ফাইল ছবি
রাজদীপ সরদেশাই: ভারতের নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) প্রতি বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধীর তীব্র আক্রমণের ফলে নির্বাচন ঘিরে তরজা ও বিতর্ক তুঙ্গে। এ-কথা প্রমাণিত, আমরা যে অতি-মেরুকৃত সময়ে বসবাস করছি, সেখানে জনমত তীব্রভাবে বিভক্ত। মোদি সমর্থকরা তেড়েফুঁড়ে উঠেছে। তাদের অভিযোগ– রাহুল ইচ্ছাকৃত মিথ্যাপ্রচার করছেন– নিষ্কলুষ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে যেচেপড়ে অসম্মান করার জন্য। অন্যদিকে রাহুল-ভক্তদের মত, তিনি-ই একমাত্র বিরোধী নেতা, ক্ষমতায় থাকা সরকারের বিরুদ্ধে যিনি নির্ভয়ে কণ্ঠ হেঁকেছেন সমালোচনার। কিন্তু এই চিৎকৃত পরিসরে, যে-কথাটি উহ্যই থেকে যাচ্ছে তা হল, ভারতের নির্বাচন কি ‘অবাধ’ ও ‘সুষ্ঠু’?
আমার অভিমত: ভারতীয় নির্বাচন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘অবাধ’, তবে সর্বৈবভাবে ‘সুষ্ঠু’ নয়। স্বাধীনতার পরপর যখন জওহরলাল নেহরু (হ্যাঁ, তাঁকে ‘বিখ্যাত’ না কি কুখ্যাত কী বলব জানি না, তবে অত্যন্ত উপহাসের পাত্র কট্টর আদর্শবাদী সেই নেহরুজি-র কথাই আপাতত বলছি) সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের জন্য জোর দিয়েছিলেন, তখন অনেকেই এটিকে ইতিহাসের ‘সবচেয়ে বড় জুয়া’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, এমনকী সতর্কতাবাণীও চাউর হয়– এমন একটি পরিকল্পনা একটি নতুন প্রজাতন্ত্রকে আরও ভাঙনের দিকে ধাবিত করবে। ১৮টি সাধারণ নির্বাচনের পর, স্পষ্টত দাবি করা যায় যে, নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি ‘জুয়া’ নয়, ছিল একটি লাভজনক বিনিয়োগ।
বাস্তবও সে-কথা জানান দিচ্ছে। ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচনটি প্রায় ছ’-মাস ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কারণ, সেবার প্রতিকূল আবহাওয়া এবং আয়োজনের দিক থেকে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। মোট ১.৯৬ লক্ষ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৭,৫২৭টি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। যোগ্য ও বৈধ ভোটার সংখ্যা প্রায় ছিল ১৭.৩২ কোটি, ভোটদানের হার ছিল ৪৫ শতাংশ। এদিকে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে যোগ্য ও বৈধ ভোটার সংখ্যা ছিল ৯৬.৮ কোটি। ১০.৫ লক্ষ বুথে ৬৪.৬ কোটি ভোটার অর্থাৎ ৬৫.৯ শতাংশ ভোট পড়েছে, যার মধ্যে ৩১.২ কোটি মহিলা– যা যে কোনও নির্বাচনে নারীদের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ।
এত বড় দেশে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা চাট্টিখানি কথা নয়! ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে বুথ দখল করা, বা জাল ভোটারদের দাপাদাপি এখনও অস্তমিত হয়ে যায়নি। ১৯৯০ সালে, মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের সময়, মুম্বইয়ের উমেরখাদি এলাকায় একবার ‘বুথ দখল’ দেখেছিলাম স্বচক্ষে। সেবার মুখোমুখি মুসলিম লিগ ও শিবসেনা।
আমরা দেখলাম: দু’-পক্ষের ভাড়া করা গুন্ডাবাহিনী আধা-ঘুমন্ত স্থানীয় পুলিশকে দাবড়িয়ে, বুথ দখল করে বহাল তবিয়তে ব্যালট পেপারে যে-যার পক্ষের ছাপ্পা ভোট দিতে ব্যস্ত। এটা ইভিএম-পূর্ব, টিলিভিশন-পূর্ব যুগের কথা। তা সত্ত্বেও ফিল্ড রিপোর্টার ও সাংবাদিকদের জোরে ছাপ্পা কাণ্ড ফাঁস হয়ে যায়, এবং পুর্নিবাচন করতে হয়। ২০২৪ সালে উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশে, বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়, স্থানীয় পুলিশ কর্তৃক ভোটার-দমনের উদ্বেগজনক প্রতিবেদনও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কী, ভোটাররা আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন এবং ক্ষমতায়িত।
মনে আছে, হরিয়ানায় একবার কাজের সূত্রে একটি দলিত গ্রামে গিয়েছি। সেখানকার বাসিন্দারা আমাকে বলেছিল যে, তাদের দাদু-ঠাকুমার আমলে সুষ্ঠুভাবে ভোট দেওয়া একপ্রকার অসম্ভব ছিল। কারণ জাট দাবাংরা আশপাশে আতঙ্কের ‘মাহোল’ তৈরি করে রাখত। হালে জাত-বর্ণের ভেদাভেদগত মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটেছে অনেকখানি, এবং ২৪x৭ মিডিয়ার নজরদারির কারণে পরিস্থিতি অনেকখানি বদলেছে। এক অর্থে, ভোটের দিনটিতে একটি চরম অসম সমাজে, নাগরিক ক্ষমতার একটি অত্যন্ত বিরল ‘সমতা’-র উদ্যাপন, দর্শিত হচ্ছে। ভোটের দিনে জামনগরের তেল শোধনাগারের দিনমজুর ও মুকেশ আম্বানির মধ্যে ফারাক ক্ষীণ হয়ে আসে– ভোটাধিকার জোরে। সেদিন ধারাভির বস্তিবাসীও গৌতম আদানির মতো মাথা উঁচু করে ভোটকেন্দ্রে যায়।
নির্বাচনী গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর প্রতি বিশ্বাস। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিটি প্রার্থী এবং দলকে একই সূচনাবিন্দু থেকে শুরু করতে হবে। এটি মেনে চলার পরিবর্তে, এখন আমাদের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ তির্যক প্রতিযোগিতা চলছে– যেখানে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে অনেক বেশি ও অনিয়ন্ত্রিত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। অর্থ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নির্লজ্জ অপব্যবহারে নাভিশ্বাস উঠছে আমজনতার। অর্থক্ষমতা আগে ছিল না এমন নয়– যখন কংগ্রেস ভারতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তখনও তহবিলের জোর সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতার মর্মার্থকে ছাপিয়ে যেত। তবে এও মনে রাখতে হবে, নির্বাচনী যুদ্ধে অর্থ একমাত্র নির্ণায়ক নয়, নগদ শুধুমাত্র সমৃদ্ধ দলগুলিকে উল্লেখযোগ্য কিছু বাড়তি সুবিধা প্রদান করে মাত্র।
মোটা অঙ্কের অর্থ প্রায়শই রাজনৈতিক বিভাজনকে ভেঙে দেয়। আসল ‘খেলা’ হল– কীভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ আধিপত্যের জন্য ‘অস্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ধারণা কতখানি বিকৃত। নির্বাচনের আগে, এই প্রতিযোগিতাকে পুষ্ট করতে, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিও নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে নির্লজ্জভাবে বৈমাতৃকসুলভ আচরণ করে। ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট’-এর প্রাথমিক কাজ হয়ে দঁাড়িয়েছে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্লজ্জভাবে তুলোধনা করা। ফলে বিরোধী নেতারা পান থেকে চুন খসলে গ্রেফতারের ভয়ে ভোগেন, ২০২৪ সালের দিল্লি নির্বাচনের আগে আপ এবং কংগ্রেস সমর্থকদেরও তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মার খাওয়ানো হয়।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহারের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে প্রবেশ হয়ে ওঠে আরও সহজ। নির্বাচনী করদাতাদের টাকা নয়ছয় করে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভোটারদের মধ্যে বিরাট অঙ্কের টাকা দানখয়রাতি করা শাসক দলের একটি পুরনো রেওয়াজ। কয়েক বছর আগে, প্রধানমন্ত্রী মোদি এই ‘রেওয়াড়ি’ (বিনামূল্যে) রাজনীতি নিয়ে বিরাট বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন। আবার সেই বিজেপি এখন আবার ‘ভোটের জন্য নগদ’ খেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, কখনও মহারাষ্ট্রের ‘লড়কি বহেন প্রকল্প’ বা বিহারের ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’-র মতো জনমুখী প্রকল্পের আড়ালে মহিলাদের ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত ভাতা দিয়ে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেই গণমাধ্যমের আখ্যান নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ক্ষমতাসীন দলটি নির্বাচন-পূর্ব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের তহবিল সংগ্রহের জন্য সরকারি অর্থ ব্যবহার করে। এবং এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে বিরোধী দল প্রায়শই প্রায় সম্পূর্ণরূপে ‘অদৃশ্য’ হয়ে যায়– যা জনসাধারণের মানসিকতাকে প্রায় একমুখী করে তোলে। নির্বাচনের সময়ের আর-এক গেরো হল পেড নিউজ এবং অর্থের আস্ফালন, যা মারণরোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে গণতন্ত্রের আনাচকানাচে। ফলে আমাদের ‘অন্ধের যষ্টি’ ‘ইসিআই’। কিন্তু তারা কি দায়িত্ব পালন করে যথাযথ? যখন নির্বাচনী তালিকায় ভোটারদের রহস্যজনক সংযোজন, এবং বাদ পড়ার খবর প্রকাশিত হল, তখন ইসিআইয়ের প্রতিক্রিয়া: বিহারে ‘এসআইআর’ চালু হোক যাতে অব্যবস্থাপনার খানিক হদিশ পাওয়া যায়। এমনকী, যখন কর্নাটকে সম্ভাব্য ভোটার জালিয়াতির জন্য এফআইআর দায়ের করা হয়, তখনও ইসিআই পুলিশ তদন্তে অনিচ্ছুক। ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন– যারা ন্যায্যতার সঙ্গে কাজ করবে ও জনগণ তা দেখতে পাবে। দুঃখের বিষয়, তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ আম্পায়ার এখন কেবল একপক্ষের হয়ে ব্যাটিং করতে মত্ত।
পুনশ্চ: ‘নেটফ্লিক্স’ সম্প্রতি ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনের উপর একটি বায়োপিক তৈরির কাজ শুরু করেছে। গণিতবিদ থেকে সরকারি কর্মচারী হয়ে ওঠা সুকুমার সেনের কথা খুব কম লোকই জানেন, তবে আধুনিক ভারতীয় গণতন্ত্রের নির্মাতা হিসাবে তাঁর উত্তরাধিকার নিশ্চিত। আশা করি, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকে ছবিটি মুক্তি পেলে দেখবেন এবং অনুপ্রাণিত হবেন। এমন একটি নির্বাচন কমিশনের এখন আমাদের দেশে খুব প্রয়োজন, যা মেরুদণ্ড ঋজু ও পুনরুজ্জীবিত করবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.