আমেরিকা বারবার দাবি জানিয়েছে, তারা-ই বাণিজ্যের হুমকি দিয়ে যুদ্ধবিরতি করিয়েছে ভারতকে। এত আজ্ঞাবহ হওয়া সত্ত্বেও ২৫ শতাংশ শুল্ক ও জরিমানা চাপিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফি-দিন কোণঠাসা করছেন নরেন্দ্র মোদির ভারতকে! লিখছেন সৌম্য বন্দ্য়োপাধ্যায়।
পহেলগাঁও কাণ্ড ও ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে লোকসভা ও রাজ্যসভায় তিনদিন ধরে ৩২ ঘণ্টা আলোচনা সত্ত্বেও ১০০ দিন ধরে যে-প্রশ্নগুলো দেশবাসীর মন তোলপাড় করছিল, সেগুলোর একটারও সদুত্তর পাওয়া গেল না। নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকারকে এত অসহায় অনেক দিন দেখা যায়নি। এতটা ল্যাজে-গোবরেও কখনও হয়নি। বোঝা গেল, কেন এত দিন ধরে এই দুই বিষয়ে চর্চার জন্য বিরোধীদের দাবি মেনে মোদি সরকার সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকেনি। আজকালকার নীতিহীন রাজনীতিতে সাধ করে কেউ-ই বেইজ্জত হতে চায় না। কী-কী প্রশ্ন এখনও অনুচ্চারিত রইল? একেবারে শুরু থেকে একে একে দেখা যাক।
সরকারের দাবি, পহেলগাঁওয়ের জঙ্গিরা পাকিস্তানি। তা সত্য হলে সংগত প্রশ্ন, কী করে তারা নির্বিঘ্নে সীমান্ত পেরিয়ে পহেলগাঁও পৌঁছল? কাদের ব্যর্থতায়? তারা কারা? কী শাস্তি হয়েছে তাদের? না হলে কেন হয়নি? এই প্রশ্নগুলোর একটারও জবাব সরকার দিতে পারেনি। বিরোধীরা দুই কক্ষে সরকারকে ফালাফালা করেছে। বলেছে, নিরাপত্তার ভার তো অমিত শাহর! কেন তবে দায়ভার মাথায় নিয়ে তিনি সরে গেলেন না?
ব্যর্থ তিনি শুধু এই ক্ষেত্রেই নন। পুলওয়ামা কাণ্ডও তাঁর আমলেই। এখনও পর্যন্ত সেই রহস্যও অনুন্মোচিত! কেউ কেউ তাঁকে ‘নির্লজ্জ’ বলতেও দ্বিধা করেনি। বলেছে, কম সে কম নিহতদের পরিবারের কাছে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল, অপদার্থতার দায়ে। তাও করেননি। পদত্যাগ তো নয়-ই। উল্টে দীর্ঘতম সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার জন্য অনুগতদের বাহবা কুড়োচ্ছেন। পহেলগাঁওয়ের বদলা ‘অপারেশন সিঁদুর’।
যুদ্ধ মাত্র তিনদিনের। চতুর্থ দিনেই যুদ্ধবিরতি। পুলওয়ামার বদলায় বালাকোটে সার্জিকাল স্ট্রাইক হয়েছিল। সেবার সেনা সাফল্য নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। কেননা, শত্রু শিবিরের ক্ষয়ক্ষতির হাতেগরম প্রমাণ হাজির করা যায়নি। সে থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার ভারত আক্রমণের গাদা গাদা ছবি ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে তাই বলে প্রশ্ন ওঠার বিরাম নেই। বিতর্কও অন্তহীন। সরকারকে বিরোধীরা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছে। একটারও জবাব না দিয়ে সরকার শিখণ্ডী খাড়া করেছে কংগ্রেসকে, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে। অন্তঃসারশূন্য ভাষণ ও ভক্তজনের ‘মোদি মোদি’ স্লোগানের আড়ালে লজ্জা ঢাকতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদরা। এতটা অসহায় তঁাদের কখনও দেখায়নি।
প্রশ্নের ছড়াছড়ি। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কেন ওয়াশিংটন থেকে এল? তাহলে কি তারাই মধ্যস্থতাকারী? অথচ ভারত তো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের বিরোধী! তাহলে কি ধরে নিতে হবে সেই নীতি থেকে ভারত সরে এসেছে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার সেই দাবিই জানিয়ে আসছেন। বিরামহীন বলে চলেছেন, তিনিই বাণিজ্যের হুমকি দিয়ে যুদ্ধবিরতি করিয়েছেন। দাবি অসত্য হলে প্রধানমন্ত্রী কেন তা খণ্ডন করলেন না?
রাহুল গান্ধী রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, ইন্দিরা গান্ধীর সাহসের পঞ্চাশ ভাগও যদি
থেকে থাকে, তাহলে প্রধানমন্ত্রী বলুন, ট্রাম্প মিথ্যেবাদী। বলুন, তিনি যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নামেননি। অথচ আশ্চর্য, মোদি-শাহ, রাজনাথ বা জয়শঙ্কর একজনও ট্রাম্পের নাম নিলেন না! তেরোবার নেহরুর নাম উচ্চারণ করেছেন মোদি, ট্রাম্পের নাম একবারও নয়! ‘পৃথিবীর কোনও দেশ যুদ্ধ থামাতে চাপ সৃষ্টি করেনি’ বলে চ্যালেঞ্জ এড়িয়েছেন, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেননি। ট্রাম্পকে ‘মিথ্যেবাদী’ বলার দরকার ছিল না। ‘মিথ্যেবাদী’ অসংসদীয় শব্দ। কিন্তু মোদি বলতেই পারতেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অথবা ভাইস প্রেসিডেন্ট জে. ডি. ভান্স যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দেননি। মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাতেও তাঁরা নামেননি। যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত আমরাই নিয়েছি। স্বেচ্ছায়।’
যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত যে ভারতেরই, পাকিস্তানের অনুরোধে, সে দাবি ভারত আগেই জানিয়েছে। সংসদেও বলেছে। মোদি তো জাতির প্রতি ভাষণে বলেছিলেন, আমরা এমন মার মেরেছি যে, পাকিস্তান প্রাণে বাঁচতে আমাদের হাতে-পায়ে ধরেছে। ওদের ডিজিএমও আমাদের ডিজিএমওকে ফোন করে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা মেনে নিয়েছি। এখানেও প্রশ্ন, কেন পাক আকুতি মানা হল, তা নিয়ে। বিরোধীদের, বিশেষ করে কংগ্রেসকে, সেই প্রশ্ন করার সুযোগ মোদি-ই করে দিয়েছেন। বলা ভাল, নিজেদের যুক্তিজালেই তঁারা নিজেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছেন।
ভারত ভাগ, কাশ্মীর নীতি, ৩৭০ অনুচ্ছেদ, আকসাই চিন, পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ইত্যাদির জন্য বিজেপি বরাবরই দায়ী করে কংগ্রেসকে। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এ নিয়ে সমালোচনার মাত্রা ও তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছেন বহুগুণ। যত বেশি তিনি সমালোচিত হচ্ছেন, তত বেশি শাপশাপান্ত করছেন কংগ্রেসকে। নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীকে দায়ী করেছেন দেশকে
রসাতলে পাঠানোর জন্য। পাকিস্তানকে দু’টুকরো করার কৃতিত্ব ইন্দিরাকে না দিয়ে তিনি বরং
প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে মুঠোয় পেয়েও কেন ইন্দিরা পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের দখল নেননি, তা নিয়ে। সেই প্রশ্নই এবার তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে বিরোধীরা।
সরাসরি জানতে চেয়েছে, তিনদিনের হামলায় পাকিস্তান যদি নতজানু হয়ে হাতে-পায়ে
ধরেই থাকে, মোদির ভারত কেন তাতে গলে গেল? কেন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হল?
এই উত্তরও অনুচ্চারিত রইল এই কারণে যে, সেই ব্যাখ্যায় গেলে ট্রাম্পের দাবির সত্যতাই মেনে নিতে হয়।
অনুচ্চারিত রইল আরও কত কিছু। তিনদিনের যুদ্ধে ভারতের ক’টা রাফাল, সুখোই ও মিগ ধ্বংস হয়েছে সেই খতিয়ান সরকার এখনও দিল না। প্রাথমিক রটনা ছিল ছ’টা। সিডিএস জেনারেল অনিল চৌহান সেই প্রশ্ন শুনে বলেছিলেন, বাজে কথা। তাহলে ক’টা? জানা যায়নি। পাকিস্তানের দাবি পঁাচটা। যদিও তারাও প্রমাণ দিতে পারেনি। জেনারেল চৌহান ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেছেন। বলেছেন, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে রণনীতির পরিবর্তন করে সাফল্য পেয়েছি। ক্রিকেটের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ক’টা উইকেট পড়ল সেটা বড় নয়, বড় কথা জয় হয়েছে কি না। লোকসভায় একই কথা অন্যভাবে বলেছেন রাজনাথ সিং। পরীক্ষার রেজাল্টই আসল। পরীক্ষার হলে পেনসিল বা রাবার হারাল কি না সেটা বড় কথা নয়। প্রশ্ন, কেন এত লুকোচুরি?
সে কি লজ্জা লুকনোর জন্য? সেটাও বোধগম্য নয়। বোধগম্য নয়, কে সত্যবাদী কে মিথ্যুক।
তিন বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক শেষে মোদি বলেছিলেন, সেনানীদের ‘ফ্রি হ্যান্ড’ দেওয়া হয়েছে। অথচ, ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় দূতাবাসের ডিফেন্স অ্যাটাশে শিবকুমারের কথায়, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ঘঁাটিতে আক্রমণ না-করার জন্য তাদের হাত বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সেজন্যই যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। বিরোধীদের তোলা এই প্রশ্নের উত্তরও কেউ দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী নন, প্রতিরক্ষামন্ত্রীও নন। উত্তর দেননি বিদেশমন্ত্রীও। অথচ পহেলগাঁও কাণ্ড ও ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে পাকিস্তানকে একঘরে করার জন্য বিদেশনীতির সাফল্য সাতকাহন জাহির করেছেন তিনিও। প্রশ্নটা খুবই সহজ ছিল। এতজন সর্বদলীয় প্রতিনিধির দল এতগুলো দেশে গেল, সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পাকিস্তানের স্বরূপ তুলে ধরল, অথচ একটা দেশও কেন পাকিস্তানের নিন্দে করল না? সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা এক জিনিস, কিন্তু সন্ত্রাসবাদের জন্য
পাকিস্তানকে দায়ী করা, তার নিন্দে করা অন্য জিনিস। ১৯৩টি দেশের একটিও পাকিস্তানকে দোষারোপ করেনি। এমনকী নেপাল ও ভুটানও নয়। বরং চিন, তুরস্ক ও আজারবাইজান পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছে!
জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হরণ হয়েছে ঠিক ছ’-বছর আগে। যুক্তি ছিল, ৩৭০ অনুচ্ছেদই সন্ত্রাসবাদের কারণ। ‘বিশেষ মর্যাদা’ খারিজ হলেই কাশ্মীর স্বাভাবিক হয়ে যাবে। হল কি? মোদি-জমানায় পুলওয়ামা,পহেলগাঁও, উরি কী প্রমাণ করছে? বিদেশনীতির সাফল্যই বা কোথায়? পাকিস্তান ঋণ পেয়েই চলেছে। পাক জেনারেল আসিম মুনির হোয়াইট হাউসে জামাই আদর পাচ্ছেন। তঁাকে লাঞ্চ খাইয়ে পাকিস্তানে তেল খোঁজার দায়িত্ব নিচ্ছেন ট্রাম্প। ২৫ শতাংশ শুল্ক ও জরিমানা চাপিয়ে ভারতকে ফি-দিন কোণঠাসা করছেন। এত লজ্জা নরেন্দ্র মোদি কোথায় লুকবেন?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.