত। শাহ রাজবংশর শাসনে নেপাল হিন্দুরাষ্ট্র থাকলেও, এখনও সেখানে হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকলেও, বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালনায় সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০১৫-র সংবিধানে নেপাল কার্যত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ঘোষিত হয়েছে। সাংবিধানিক সেই ঘোষণাটাও অবশ্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল না। রাজতন্ত্রর সময় নেপালের রাজাদের ‘বিষ্ণুর অবতার’ বলে গ্রহণ করা হত। রাজতন্ত্রর অবসানের সঙ্গে-সঙ্গে বিষ্ণুর অবতারদের দেশ পরিচালনার যুগও শেষ হয়েছে। ‘জেন জি’ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। থামেলের রাজপ্রাসাদে বিষ্ণুর অবতাররা ফিরবেন কি ফিরবেন না, তা নিয়ে কাউকে ভাবিত হতে দেখা যাচ্ছে না।
এই প্রসঙ্গে নেপালের সেনাবাহিনীর কথাও বলা যায়। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর মতোই তাদের অাচরণ এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ পেশাদার। নেপালে যখন রাজারা ছিলেন, তখন সেনাবাহিনী তঁাদের অনুগত ছিল। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তখন মাওবাদী প্রচণ্ডদের সঙ্গে নিত্য যুদ্ধ হত। ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্রর অবসান ঘটিয়ে যখন প্রচণ্ডরা ক্ষমতায় এলেন, তখন থেকে সেনাবাহিনী তঁাদের অনুগত থেকেছে। ‘জেন জি’-র এই বিক্ষোভেও দেখা গেল সেনাবাহিনী তাদের পেশাদার বাহিনীর মনোভাব বজায় রেখেছে।
রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের কোনও অভিপ্রায় তারা দেখায়নি। এমনকী, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কোনও অাগ্রহও তারা দেখাচ্ছে না। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ওলি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা ও বিরোধী নেতা প্রচণ্ডকে সুশীলা কারকির মুখোমুখি বসিয়ে সেনা ব্যস্ত থেকেছে কাঠমান্ডুর কুর্সির শূন্যস্থান পূরণ করে দ্রুত ব্যারাকে ফিরে যেতে। শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে এমনটা ঘটলেও বাংলাদেশে যে এটা ঘটেছে, তা বলা যায় না। বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে মুহাম্মদ ইউনূস তখ্তে বসে সেনা ও মোল্লাতন্ত্রর পুতুল হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। নাগরিক সমাজ যখন এইভাবে কারও পুতুল হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার উপর একাধিপত্য বিস্তার করে, তখন গণতন্ত্রর পতন ঘটে। নাগরিকদের অধিকার, বাক্স্বাধীনতা ইত্যাদি সবই বিপন্ন হয়। সংকীর্ণ স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
তাই বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা নেপালের ক্ষেত্রে ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। সুশীলার ছ’-মাসের মধে্য নির্বাচন করার কথা ঘোষণা সেকথাই বলছে। শাহ রাজবংশর শেষ প্রতিনিধি রাজা জ্ঞানেন্দ্র ফের ক্ষমতা দখল করবেন এমন কোনও সম্ভাবনা কারও দূরতম কল্পনাতেও নেই। অাসলে মাথায় রাখতে হবে যে, নেপালের গণতন্ত্র নবীন হলেও গণতন্ত্রর জন্য অান্দোলনের ঐতিহ্য দীর্ঘ দিনের। সেটাকে সহজে অস্বীকার করা যায় না। গত ১৭ বছরে নেপালে দশটি সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে। সাম্প্রতিক ঘটনা তারই একটা সংযোজন মাত্র। সুশীলা দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও অাপাতত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হলেও নেপালের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক অান্দোলনের উজ্জ্বল ঐতিহে্যরই একটি অংশ। তঁার স্বামী নেপাল কংগ্রেসের নেতা হিসাবে গণতান্ত্রিক অান্দোলনের অংশ হিসাবে বিমান ছিনতাই করে জেল খেটেছিলেন। সুশীলা যে তঁার রাজনৈতিক ঐতিহ্যকেই বহন করছেন, তা বলা যেতে পারে। নেপালের বাংলাদেশের পথে না-হঁাটার ইঙ্গিত ভারতের পক্ষে সবসময় স্বস্তির।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.