Advertisement
Advertisement
Child Labour

‘ছোটু’ ‘ছোটু’ ‘ছোটু’

বৃহস্পতিবার ছিল 'বিশ্ব শিশুশ্রমিক বিরোধী দিবস'।

More than one crore child labour in India says report

প্রতীকী ছবি

Published by: Amit Kumar Das
  • Posted:June 13, 2025 9:19 pm
  • Updated:June 13, 2025 9:19 pm  

চিরঞ্জীব রায়: শিলিগুড়ির বিধান মার্কেটে যে-ছেলেটা ভাতের হোটেলের পিছনের গুলিতে বসে কোনও দিকে না-তাকিয়ে টানা বাসন ধুয়ে যায়, ওর নাম ‘ছোট্ট’। বউবাজারে চাটের দোকানে যে-কিশোর টেবিলে টেবিলে প্লেট এগিয়ে দেয়, আর চিৎকার করে অর্ডার হাঁকে তার নামও ‘ছোট্ট’। বর্ধমানের কার্জন গেটে যে-বাচ্চা ভিড় রাস্তা পেরিয়ে এ-দোকান, সে-দোকানে চায়ের গ্লাস নিয়ে প্রাণপণ ছোটে সে-ও ‘ছোট’। এরা সবাই শীর্ণকায়, মাথার চুলে তেল বা চিরুনি- কোনওটাই পড়ে না। এদের সবার মুখে শৈশব হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হতাশা সুস্পষ্ট। আমরা এদের বিলক্ষণ চিনি।

দেশের চায়ের দোকান থেকে হোটেল, ইটভাটা থেকে মোটর গারাজ, বিভিন্ন কলকারখানা থেকে গৃহস্থ বাড়িতে এমন এক কোটিরও বেশি ‘ছোট্ট’ আছে। মা-বাবার ভালবেসে দেওয়া নাম ওদেরও ছিল। কিন্তু মানুষ থেকে মেশিনে পরিণত হওয়ার কোন ফাঁকে সেটা হারিয়ে গিয়েছে। এমনটা হোক, তা ওদের পরিবার চায়নি। কিন্তু চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে না উঠে বাধ্য হয়েছে ছেলেমেয়ের শৈশব কেড়ে নিতে। বাবার রোজগারে সংসার খরচ অকুলান। ছেলেটা বা মেয়েটা সামান্য হলেও রোজগার করে আনলে দু’-বেলা দু’-মুঠো ভাত জুটবে। ওরা নিজেরাও ভাল থাকবে। এমন ভাবনা থেকেই সন্তানকে দুধেভাতে রাখতে চাওয়া অসহায় মা-বাবা তাদের রুক্ষ পৃথিবীতে জীবিকার লড়াইয়ে ঠেলে দেয়। ঠেলে দিতে বাধ্য হয়।

নিজের এবং পরিবারেরও ভাবের জোগাড় করতে গিয়ে শিশুটি হয় স্কুলছুট হয়, না হলে ক্লাসঘরের সঙ্গে, বইখাতার সঙ্গে পরিচয়ই হয়ে ওঠে না তার। গরিব পরিবারও জানে, তাদের ছেলের পক্ষে এমন ডিগ্রি হাসিল করা অসম্ভব-যার ভিত্তিতে সে চাকরি পেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই একটু কর্মঠ হলেই তাকে কোনও গারাজে বা দোকানে জুতে দেওয়া হয়। মেয়েটি যায় লোকের বাড়িতে কাজ করতে। অশিক্ষিত হয়ে থাকার এবং সাবলীল সামাজিক জীবনযাপন না-করতে পারার দীর্ঘস্থায়ী অতি কুপ্রভাব বাচ্চাটির শরীরের ও মনের উপর পড়বে, তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে, এই বিষয়টা নিয়ে অভিভাবক মাথা ঘামায় না। বা মাথা ঘামালেও পরিস্থিতি তাকে নিরুপায় করে রাখে।

অন্যদিকে, ভারতের কর্মক্ষেত্রের একটা বড় অংশ অসংগঠিত। কম মাইনে দিয়ে বেশি খাটানো যায়, প্রতিবাদও করতে পারে না, এমন নানা কারণেশিশুশ্রমিকের চাহিদা কম নয়। আর, মজা হল, দেশে সেই ১৯৮৬ সালে ‘শিশুশ্রম (নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন’-এ জারি হলেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এবং আইনের এই ফাঁকের সদ্ব্যবহার প্রত্যেকেই করে থাকে। ‘ছোট্ট’-রা বঞ্চিত হয়, নির্যাতিত হয়। কোনও প্রতিবাদ বা প্রতিকার ছাড়া অনেক সময় তাকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এবং বাঁধা-ধরা সময়ের বাইরে কাজ করতে হয়। এর মর্মান্তিক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে তার শরীরে ও বিশেষ করে মনে। মনস্তত্ববিদরা বলছেন, খেলাধূলার অবকাশ, পরিবারের স্নেহস্পর্শ ও সামাজিক মেলামেশার অভাবে শিশুশ্রমে যুক্ত ছেলেমেয়েরা শৈশব, কৈশোর হারিয়ে একলাফে বড় হয়ে যায়। ফলে মায়া-মমতা, ভালবাসা-শ্রদ্ধাবোধ-সহমর্মিতা ইত্যাদি কোমল বোধ শুকিয়ে যেতে থাকে। অপরাধপ্রবণতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। এবং, এই যে একটি শিশু পারিবারিক ও সামাজিক সাহচর্য, শিক্ষার অধিকার ও নিরাপদ সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার মৌলিক অধিকার হারাচ্ছে- এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের মানবসম্পদ।

শিশু-কিশোর স্বাস্থ্যবান মেধাবী পরিণত এক পুরুষে উন্নীত হয়ে ওঠে না। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর্থ-সামাজিক অবস্থান। দেশে সম্পদের বদলে বোকা বাড়ে। শিশুই যদি হয় দেশের ভবিষ্যৎ, তাহলে মেঘলা হয়ে যায় সেই ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ প্রায় ১০ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে এবং দৈনন্দিন ভাত-কাপড়ের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে, সে দেশে ছোটদের কাজে পাঠানো বন্ধ করা সহজ নয়। আইন আছে। সে-আইনে কেবল ১৪ থেকে ১৮ বছরের কিশোরদের ঝুঁকিহীন ক্ষেত্রে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া হয়েছে কাজের সময়। নির্দিষ্ট করা হয়েছে কাজের উপযোগী পরিবেশ। কিন্তু এত বড় দেশে, বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে, হোটেল থেকে গারাজ, ছোটখাট কারখানা থেকে গৃহস্থের বাড়িতে নিয়মিত নজরদারি চালানো এবং আইন বলবৎ করা সহজ নয়। বিশেষ করে যারা কাজ করছে, অভাবের তাড়নায় তারা-ই যে কোনও শর্ত মেনে নিতে রাজি থাকায় আইনের প্রাসঙ্গিকতা নষ্ট হয়ে যায়।

তাই, প্রয়োজন আরও কড়া আইন। পরিবারগুলিকে বোঝাতে হবে শিশুশ্রমের প্রভাব- সেই ছোট্ট মানুষটি এবং তার প্রিয়জন এবং সমাজের ক্ষেত্রে কতটা ক্ষতিকর। দারিদ্র যেহেতু শিশুশ্রমের মূল কারণ সেই সমস্যার যতটা সম্ভব নিরসণ করতে হবে। দারিদ্র দূরীকরণে সরকার ‘দীনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনা (DAY)’, ‘জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন (NFLM)’, ‘মহাত্মা গান্ধী জাতীয় প্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম’ সুনিশ্চিত প্রকল্প-সহ অন্যান্য প্রকল্পের বান্দোবস্ত করেছে। জীবনধারণের মানের উন্নতিতে চালু হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’, ‘গ্রাম সড়ক যোজনা’ বা ‘ন্যাশনাল হেলথ মিশন’ এর মতো প্রকল্প। বছরে অন্তত পঞ্চাশ দিনের কাজ সুনিশ্চিত করতে রাজ্য সরকার ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্প চালু করেছে। চালু হয়েছে ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প।

ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে, বিনামূল্যে বইখাতা দেওয়া হচ্ছে। ব্যবস্থা হয়েছে ‘মিড ডে মিল’-এর। চালু হয়েছে ‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড’। শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলছুট পড়ুয়াদের বাড়ি যাচ্ছেন তাদের স্কুলে ফেরাতে। শিশুশ্রম-বিরোধী সচেতনতার প্রসারে পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগী করা হয়েছে। সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন শিক্ষক, স্থানীয় মানুষ এবং এলাকার প্রভাবশালী মানুষ। শিশুশ্রমের কবল থেকে বাচ্চাদের বাঁচিয়ে আনলেই হবে না, তাদের আর্থ-সামাজিক এবং মানসিক পুনর্বাসন করতে হবে। এই সমগ্র কর্মকাণ্ডকে সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে ‘আন্তর্জাতিক শ্রাম সংগঠন’ (আইএলও) এবং ‘ইউনিসেফ’-এর আর্থিক এবং তত্ত্বগত সহযোগিতা খুব জরুরি। তাই নিরবিচ্ছিন্নভাবে পাশে রাখা হয়েছে তাদেরও। শিশুশ্রম মুছে ফেলা মানে শুধু সেই শিশুটিকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন দেওয়া নয়, সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও উন্নয়ন। এবং সরকারি পদক্ষেপের ফলে। সেই অসাধ্যসাধন অনেকটাই সম্ভব হয়েছে। দেশে দারিদ্রের হার কমার পাশাপাশি শিশুশ্রমও কমছে। আগামীতে এমন দিন আশা করা যেতেই পারে-যখন কোনও গারাজ বা চায়ের দোকানে ‘ছোট’ বলে হাঁকলেই কেউ সাড়া দেবে না। বিরক্তি-সহ ভুরু কুঁচকেও সাড়া না-পাওয়া মানুষটি হয়তো সেদিন খুশিই হবে।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement