স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাংলা ভাষা বিদ্রুপের শিকার এবং তা বলার ‘অপরাধ’-এ বাঙালিরা অত্যাচারিত– এ কি ভারতাত্মার লজ্জা নয়? আমরা কি হতে পারিনি সর্বার্থে গণতান্ত্রিক? আমরা কি এখনও শিখিনি অনে্যর ভাষা ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিতে?
’২৬ বিধানসভা ভোটের সুর বঁাধতে, প্রচারের সোচ্চারতাকে আবেগের তুঙ্গে তুলতে যেন প্যারাশুটে করে নেমে এল সঠিক বিষয়টি বাতাবরণের সঙ্গে রাজজোটক মিলনে। বিষয়টি হল, এই মুহূর্তে বাঙালি অস্মিতার প্রধান বাহক বাংলা ভাষার অপমান! এবং সেই অপমানের প্রতিবাদে বাঙালির নতুন করে ‘ভাষা আন্দোলন’-এর শপথ। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রী তথা রাজে্যর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় ডাক দিলেন বাঙালিকে বাংলা ভাষার সম্মান বঁাচানোর। বললেন, ‘প্রাণ দিয়ে’ লড়ুন, বাংলা ভাষার উপর সন্ত্রাস রুখতে মিছিল করুন, প্রতিবাদে শামিল হোন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, বিজেপি-শাসিত নানা রাজ্য থেকে বাংলাভাষী শ্রমিকদের নানাভাবে হেনস্তা করার অভিযোগ ক্রমাগত প্রকাশে্য আসছে। সুতরাং নির্বাচনের আগে বাঙালিকে যে জাগিয়ে তোলার, উসকে দেওয়ার ডাক আসবে ভাষা-রক্ষার শপথ নিতে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যা অস্বাভাবিক এবং অতীব হতাশাসূচক তা হল– স্বাধীনতার এত বছর পরেও, এখনও, ভারতে কোনও একটি ভাষার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, সেই ভাষা কোনও কারণে বিদ্রুপ বা সন্দেহের শিকার হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট ভাষায় কথা বলার ‘অপরাধ’-এ এক ভারতীয় নাগরিকের উপর সন্ত্রাস হানা হচ্ছে।
ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্রই ভারতকে দিয়েছে তার সাংস্কৃতিক সহন, ব্যাপ্তি, এবং অনন্যতা। ‘ভারত’ মানেই এমন এক দেশ– যেখানে যুগ-যুগ ধরে বহু বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষার স্রোত এসে তৈরি করেছে এক অতুলনীয় মিলনসাগর। এবং এই মিলনসাগরে স্বীকৃত হয়েছে প্রতিটি স্রোতের পৃথক অবদান ও অস্মিতা। ভারতে চলতি প্রতিটি ভাষা ও সংস্কৃতির সমান সম্মান ও স্বীকৃতি তো আমাদের সংবিধানের দান। আমাদের দেশ এমন এক দেশ যা যুগ-যুগ ধরে মেনে নিয়েছে এখানকার মানবস্রোতে মিশে-যাওয়া প্রতিটি জাতির জ্যাত্যভিমান, যা জড়িয়ে আছে সেই জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে। এত কিছুর পরও, এমনকী স্বাধীনতার পঁচাত্তরোর্ধ্ব বছর পর কেনই-বা বাঙালির গায়ে সন্ত্রাসের অঁাচ লাগছে তার নিজের ভাষার জন্য? কেন বাংলা বলার জন্য বাংলার বাইরে বেশ কিছু রাজে্য বাঙালিকে পড়তে হচ্ছে বিচিত্র হেনস্থার মধে্য? তাহলে কি ভারতের কিছু মানুষের মধ্য যে যাপনদর্শন গড়ে উঠেছে, তার গোড়াতেই গলদ? আমরা কি হতে পারিনি সর্বার্থে গণতান্ত্রিক? আমরা কি এখনও শিখিনি অনে্যর ভাষা ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিতে?
বিবিধের মিলনভূমি ভারতে মন-মনন-শরীর সমৃদ্ধ একাধিক ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-আচারে। এই গূঢ় ও গভীর সত্য কথাটি ভুলে গেলে ভারতের সাংস্কৃতিক কাঠামোটাই ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মতো। ভারতের প্রতিটি জাতির নিজ-নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির মধে্য জ্বলছে এই দেশের সমবেত প্রাণপ্রদীপ, এবং সেই আলোর মধে্যই বিচ্ছুরিত সমগ্র ভারতের জাতীয় অস্মিতা– এই কথাটি আর কবে বুঝব আমরা নিজেদের রাজনীতির যূপকাষ্ঠের বলি না-হতে দিয়ে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.