Advertisement
Advertisement
Social Media

গোয়েবল্‌স যদি পেতেন এখনকার সমাজমাধ্যম! আরও তাণ্ডব চালাত গেস্টাপো

সোশাল মিডিয়ায় মিথ্যার ফুলঝুরি বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতাকেও পিছনে ফেলে দিচ্ছে।

Proliferation of lies on social media is even surpassing the scale of World War II
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:July 9, 2025 12:55 pm
  • Updated:July 9, 2025 12:55 pm   

গোয়েবল্‌সের হাতে যদি এখনকার সোশ্যাল মিডিয়া থাকত তাহলে কী হত– ভাবতে শিউরে উঠতে হয়। ভয়ংকর জার্মান বাহিনী আরও কত না তাণ্ডব চালাত বিশ্বজুড়ে! ভারতের গোয়েবল্‌সদের থামাতে সরকার কী ভাবছে? উত্তর অজানা। কারণ সরষের মধে্য ভূতের বাস। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক

Advertisement

ফেসবুক বুঝতে এবং শিখতে অামার বেশ সময় লেগেছিল। তবে অচিরেই বুঝতে পারি, নিজেকে জাহির করার এই মাধ্যমে অতি ব্যক্তিগত বিষয় এবং নিজস্বতার নিরাপত্তা অাসলে বেঅাব্রু হয়। তবে এখনকার যুগে সমাজমাধ্যম বাদ দিয়ে অাপনি চলবেন কী করে! ফেসবুক, এক্স পোর্টাল, ইউটিউব তো পাড়ার গোপালদার চায়ের দোকানের মতো প্ল্যাটফর্ম। যেখানে বসে সময় দিয়ে কাগজ পড়তে-পড়তে চা-টা খেতে হয়, না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়।

চায়ের দোকান একটি খবরের দশকর্মা ভাণ্ডার। হাসিনা কেন পালিয়ে এল, পাকিস্তানের হাতে ক’টা পরমাণু বোমা, ব্যাঙ্কে অাধার লিঙ্ক কত দিন বাড়ল, ইলিশের দর কত যাচ্ছে, মিত্তিরবাড়িতে ভরদুপুরে কে যেন অাসে থেকে কোহলিজায়া অনুষ্কার বেবি বাম্প– দুনিয়ার সব খবর নিয়ে অালোচনা, মত বিনিময়, তর্কবিতর্ক, মায় হাতাহাতিও হয় চায়ের দোকানেই। হরেক কিসিমের মানুষের হরেক মত, হরেক তথ্য। হরেক সংলাপ।

সমাজমাধ্যমও খানিক তাই। সেখানে হাজির বিশ্ব। সব মানুষ সবাই সবাইকে দেখছে। সবাই বলছে, লিখছে, পড়ছে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলছেই। কুৎসা তো নিত্য। তাও একে এড়িয়ে চলা মানে পিছিয়ে পড়া। তাই যতক্ষণ না ‘বিকল্প’ কোনও প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে– ততক্ষণ গা ভাসিয়ে সঁাতার কাটা ছাড়া গতি নেই। চোরাস্রোত হয়তো পা ধরে টানবে। জলজ প্রাণীর অাক্রমণের মতো কখনও ঘূর্ণিতে পড়ে ডুবে মরার উপক্রম হবে। তবু চিতসঁাতার দিয়ে ভাসতে হবেই।

এই যে বারাসাতে এত ঘরের বউ পালাচ্ছে বলে খবর এল, তা কী অার এমনি! সমাজমাধ‌্যমে প্রদর্শিত লোভ-লালসায় মজে নকল প্রেম। মাঝরাতে ‘মিস ইউ’ এসএমএস পড়তে-পড়তে বদলে যাচ্ছে মন। বিভোর হচ্ছেন যারা, তারা ভুলেই যাচ্ছে, একপাড়া লোক নেমতন্ন করে বাবা বিয়ে দিয়েছিল। সাজানো সংসার, আত্মীয়পরিজন, সমাজ অাছে, কিন্তু মন উচাটন। নতুন ‘সুখ’ পেতে হবে। উদ্‌ভ্রান্তের মতো সন্তানকে ফেলে রেখে পালাচ্ছে মা। বউকে ফেলে অাবার বিয়ে স্বামীর। সমাজমাধ্যমে বঁুদ হয়ে বখে যাওয়া হাজার-হাজার কিশোরের কথা অার নাই-বা বললাম। সমাজ দূষণ। সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের বেশ সুবিধা হয়েছে। তাদের স্বার্থসিদ্ধি ও অাত্মপ্রচারের দারুণ ব্যবস্থা। মিথ্যা প্রচারের উপায়। নিজেদের পেটোয়া পোর্টালে তিলকে তাল।

এ-কথা সত্যি, স্মার্টফোন মানুষের জীবনযাত্রায় অামূল পরিবর্তন এনেছে। অনেক কঠিন কাজ সহজ হয়ে গিয়েছে। হাতের মুঠোয় দুনিয়া। হাতে মোবাইল থাকলে বাড়ি বসেই ব্যাঙ্কের কাজ করা যায়, শপিং করা যায়, সবজি বাজার করা যায়, সিনেমা দেখা যায়, ট্রেন-বাস-বিমানের টিকিট কাটা যায়, চাকরিস্থলে না গিয়েও ‘কাজ’ করা যায়, এমনকী, প্রেমও করা যায় চুটিয়ে।

একদা সমাজে ‘ভালো’ এবং ‘মন্দ’-র দূরত্ব ছিল অসীম। সমস্যা হচ্ছে, সমাজমাধ্যম এ দু’টিকে খুব কাছে এনে দিয়েছে। বিপরীতমুখিতার ফারাক অার মনে অনুরণন তোলে না। খারাপটা কেমন গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। বড় কিছু ঘটলেও কেমন চুপ করে থাকি। ‘অামি বেশ অাছি’, এমনই মত অনেকের।

রিল্‌স অারও এক নেশা। ড্রাগের মতো। একবার দেখতে বসলে কখন চলে যায় সময়। সত্য-মিথ্যার যাচাই নেই। যে-যা পারছে ‘পোস্ট’ করে দিচ্ছে। সমাজ-সংসারের যে বিধিনিষেধ, মূল্যবোধ, তৎসহ নীতিমালা ছিল– তা চুরমার। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও নির্বোধ, মানবিক ও অমানবিক, হৃদয়বান ও ধান্দাবাজ, অলস ও পরিশ্রমীকে একই প্ল‌্যাটফর্মে দঁাড় করিয়ে দেওয়ার এমন কুব্যবস্থা অাগে ছিল না।
মিথ্যা, কুৎসা, চরিত্রহনন মানুষ অাগেও করেছে। নিজেকে সব চেয়ে উন্নত বলে দাবি করা জীবের সেটি প্রাগৈতিহাসিক স্বভাব। কিন্তু প্রকাশ করার এত সহজ ব্যবস্থা অতীতে ছিল না। মাধ্যম এত শক্তিশালী ছিল না। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর মানুষ একা। তাকে অারও একা করেছে এই মাধ্যম। একা হওয়ার জোয়ারে গা ভাসিয়েছে বিশেষ করে নবীনরা। ঘরের ভিতর থাকা মানুষ। মূলত গরিব-মধ্যবিত্ত বেশি সোশাল মিডিয়া নিয়ে উৎসাহী। এখন পেটে ভাত না-থাকলেও হাতে সবার মোবাইল।

মিথ্যা একটা তত্ত্ব। হিটলারের অনুচর নাৎসিদের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবল্‌স মিথ্যাকে বারবার বলতে নিদান দেন। তার নীতি ছিল– ‘If you tell a lie big enough and keep repeating it, people will eventually come to believe it.’ সেই গোয়েবল্‌সের হাতে যদি এখনকার সোশ্যাল মিডিয়া থাকত তাহলে কী হত– ভাবতে শিউরে উঠি। ভয়ংকর জার্মান বাহিনী অারও কত না তাণ্ডব চালাত বিশ্বজুড়ে। গোয়েবল্‌স জানতেন, তিনি যা করছেন বিদ্রোহ হলে সবার অাগে তঁাকে মরতে হবে। তাই হিটলারের মৃত্যুর পরদিন স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে হত্যা করে নিজে অাত্মঘাতী হন।

সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ডাহা মিথ্যার কথা বলি। সোশ‌্যাল মিডিয়ায় সম্প্রতি একটি ছবি ‘ভাইরাল’ হয়। বাবা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা লতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাঝে বসে অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায়। পুরনো সাদা-কালো ছবি। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তখন নেহাতই শিশু। বাঙালি এমন ছবি দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখে। পুত্রকে নিয়ে বাবা-মায়ের নির্মল ছবিটি রাজনীতির শিকার হল। সমাজমাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীকে জড়িয়ে কদর্য অাক্রমণ। বিরোধীদের মদতে নর্দমার পঁাক ভাইরাল। প্রচার করা হল, অমিতবাবু নয়, এটি জনৈক ব্যক্তির ছবি। অার লতাদেবী নয় এটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! দাবি, পুত্রসন্তানটি তাঁদের।
ভাবা যায়! কোনও অতলে চলেছে সমাজ। মমতা কোনও অচেনা-অজানা চরিত্র নন। খুব অল্প বয়স থেকে তঁার রাজনীতিতে উত্থান, লড়াই, ভোটে জেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া। জমি অান্দোলন করা থেকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব, সবার সবকিছু জানা। তিনি সংসারী নন। অকৃতদার মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কুটিল মিথ্যা নগ্ন করল বাঙালির সম্মান। যারা করল, তাদের একবার মনে হল না, কী করছে!

মিথ্যা যদি এই স্তরে নামে, তাহলে সমাজ থাকে না, বিবেক-বিবেচনা রাজনীতি কিছুই থাকে না। রাজনৈতিক দল শাসককে নিশ্চয়ই রসগোল্লা খাওয়াবে না। কিন্তু অাক্রমণ একটি স্তর অবধি হয়। সীমা থাকে। চরিত্রহনন করব বলে এভাবে সম্মানহানি করা যায় না। যতক্ষণ তিনি চেয়ারে অাছেন, ততক্ষণ তিনি বাংলার  অভিভাবক, মুখ্যমন্ত্রী।

মিথ্যা সফল হয়নি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার সমস্যা বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়ে গেলে অার ফেরত যেমন অানা যায় না, তেমনই। ভুল কিছু হলে খবরের কাগজ পরের দিন রিজয়েন্ডার ছাপতে পারে। টিভি চ্যানেল খবরটি তুলে নিতে পারে। কিন্তু রিল্‌স বা পোর্টালে ছড়িয়ে গেলে তা কোথায় চলে যাবে কেউ জানে না। কারও দায় নেই, দায়িত্ব নেই। বহু মানুষ মিথ্যাকেই সতি্য মনে করে।

ভোটের সময় এমনই অসংখ্য মিথ্যা প্রচারে অানা হয়। ভোজপুরী ছবিতে নারী নির্যাতন পশ্চিমবঙ্গের বলে চালানো হয়। বাংলাদেশের দাঙ্গার ছবি পশ্চিমবঙ্গে বলে দাবি করা হয়। সাম্প্রতিক, ভারত-পাক সংঘর্ষকে সামনে রেখে ভিডিও গেমকে যুদ্ধ বলা হয়েছিল। বালুচিস্তান স্বাধীন হয়নি, পাক সেনাপ্রধান সরে যাননি, দখল হয়নি লাহোরও। মুখ্যমন্ত্রী অক্সফোর্ডে বক্তৃতা দেওয়ার ডাক পেয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে সম্মানের বিষয়। কেলগ কলেজ অক্সফোর্ডের অংশ। কিন্তু তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন মিথ্যা প্রচার করা হল, যা নিন্দনীয়।

দুর্ভাগ্য ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইউটিউবের যুগে কে সাংবাদিক অার কে নয়, সেটা খঁুজে পাওয়া ভার। সবার হাতে তরবারি। সবার হাতে খবর শাসনের ভার। যার-যা খুশি লিখে দিচ্ছে। বলে দিচ্ছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচার করা হচ্ছে। দাঙ্গা যাতে লাগে তার চেষ্টা করা হচ্ছে। সতি্যই এখন বড় দুঃসময়। গরলের গ্রাসে নিমজ্জিত এই সমাজকে বঁাচাবে কে? এই মিথ্যার ফুলঝুরি বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতাকেও পিছনে ফেলে দিচ্ছে। সমাজকে অারও পচাগলা করে তুলছে। কীভাবে এই ব্যবস্থা থেকে মুক্তি?

সাইবার ক্রাইম ও সমাজমাধ্যমে মিথ্যাচার রুখতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। চাই এমন কড়া অাইন, যাতে মিথ্যার বেসাতি করতে ভয় পায়। কিন্তু কেন্দ্র কী করবে? বর্তমান অাইনে যে কিছু করা যাচ্ছে না তা তো পরিষ্কার। ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাক্ট’ বা ‘ডিএসএ’ অাইন চালু করার ফলে ইউরোপে সমাজমাধ্যমে মিথ্যা রটনা অনেক কমেছে। এ ব্যাপারে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। ‘এঅাই’ প্রযুক্তির সাহা়য্য নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভারতের গোয়েবল্‌সদের থামাতে সরকার কী ভাবছে? উত্তর অজানা। কারণ সরষের মধে্য ভূতের বাস।
(মতামত ব্যক্তিগত)

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ