Advertisement
Advertisement

Breaking News

Tibet

তিব্বতি ধর্মগুরু নির্বাচনে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ভারতের কী অবস্থান?

দলাই লামার সাম্প্রতিক ঘোষণা, তিনি-ই তাঁর উত্তরসূরি নির্ধারণ করার অধিকারপ্রাপ্ত।

Political tensions in Tibetan pontiff election
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:July 11, 2025 2:24 pm
  • Updated:July 11, 2025 2:24 pm  

বৌদ্ধ ধর্মগুরু দলাই লামার সাম্প্রতিক ঘোষণা, তিনি-ই তাঁর উত্তরসূরি নির্ধারণ করার অধিকারপ্রাপ্ত। এদিকে, চিন চায় বশ্যতা। তাদের মত, দলাই লামা বিচ্ছিন্নতাবাদী, চিনের বাইরে থেকে কোনও ধর্মগুরু নির্বাচনের অর্থ তিব্বতিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আবেগে ঘৃতাহুতি। এই টানাপোড়েনে ভারতের কী অবস্থান? লিখলেন চিরঞ্জীব রায়

Advertisement

বিশ্বে প্রায় ৫০ কোটি, এবং শুধু ভারতেই প্রায় ১ কোটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর কাছে তিনি সাক্ষাৎ ভগবান। মার্টিন লুথার কিং বা গান্ধীজির মতো এক স্বপ্নদর্শী, শান্তির দূত। ৬ জুলাই, ৯০ বছরে পা দিলেন তিনি, হিজ হাইনেস– ‘দ্য দলাই লামা’। তারপরই শুরু হল তঁার উত্তরাধিকারী নয়া অবতার, অর্থাৎ পঞ্চদশতম ধর্মগুরু খুঁজে নেওয়ার পালা। এবং সমস্যা সেই নিয়ে। যে-সমস্যা ছায়া ফেলছে চিন ও ভারত, পৃথিবীর দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর, যাদের মধ্যে ইতিমধ্যেই তেমন বনিবনার সুনাম নেই।

কিছু আধ্যাত্মিক লক্ষণ দেখে তিব্বতের তাকৎসার গ্রাম থেকে মাত্র দু’বছর বয়সে দলাই লামার ‘চতুর্দশ পুনর্জন্ম’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তঁাকে। জেটসুন জামফেল নগাওয়াং লোবসাং ইয়েশে তেনজিন গ্যাৎসো নামকরণ করে তঁাকে নিয়ে যাওয়া হয় লাসার পোতালা প্রাসাদে। শুরু হয় তিব্বতিদের অবতার হয়ে ওঠার শিক্ষা। ১৯৫০ সালে চিনা বাহিনী তিব্বত আক্রমণ করলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে অভিষিক্ত হন তিনি। আচমকাই সাবালক হয়ে উঠতে হয় তঁাকে। এর ঠিক ন’ বছর পরে, তিব্বতে এক গণ-অভ্যুত্থান বিধ্বস্ত করে দেয় চিন সেনা। অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং হয়ে ভারতে পালিয়ে আসেন দলাই লামা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তঁাকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দেন। হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালা হয়ে ওঠে দলাই লামার ঠিকানা।

দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে ভারত-চিন টানাপোড়েন হয়েছে। তঁার উত্তরসূরি নির্বাচন, সেই টানাপোড়েনে, নতুন অধ্যায় ও মাত্রা যোগ করতে পারে। ২০১৯ সালের পর, কিছু দিন আগে, এই প্রথম, ধর্মশালায় একটি ধর্মসম্মেলন হল। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মগুরু ঘোষণা করেন, তঁার প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ একমাত্র তিনি-ই তঁার উত্তরসূরি নির্ধারণ করার অধিকারপ্রাপ্ত। এবং এই প্রক্রিয়ায় চিনের কোনও হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না।

এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চিনের বিদেশমন্ত্রক জানিয়ে দেয়, চিনের সম্মতি নিয়েই পরবর্তী দলাই লামা বাছতে হবে। চিনের মত, দলাই লামা বিচ্ছিন্নতাবাদী– নিজের মতে পরবর্তী ধর্মগুরু নির্ণয় করার চেষ্টা সেই মানসিকতারই প্রতিফলন। চিন, বলা বাহুল্য, এহেন খামখেয়াল মানতে নারাজ। চিনের আইনকানুন, ধর্মাচারণ, ঐতিহাসিক প্রথা মেনেই উত্তরাধিকারী বেছে নিতে হবে।

চিনের এমন মন্তবে‌্য ধর্মশালার তিব্বতীয় নির্বাসিত সংসদ (‘The Tibetan parliament-in-exile’) চিনের দাবি নস্যাৎ করে জানিয়েছে, যে কোনও মূল্যে দলাই লামাকে অপমান করাই চিনের লক্ষ্য। তাই তঁার উত্তরসূরি নির্বাচন কীভাবে হবে সে বিষয়েও তারা শৃঙ্খলার বেড়ি পরাতে চাইছে। স্রেফ রাজনৈতিক কারণে ওরা দলাই লামার প্রতিষ্ঠানটাই কব্জা করতে চায়।
তিব্বতীয় প্রথা অনুযায়ী, দলাই লামার প্রয়াণের পরই তঁার উত্তরসূরির খোঁজ শুরু হয়। যে-শিশু পরবর্তী সর্বোচ্চ ধর্মগুরু হিসাবে ‘শনাক্ত’ হবে, তঁাকে উপযুক্ত করে তুলে দলাই লামার পদে অভিষিক্ত করতে প্রায় দু’-দশক সময় লাগে। কিন্তু দলাই লামা এই প্রথা ভাঙতে চান। কারণ, তঁার আশঙ্কা, এই কুড়ি বছরের নেতৃত্বহীনতা কাজে লাগিয়ে চিন তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের উপর তাদের শাসন আরও কঠোর করে তুলবে। ভারতে পালিয়ে আসা নির্বাসিত তিব্বতীদেরও আশঙ্কা, তিব্বতের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে, দলাই লামার উত্তরসূরি ঘোষণা করে দেবে চিন। তাছাড়া, দলাই লামা যথেষ্ট অশক্ত হয়ে পড়েছেন, তঁার কর্মক্ষমতা, ভক্তদের সান্নিধ্য দেওয়া কমেছে। সে-কারণেও পরবর্তী ধর্মগুরু নির্বাচন জরুরি।

চিনের অনধিকার চর্চা, এমনকী চিন থেকে তিনি পরবর্তী দলাই লামা চান না– এই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করে– ২০২৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত তঁার বই ‘Voice for the Voiceless’-এ লিখেছিলেন, তঁার উত্তরসূরি হবে চিনের বাইরের কোনও স্বাধীন দেশের। এ ইঙ্গিতও তিনি সেখানে দিয়েছেন, ১ লক্ষ ৪০ হাজার নির্বাসিত তিব্বতীর মধ্য থেকেই তঁার পরবর্তী জনকে বাছা যায়, যঁাদের অর্ধেকের বাস ভারতে। তিনি পূর্ণবয়স্ক হলেও বাধ‌া নেই, এমনকী তঁাকে পুরুষ-ই হতে হবে, এমন বাধ্যতাও নেই।

হলুদ-মেরুন জোব্বা, সাদামাটা চটি পরা, দেবদুর্লভ হাসির ‘দ্য দলাই লামা’ ধর্মনিরপেক্ষে সারা পৃথিবীর প্রিয়। চিন অবশ্য তঁাকে সহ্য করে না। তাদের ভাষায় তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী, ‘সন্ন্যাসীর বেশে নেকড়ে’। এবং তঁাকে আদৌ আমল না-দিয়ে চিনের দাবি– শাশ্বত কাল ধরে পরম্পরা ক্রমে ধর্মগুরুর উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার অধিকার তাদের আছে। সেই পরম্পরা, যার শুরু, কিইং বংশের রাজত্বকালে, ১৭৯৩ সালে। তাই উত্তরসূরির নির্বাচন হবে চিনের ভূমিতে।
দলাই লামা নির্বাচনের লাগাম হাতে রাখা মানে চিনের কাছে কোনও ধর্মীয় ঐতিহ্য পালন নয়, এর নিহিত উদ্দেশ্য, তিব্বতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মগুরু নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চিন আগেও করেছে। তিব্বতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্মগুরু দশম পাঞ্চেন লামা প্রয়াত হন ১৯৮৯ সালে। পরবর্তী ‘পাঞ্চেন লামা’ হিসাবে দলাই লামা যে-শিশুটিকে নির্বাচিত করেছিলেন, ছয় বছর বয়সে সে হারিয়ে যায়। তারপর থেকে তার খোঁজ নেই।

যদিও চিনের দাবি, সে সুষ্ঠু স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। সেই বালকের জায়গায় চিন নিজেদের পাঞ্চেন লামা, গ্যালৎসেন নোরবু-কে নির্বাচিত করে। গত মাসেই নোরবু চিন কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি জি জিনপিং-এর সঙ্গে দেখা করে দলের প্রতি তঁার আনুগত্য সুনিশ্চিত করেন।

চিন এটাই চায়। বশ্যতা। অন্যদিকে, দলাই লামা তিব্বতীদের প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক। এবং চিনের সবসময়ের ভয়, তাদের তঁাবেদারি না করা কোনও ধর্মগুরু তিব্বতিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আবেগে আরও ঘি ঢালবে। কিন্তু, পরবর্তী দলাই লামা তাদের দেশ থেকে নির্বাচিত হলে– হয়তো তিনি চিন সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত হবেন এবং তিব্বতের উপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা সুবিধাজনক হবে।

ভারত সরকার যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে ধর্মশালায় দলাই লামা এবং তঁার সঙ্গে আসা হাজারো উদ্বাস্তুদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়। নির্বাসিত তিব্বত সরকারের সংসদ গঠনেও কোনও বাধা দেয়নি। দলাই লামার তিব্বত পুনরাধিকারের দাবিকে সক্রিয় সমর্থন না-জানালেও কখনও প্রতিবাদও করেনি। বরং ভারতে দলাই লামা বেশ জনপ্রিয়ই হয়ে উঠেছেন। স্বভাবতই চিনের তা পছন্দ হওয়ার কথা ছিল নয়, এবং এ নিয়ে ভারত-চিনের মনকষাকষিও হয়েছে।
তবে গত নয় মাসে ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ধীরে হলেও উন্নত হচ্ছে। যদিও ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফ থেকে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন পাকিস্তানের পাশে চিনের দঁাড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে এটাও বাস্তব, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষের উত্তাপ আপাতত নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফের দু’-দেশের মধ্যে বিমান চলাচল শুরু করার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ পঁাচ বছর বন্ধ থাকার পরে কৈলাস-মানস সরোবর যাত্রা ফের শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে কোভিড ১৯ মহামারীর কারণে চিন যাত্রা বন্ধ করে দেয়। কোভিডের ছায়া সরে গেলেও গালওয়ান উপত্যকায় দু’-দেশের সীমান্ত-সংঘর্ষের জেরে যাত্রা শুরু করা যায়নি।

দু’-দেশের সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক লেনদেনও আপাতত স্বাভাবিক। কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা বাড়িয়ে সম্পর্ক আরও সাবলীল করার চেষ্টা চলছে। তারই পদক্ষেপ হিসাবে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর আগামী ১৩ জুলাই ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ (এসসিও)-র বিদেশ মন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দিতে চিনে যাচ্ছেন। এবং সেটা হলে, ২০২২ সালের গোড়ায় চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র ভারত সফরের পর এটাই হবে বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে প্রথম দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এসসিও-র বৈঠকে যোগ দিতে গত মাসে চিন গিয়েছিলেন। গত অক্টোবরে রাশিয়ায় ‘ব্রিক্‌স’ শীর্ষ সম্মেলন চলাকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-শি জিনপিং-এর সঙ্গে বৈঠক করেন। তারই সূত্র ধরে দু’বার চিন সফর করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।

দু’-দেশের সম্পর্কের বরফ গলছে, এমন একটা সময় দলাই লামা নির্বাচন নিয়েও ভারত কোনও বিতর্কে জড়িয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের ধর্মগুরু নির্বাচনের দাবির বিরোধিতা করে প্রকাশ্যেই দলাই লামার পাশে দঁাড়িয়েছে। ভারতের সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু প্রথমটায় দলাই লামার সিদ্ধান্ত সমর্থন করে জানিয়েছিলেন, আর কোনও পক্ষ নয়, একমাত্র সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর ‘গাদেন ফোদরং ফাউন্ডেশন অফ দ‌্য দলাই লামা’-ই উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু সেই বক্তব্যকেও নিছক ‘এক ভক্তের ব্যক্তিগত মতামত’ বলে সুর পালটেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারত ধর্মাচার এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সম্বন্ধীয় বিষয়ে কোনওরকম অবস্থান নিতে বা মন্তব্য করতে চায় না। ভারত বরাবর ধর্মাচারণের স্বাধীনতাকে স্বীকার করেছে এবং অগ্রাধিকার দিয়েছে, ভবিষ্যতেও তাই করবে।
অর্থাৎ, দলাই লামার উত্তরসূরি নির্ধারণ নিয়ে চিনের সঙ্গে এই যে টানাপোড়েন তা থেকে সযত্নে দূরত্ব বজায় রেখে নিরপেক্ষ থাকাই ভারতের নীতি। ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না– এই অবস্থানে দলাই লামা বা তঁার অনুগামীদের রুষ্ট হওয়ার কোনও কারণ নেই। উল্টোদিকে, এই প্রসঙ্গে ভারত নাক না গলাক, চিন তো সেটাই চায়!

(মতামত নিজস্ব)

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement