ব্যক্তিগতভাবে চড়া মূল্য চোকানোর কথা বলে কীসের বার্তা দিলেন নরেন্দ্র মোদি? তিনি কি রাজনীতি ছাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন? একদিকে বিরোধীদের চাপ, অন্যদিকে বড় চাপ সংঘের। সংঘ-প্রধান অবসর নিলে মোদি কি বহাল থাকবেন? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
বড় অস্বস্তিতে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। সংকটেও। ১১ বছরের রাজত্বে এমন বহুমুখী চাপ তাঁকে আগে সইতে হয়নি। চাপ ঘরে-বাইরে। তার ছাপ চোখে-মুখে লেপ্টে আছে। কিছুদিন ধরে তাঁর মুখে হাসি নেই। ভুরুজোড়া সদা কুঞ্চিত।
সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শেষের দিকে এগিয়ে চলেছে। চাপ এতটাই যে, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে তিনদিন ধরে ৩২ ঘণ্টা আলোচনা চললেও তিনি রাজ্যসভায় ভাষণ দেননি। ঢোকেনওনি। লোকসভায় এসেছিলেন, দীর্ঘ ভাষণে কংগ্রেসের শাপশাপান্ত করে স্তাবক-পরিবৃত হয়ে বেরিয়ে গেলেন একটি প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে। সেই নিষ্ক্রমণে দর্প ছিল না। ছিল আক্রমণ ও সমালোচনা এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার তাগিদ।
এক বছর আগের মোদির শরীরী-ভাষা স্মরণ করুন। পার্থক্যটা খোলা চোখেই ধরা পড়বে। সরকার ও দলে মুঠো আলগা হচ্ছে। দ্বিমুখী চাপে দিশাহারা, তাই ‘ব্যক্তিগতভাবে চড়া
মূল্য চোকানোর’ ইঙ্গিত দিয়ে সহানুভূতি কুড়োতে চাইছেন কি না, তা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে জল্পনা। এই বছরটা তঁার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। দুয়ে দুয়ে চার না বাইশ– রাজনীতিতে তা মিলিয়ে নেওয়ার অনেক কায়দা আছে। নেতাদের প্রতিটি কথাই অর্থবহ। তাই বিশ্লেষণ হয়। মানে খোঁজার চেষ্টা চলে। এই যেমন একমাস আগে অমিত শাহ হঠাৎ বললেন, অবসর জীবনে বেদ-উপনিষদ পড়বেন আর অর্গ্যানিক চাষ করবেন! যিনি বিজেপি ও সরকারের ‘নাম্বার টু’, বয়স মাত্র ৬০, অন্তত ১৫ বছরের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন যাঁর সামনে, তিনি কেন আচমকা অবসরের কথা বলবেন? তেমনই, ত্রিসীমানার মধ্যে যাঁর কোনও চ্যালেঞ্জার নেই, যাঁর ইশারা ছাড়া এখনও হাওয়া বয় না, সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ নরেন্দ্র মোদি কেন বলবেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে চড়া মূল্য চোকাতে হতে পারে, সেজন্য আমি প্রস্তুত আছি’? কীসের বার্তা তা? তবে কি তিনি বুঝতে পারছেন, চাপের মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে? ওই মন্তব্য কি অশুভ কিছুর পূর্বাভাস? ‘প্রেমনিশন’? মোদি কি সত্যিই কিছু অঁাচ করছেন?
সেদিন থেকেই রাজনীতিতে অন্য আলোড়ন। ক্ষমতার অলিন্দ সরগরম। তবে কি মোদি রাজনীতি ছাড়ার ইঙ্গিত দিলেন? ক্ষমতা ত্যাগের আভাস দিলেন? মোদিহীন শাহ মণিহীন ফণী। এমন দিন আসন্নপ্রায় বুঝেই কি তবে অমিত শাহ চাষাবাদের কথা শুনিয়েছেন? পরিণতি অজানা হলেও এটুকু কারও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, মোদি স্বস্তিতে নেই। ঘরে-বাইরের চাপ তাঁর নিদ্রাহরণ করেছে।
বাইরের চাপ বন্ধুবাহিত। আমেরিকাকে মহান করে তুলতে ট্রাম্প যা করছেন, তা অপ্রত্যাশিত। এখন বুঝছেন কি, প্রণব মুখোপাধ্যায় কেন বলতেন বিদেশনীতিতে ব্যক্তি নয়, প্রাধান্য পায় দেশ? উষ্ণ আলিঙ্গনের লোকদেখানো ছবি নয়, দেশের স্বার্থে কঠোর দর কষাকষিই প্রথম ও শেষ লক্ষ্য। গুরুবচন না-মানার ফল মোদি এখন নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন? কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। ট্রাম্পকে ঠেকাতে এখন তিনি পুতিন ও শি জিনপিংয়ের শরণাপন্ন। মুশকিল সেখানেও। ট্রাম্পকে বেশি চটালে ও ঘাঁটালে স্নেহধন্য গৌতম আদানি গাড্ডায় পড়তে পারেন। তাঁর গলায় লটকে রয়েছে আমেরিকার আইনি ফাঁস। বেগড়বাই করলে চেপে বসতে পারে। পাগলে সাঁকো নাড়ালে কী হয়, মোদির তা জানা উচিত ছিল।
বিপদ এভাবেই চারদিক দিয়ে আসে। বাইরের চাপের সঙ্গে বেড়ে চলেছে ঘরের সমস্যা। সেই সমস্যার দু’টি অভিমুখ। একটির কেন্দ্রে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’, যার রাশ রাহুল গান্ধীর হাতে, অন্যটি আরএসএস। রাহুলের অতিসক্রিয়তা সহজবোধ্য। গা-ঝাড়া দিয়ে তঁাকে উঠতেই হবে। পদে-পদে বিব্রত করতে হবে সরকারকে। প্রধানমন্ত্রীকে। সে-কাজ তিনি এবার দক্ষতার সঙ্গে করছেন। নির্বাচন কমিশন ও বিজেপির ‘অশুভ আঁতাত’ নিয়ে যেভাবে কোমর কষেছেন, অর্বাচীনের প্রলাপ বলে তা আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগের জবাব না দিয়ে কিংবা ব্যবস্থা না নিয়ে কমিশন যেসব অবান্তর যুক্তি খাড়া করেছে, রাহুলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে অন্ধ অনুগত গোদি মিডিয়া ও বিজেপি নেতারা যেভাবে তাল ঠুকছেন, তাতে ‘অপরাধ’ ধামাচাপা দেওয়ার তাগিদ স্পষ্ট।
রাহুলের অভিযোগ যদি অসার হয়, কমিশন যদি নিশ্চিত হয় তিনি যা বলছেন তা অসত্য, দাখিল করা প্রতিটি প্রমাণ ভিত্তিহীন এবং তাঁর উদ্দেশ্য সরকার ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অহেতুক হেয় করা, তাহলে এখনই রাহুলের বিরুদ্ধে কমিশনের ফৌজদারি মামলা দায়ের করা উচিত। শপথ নাও, হলফনামা দাও কিংবা ক্ষমা চাওয়ার মতো বোকা বোকা দাবি জানানোর প্রয়োজনই নেই। মনে রাখতে হবে, কমিশনের বিরুদ্ধে রাহুল অভিযোগ জানিয়েছেন কংগ্রেস সদর দফতরে। লোকসভায় নয়। সংসদের রক্ষাকবচ এক্ষেত্রে খাটবে না।
একটি ভাত টিপে হাঁড়ির হাল বোঝার মতো একটি মাত্র বিধানসভা কেন্দ্রে লক্ষাধিক ভুয়া ভোটার থাকার ‘প্রমাণ’ দাখিল করে বিজেপি ও কমিশনের ‘আনহোলি অ্যালায়েন্স’-এর
যে-আখ্যান রাহুল খাড়া করেছেন, তা ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। রাহুল যা করেছেন, তা কমিশনেরই তথ্যভিত্তিক। বাইরের নয়। নকলও নয়। মহারাষ্ট্রে পঁাচ মাসের ব্যবধানে কী করে ৪০ লাখ নতুন ভোটারের জন্ম হয়; রাতারাতি সেই রাজ্যের মানুষ কী করে বিজেপির প্রতি গদগদ হয়ে ওঠে; মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, হরিয়ানায় কী করে সব জনমত– সব সমীক্ষা, সব বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ বিলকুল উল্টে যায়, সেই রহস্যের কিনারা এখনও হয়নি। রাহুল যে ফেলুদা নন, কমিশনও যে মগনলাল নন, তা প্রমাণের দায় রাজীব কুমার ও জ্ঞানেশ কুমারদেরই। অন্য কারও নয়।
গণতন্ত্রে বিরোধীদের চাপ থাকে। কিন্তু তার চেয়ে বড় চাপ সংঘের। মোদি-শাহর ইচ্ছানুযায়ী বিজেপিকে চলতে দেওয়ার লাইসেন্স দিতে সংঘ আর রাজি নয়। নয় বলেই অপ্রতিরোধ্য এই
জুটি আজও পছন্দসই কাউকে দলের সভাপতি বাছতে পারেনি। কোনও না কোনও অজুহাতে জে. পি. নাড্ডার মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। সংঘ চায় তার পছন্দের কাউকে, মোদি-শাহ চান
তঁাদের পছন্দের। টানাপোড়েন অব্যাহত। এর মধ্যেই বড় প্রশ্ন, বয়স ৭৫ পূর্ণ হলে
মোদি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন কি?
যে-নিয়মে লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর যোশি, যশোবন্ত সিং, যশবন্ত সিন্হাদের ‘মার্গদর্শক’ করেছিলেন, সেই নিয়ম এবার নিজের ক্ষেত্রে মোদি কি প্রয়োগ করবেন? আজ এটা আর নিছক প্রশ্ন নয়। এটা চাপ। সংঘ-প্রধান মোহন ভাগবত নানাভাবে সে-কথা মনে করিয়ে মোদিকে চাপে ফেলেছেন। গত মাসেই এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ৭৫ বছর বয়সে কেউ শাল উপহার পেলে ধরে নিতে হবে তঁাকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। মোদির চেয়ে ভাগবত মাত্র ছ’দিনের বড়। এই সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ তঁার জন্মদিন।
১৭ তারিখে মোদির। ভাগবত অবসর নিলে মোদি কি বহাল থাকবেন? জগদীপ ধনকড়ের পদত্যাগ এবং সত্যপাল মালিকের বিদ্রোহ ও মৃত্যু মোদির উপর অন্যরকম চাপ সৃষ্টি করছে। জাট সমাজে আলোড়ন উঠছে। রাজস্থানে বিজেপির মুখপাত্র কৃষ্ণকুমার জানু জাট-অসম্মানের জন্য মোদির সমালোচনা করে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। নাগাল্যান্ডের প্রাক্তন বিধায়ক ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিজেপির একমাত্র মুখপাত্র মোহনলুমো কিকন দল ছেড়েছেন। উপ-রাষ্ট্রপতি পদে অনুগত কাউকে পছন্দ করা কঠিন হচ্ছে। সেখানেও সুর মিলতে হবে সংঘের। রবিবার মোহন ভাগবত রাখঢাক না করে বলে দিলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আজ আর ‘সেবা’ নেই। দুটোরই বাণিজ্যিকরণ চূড়ান্ত। দুর্ভাগ্যের এটাই যে, দুই পরিষেবাই এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। মুঠো যে আলগা হচ্ছে মোদি তা বুঝছেন। অস্বস্তি লুকতে পারছেন না। তঁার জন্য এ বড় সুখের সময় নয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.