Advertisement
Advertisement
Snan Yatra

জগন্নাথ গণধর্মের গণদেবতা, স্নানযাত্রার পর গণেশ রূপে দর্শন দেন মহাপ্রভু

মঙ্গলময় আবাহনীর উৎসব দেবস্নান পূর্ণিমা।

Jagannath Dev appears as Lord Ganesha after Snan Yatra
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 11, 2025 10:58 am
  • Updated:June 11, 2025 11:53 am  

আজ জগন্নাথদেবের দেবস্নান পূর্ণিমা। ‘স্কন্দপুরাণ’-এ উল্লেখ রয়েছে যে, স্বয়ং শ্রীজগন্নাথ ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজকে বলেছিলেন, আমার আবির্ভাব দিবস জৈ্যষ্ঠ-পূর্ণিমাতে আমাকে বাইরে, মণ্ডপের উপর নিয়ে গিয়ে ভক্তিভাবে আদর-যত্নে মহাস্নান করাবে। সেই আদেশ পালন করার পরম্পরা আজ পর্যন্ত প্রচলিত। জনশ্রুতি আছে, আগে এই উৎসবটির জন্যে ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান থেকে পবিত্র জল আনা হত। লিখছেন লক্ষ্মীনারায়ণ মল্লিক।

শ্রীক্ষেত্র পুরী-র অধিষ্ঠাতা মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথ ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্‌’ জ্ঞানে সমস্ত সংসারকে নিজের করার জন্য সবাইকে বেঁধে রেখেছেন প্রেম আর ভক্তির রজ্জুতে। শ্রীজগন্নাথ মতবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ভাবধারা। শৈব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, জৈন– আমাদের সমাজের বিভিন্ন বিশ্বাস ও মতবাদকে আলিঙ্গন করে নিজের ভিতরে সমাহিত করেছে। সনাতন ধর্মের প্রায় সমস্ত সম্প্রদায় শ্রীজগন্নাথের ভিতরে আপন ইষ্টদেবকে খুঁজে পেয়েছে। সর্ববাদীসম্মত এই ঠাকুর মানবসমাজের আচারবিচার, চালচলন, রীতিনীতি– সব কিছুতে সৃষ্টি করেছেন একাত্ম আর সমতার মহান ভাবনা।

শ্রীজগন্নাথের অন্য এক নাম হচ্ছে লীলাপুরুষোত্তম। ‘শ্রীজগন্নাথাষ্টকম’-এর দ্বিতীয় পদে বর্ণিত আছে: ‘সদা শ্রীমদ বৃন্দাবন বসতি লীলা পরিচয়ো, জগন্নাথ স্বামী নয়ন পথগামী ভবতুমে।’ লীলা-র মাধ্যমে ভক্তের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করে, তাদের বৌদ্ধিক চিন্তাধারাকে জাগ্রত করে, উচ্চস্তরের জীবনযাপন করার জন্য অনবরত প্রেরণা দেওয়া তঁার জাগতিক লীলার মূল উদ্দেশ্য। লীলার যে মাধুর্য, তার পরিপ্রকাশ হয় যাত্রার মাধ্যমে। লীলায় যে জটিল আর গভীর ভাব, দর্শন, জ্ঞান থাকে– সেগুলি যাত্রার মাধ্যমে সহজ আর সরলভাবে পরিস্ফুট হওয়াতে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। পবিত্র স্নান-পূর্ণিমাতে রত্ন-সিংহাসন থেকে নেমে আসেন প্রভু জগন্নাথ। স্নানবেদিতে হয় তঁার প্রত্যক্ষ স্নান। বছরের অন্য সমস্ত দিনে রত্ন-সিংহাসনে আসীন ত্রিমূর্তি অপ্রত্যক্ষ স্নান করেন। প্রতিদিন ভোরবেলা ‘মণিমা’, ‘মণিমা’ ডেকে ঠাকুরের ঘুম ভাঙানোর পর মঙ্গল-আরতি, মাইলাম (পোশাক পালটানো), অবকাশ (দঁাত মাজা আর স্নান) পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয়। ঠাকুরের এই অপ্রত্যক্ষ প্রতিবিম্ব স্নানহেতু, দার্পানিয়া সেবক দু’-ফুট উচ্চ তিনটি পিতলস্তম্ভের উপরে বসানো আয়না ত্রিমূর্তির সামনে রাখে। সেই আয়নায় দৃশ্যমান দারুমূর্তির প্রতিবিম্বের উপর সেবকরা কর্পূর, চন্দন, দই-মেশানো সুবাসিত জলের ছিটে দিয়ে স্নান-সমাপন করে। তারপর আবার ‘মাইলাম’ করে শ্রীজগন্নাথকে গোপালবল্লভ ভোগ অর্পণ করা হয়।

‘স্কন্দপুরাণ’-এ উল্লেখ রয়েছে যে, স্বয়ং জগন্নাথ ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজকে বলেছিলেন, আমার অাবির্ভাব দিবস জৈ্যষ্ঠ-পূর্ণিমাতে আমাকে বাইরে, মণ্ডপের উপর নিয়ে গিয়ে ভক্তিভাবে আদর-যত্নে মহাস্নান করাবে। সেই আদেশ পালন করার পরম্পরা আজও প্রচলিত। জনশ্রুতি আছে, আগে এই উৎসবটির জন্য ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান থেকে পবিত্র জল আনা হত। সময়ক্রমে ওইসব তীর্থজলকে একটি স্বর্ণকলসিতে রেখে শ্রীমন্দিরের উত্তর দ্বারে মা শীতলার সম্মুখে অবস্থিত কুয়োটির ভিতরে রাখা হত। ‘স্বর্ণকুয়ো’ নামে খ্যাত এই কুয়োটি সারা বছর বন্ধ থাকে। স্নান-পূর্ণিমার আগের দিন কুয়োটির ঢাকনা খুলে এর মধ্যে চুয়া-চন্দন-কর্পূর দিয়ে অধিবাস করানো হয়। স্নান-পূর্ণিমা দিবস সকালে, জগন্নাথদেব নিজের বড় ভাই বলভদ্র, ভগিনী সুভদ্রা আর শ্রীসুদর্শনকে নিয়ে রত্ন-সিংহাসন থেকে আনন্দবাজার দিয়ে স্নান-মণ্ডপ পর্যন্ত ‘একের পিছনে এক’ ক্রমে ধাড়ি পহান্ডিতে অধিষ্ঠান করেন। এরপর, ‘গরা বড়ু’ সেবকরা স্বর্ণ কুয়ো থেকে জল তোলেন। চতুর্দ্ধা মূর্তিকে ১০৮ কলসি জলে প্রত্যক্ষ স্নান করানো হয়। এরপর পুরী রাজা পারম্পরিক বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে এসে জগন্নাথদেবের বিশেষ পূজা-অর্চনা-সহ স্বর্ণঝাড়ু দিয়ে স্নানবেদিতে ‘ছেরা পহঁারা’ (ঝাড়ু দেওয়া) করেন। বৈষ্ণবমতে ঠাকুরের যাত্রার আগে তঁার রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য ঝাড়ু দেওয়া হয়। জগন্নাথদেবের প্রথম সেবক হিসাবে পুরী রাজার রথ আর উলটোরথের সময়ও এই ‘ছেরা পহঁারা’ করার প্রথা প্রচলিত আছে। স্নানযাত্রার শেষ পর্যায়ে জগন্নাথ, বলভদ্র গজান-বেশ বা হাতি-বেশ ধারণ করে সবাইকে দর্শন দিয়ে থাকেন। মহাপ্রভু সবার, এবং যে যেভাবে তঁাকে স্মরণ করে, তাকে তিনি সেভাবেই দর্শন দেন– এই গজানন-বেশের মাধ্যমে তা-ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে বলেছেন, ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে, তাংস্তথৈব ভজাম্যহম’। যে যেভাবে, যেরূপে আমাকে চায়, আমি সেই ভাবে, সেই রূপে তার সেবা, পূজা গ্রহণ করে তাকে আশীর্বাদ করি।

স্নান-মণ্ডপে এই গজানন বা গণেশ-বেশের নেপথ্যে এই দর্শন-আধারিত একটি সুন্দর কিংবদন্তি আছে। দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের গণপতি ভট্ট নামে গণেশ ঠাকুরের একজন বড় ভক্ত পুরীতে তঁার ইষ্টদেব রয়েছেন বলে শুনে, তঁার মনের প্রভুকে দর্শনের জন্য পুরীর মন্দিরে এসেছিলেন। গণেশই পরমব্রহ্ম– এই বিশ্বাসে তিনি যখন রত্ন-সিংহাসনে শ্রীজগন্নাথকে দেখেন, তখন গণপতিকে না দেখতে পেয়ে তিনি মনে দুঃখ ও অভিমান নিয়ে পুরী থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন। ভক্তের ভাবগ্রাহী শ্রীজগন্নাথের স্বপ্নাদেশে মাঝরাস্তা থেকে গণপতি ভট্ট ফিরে এসে জৈ্যষ্ঠ-পূর্ণিমার দিন স্নান-মণ্ডপে জগন্নাথ আর বলভদ্রকে অপূর্ব শোভামণ্ডিত কালো আর সাদা বেশে নিজের ইষ্টদেব গণপতিরূপে দর্শন করে বিমোহিত হলেন। অভিভূত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, ‘ত্বমেব বক্রতুণ্ডশ্চ, ত্বমেব গণনায়কঃ, শুক্লাবর্ণ স্বরূপেন, গৌরীপুত বিনায়কঃ। কৃষ্ণ রূপময় কৃষ্ণ, শিবরূপময় হরঃ, সাক্ষাৎ দেব জগন্নাথ, বিঘ্ন বিনায়ক স্বয়ম।’ ওই ঘটনার স্মারকস্বরূপ স্নান-পূর্ণিমাতে গজানন-বেশ আজও প্রচলিত। পুরীর রাঘব দাস মঠ ও গোপালতীর্থ মঠ এই বেশ তৈরি করে মন্দিরকে প্রদান করে।

ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে, মারাঠা শাসনের সময় এই গজানন-বেশের আরম্ভ। মোগলদের পর যখন মারাঠা শাসকরা ও ওড়িশাকে শাসন করত, তখন পুরী মন্দিরে অনেক বিকাশমূলক পদক্ষেপ করা হয়েছিল। মা লক্ষ্মীর সুবর্ণমূর্তি স্থাপন, ঝুলন যাত্রার প্রচলন, ধর্মশালা ও মঠ নির্মাণ, কোনারকের ভগ্ন মন্দির থেকে পাথর এনে ভোগ-মণ্ডপ এবং মেঘনাদ প্রাচীরের শ্রীবৃদ্ধি করা হয়। মন্দিরের সিংহদ্বারে যে সুউচ্চ অরুণস্তম্ভটি রয়েছে, সেটিও এই সময় কোনারক থেকে এনে এখানে স্থাপন করা হয়। মারাঠাদের আরাধ্য দেবতা গণপতি, আর হয়তো সেই কারণে বছরে একবার জগন্নাথদেব গণেশ-বেশ ধারণ করেন। তবুও শ্রীজগন্নাথ, ভক্ত যে রূপে তঁাকে দেখতে চেয়েছে, সেই রূপে তাকে দর্শন দিয়েছেন, এই বিশ্বাসটি বারবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে। রামানুজ তুলসীদাসকে শ্রীরাম, শ্রীচৈতন্যকে শ্রীকৃষ্ণ, তোতাপুরীকে দক্ষিণাকালী রূপে দর্শন দেওয়ার মতো ঠাকুর গণপতি ভট্টকে শ্রীগণেশ রূপে দর্শন দেওয়াটাও তঁার লীলারহস্য পরিবৃত্ত, যাকে ‘দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ’।

দেবস্নান পূর্ণিমা হচ্ছে মঙ্গলময় আবাহনীর উৎসব। স্নানের আনন্দ শেষ করে, ভক্তদের তাদের মনোবাঞ্ছিত বেশে দর্শন দিয়ে, অসুস্থ হওয়ার মতো আর একটি লৌকিক সত্যকে গ্রহণ করে শ্রীজগন্নাথ জগৎকে একটি মহৎ সন্দেশ দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে ১৪ দিন নিভৃতবাসের জন্য অনবসর গৃহে প্রবেশ করেন। এরপর জগতের নাথ জগন্নাথ নামকে সার্থক করে নেমে আসবেন তিনি, বড়দাণ্ডের উপরে রথে বসে জনতা জনার্দনের সঙ্গে একাকার হতে।

জয় জগন্নাথ!

(মতামত নিজস্ব)

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement