দাসব্যবসার শুরু থেকেই অসুখ এবং তার চিকিৎসা নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের সাংঘাতিক নিষ্ঠুর সব কাজের নমুনা পাওয়া যায়। বিশেষত, শ্বেতাঙ্গ চিকিৎসকরা ছিলেন দ্বিমুখী চরিত্রের। একদিকে মানবসভ্যতায় এঁদের অবদান ভোলার নয়, অন্যদিকে তাঁদের সাফল্যের পথটি ভয়ানক মনুষ্যত্বহীন, সেই অর্থে মানবসমাজের কাছে ভয়ংকর শত্রু এঁরা। লিখলেন ঋত্বিক মল্লিক।
২০১৮ সালে নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক থেকে সরিয়ে ফেলা হয় জেমস ম্যারিয়ন সিমস-এর একটি স্ট্যাচু। এক সময় পার্কে ঢুকলেই চোখে পড়ত এই স্ট্যাচুটি। কিন্তু কেন হঠাৎ সরানো হল? কোন বিতর্ক দানা বেঁধেছিল এই স্ট্যাচুকে ঘিরে? চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই জেমস সিমস-কেই শ্রদ্ধার সঙ্গে বলা হয় ‘ফাদার অফ মডার্ন গাইনোকোলজি’। ১৮১৩ সালে আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারোলিনায় তঁার জন্ম, পরবর্তী কালে অস্ত্রোপচার-সংক্রান্ত নানা ধরনের পদ্ধতি আর যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন তিনি করেন, যা বিশেষ করে স্ত্রীরোগ-চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। এহেন একজনকে ঘিরে এমন কী ঘটল যে, তঁার মূর্তিটি পার্ক থেকে সরে গেল, শেষ পর্যন্ত ঠঁাই পেল ব্রুকলিনে, তঁার সমাধির পাশে? আসলে তঁার পরিচয়ের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তঁার অবদানের স্বীকৃতি, আবার অন্যদিকে এই কাজ করতে গিয়ে যেসব ভয়াবহ পৈশাচিক পদ্ধতির সাহায্য তিনি নিয়েছিলেন, তারই প্রতিক্রিয়া রয়ে গেল তঁার মূর্তি সরিয়ে দেওয়ার মতো তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে।
১৮৪৫ থেকে ১৮৪৯ সাল অবধি নিজের একখণ্ড জমিতে একটি অস্থায়ী কুঁড়েঘর বানিয়েছিলেন সিমস। তখন আমেরিকায় দাসপ্রথার খুবই রমরমা। সিমস সেখানে প্রচুর ক্রীতদাসী কিনে রাখতেন আর তঁাদের ওপর চালাতেন নিজের অস্ত্রোপচার-সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই কাজে তঁার যাবতীয় ব্যর্থতা, ভুল সংশোধন করে নিখুঁত করার জন্য একাধিক অস্ত্রোপচার– সবই চলত এই মেয়েদের শরীরের উপর এবং স্বাভাবিকভাবেই, এর জন্য কারও কাছে কোনওরকম জবাবদিহি তঁাকে করতে হত না। ভয়াবহ অত্যাচারের যাবতীয় সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিল তঁার পরীক্ষাপদ্ধতি। আমেরিকার লেখক ও অধ্যাপক হ্যারিয়েট ওয়াশিংটনের দীর্ঘ গবেষণালব্ধ ‘Medical Apartheid’ বইয়ে বেশ কয়েকজন চিকিৎসকই তঁাদের পূর্বসূরি রূপে সিমস-এর কথা বলতে গিয়ে একটি ইংরেজি বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন— ‘American Janus of medicine and race’। অর্থাৎ, রোমের দুই মাথাসম্পন্ন দেবতা জানুসের মতোই এই জাতীয় ডাক্তাররা আসলে দু’-মুখো, একদিকে মানবসভ্যতায় এঁদের অবদান ভোলার নয়, অন্যদিকে তঁাদের সাফল্যের পথটি ভয়ানক মনুষ্যত্বহীন, সেই অর্থে মানবসমাজের ভয়ংকর শত্রু এঁরা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মহান মুখোশের নীচে এঁদের পৈশাচিক রূপ কখনওই তেমন দেখা যায় না।
পার্ক-ডেভিস ফার্মাসিউটিক্যালসের হেড কোয়ার্টারে রবার্ট থমের অঁাকা একটি ছবি টাঙানো আছে। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসী হঁাটু মুড়ে বসে আছেন একটা টেবিলের ওপর। একটু দূরে হাতে স্পেকুলাম হাতে দঁাড়িয়ে আছেন সিমস। ‘স্পেকুলাম’ হল এমন একটি যন্ত্র, যা দিয়ে শরীরে যে কোনও ক্যাভিটি বা প্যাসেজ (এক্ষেত্রে যোনি) ফঁাক করে দেখা যায়। মহিলা যদি বাধা দেন, তাহলে তঁার উপরে জোর খাটানোর জন্য আরও দু’জন লোক জামার হাতা গুটিয়ে হাজির। একটা সাদা চাদর টাঙানো আছে, আর তার পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছেন আরও দু’জন দাস। ছবিটা প্রাথমিকভাবে দেখতে খুব ভয়াবহ লাগবে না,
দেখে মনে হবে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বার্থে মানুষী পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে আইনসিদ্ধ করতে চাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ছবির ভিতরের অর্থটা যিনি বুঝবেন, তঁার কাছে এ সত্যও গোপন থাকবে না যে, পরীক্ষা চলছে এক কৃষ্ণাঙ্গী ক্রীতদাসীর ওপর। এই ছবিটা সেক্ষেত্রে একটা প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত যে, ডাক্তার সিমস ঠিক কাদের ওপরে তঁার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। হ্যারিয়েট ওয়াশিংটন এই ছবিটি তঁার বইয়ে ছাপাবেন বলে পার্ক-ডেভিস ফার্মাসিউটিক্যালসের কাছে অনুমতি চাইলে তারা তা দিতে অস্বীকার করে। অথচ আন্তর্জালে এই ছবি যথেষ্ট সহজলভ্য।
হ্যারিয়েট ওয়াশিংটন দেখাচ্ছেন, দাসব্যবসার শুরু থেকেই অসুখ এবং তার চিকিৎসা নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের সাংঘাতিক নিষ্ঠুর সব কাজের নমুনা পাওয়া যায়। আফ্রিকা থেকে প্রচুর কালো মানুষকে ধরে যখন জাহাজে করে আমেরিকায় নিয়ে আসা হত, তখন যদি তঁাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ থাকতেন, বা পথে অসুস্থ হয়ে পড়তেন, তাহলে তঁাদের স্রেফ অতলান্তিক মহাসাগরে ছুড়ে দেওয়া হত। ধরে নেওয়া যায়, সুস্থসবল, আদর্শ মনুষ্যদেহী গিনিপিগ বাছাইয়ের এই প্রথম ধাপ। তারপর বাজারে এঁদের নিলাম করার ঠিক আগে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করানো হত, কারণ সামান্য কোনও শারীরিক সমস্যা থাকলেও তঁার দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না। কিনে নেওয়ার পরেও অসুস্থ হয়ে পড়তেন কেউ কেউ, তঁাকে কঠোর পরিশ্রম করানো হত, চিকিৎসার কোনও প্রশ্নই ছিল না, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর চিকিৎসা বলতে ছিল ভয়াবহ মারধর। এই সমস্ত ঝাড়াইবাছাই শেষে যঁারা এসে পড়তেন ডাক্তারদের হাতে, সুস্থতা-অসুস্থতা নির্বিশেষে তঁাদের শরীর হয়ে উঠত ডাক্তারদের যাবতীয় অপরীক্ষিত এবং অসুরক্ষিত ওষুধ প্রয়োগের আর চিকিৎসার বস্তু।
এমনই একবার এক কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাফ্রো-আমেরিকান ক্রীতদাসের চোয়ালের হাড়ে ক্যানসার ধরা পড়ল, অস্ত্রোপচার দরকার। কিন্তু তিনি বিপদ বুঝে এই অস্ত্রোপচার করতে দিতে একেবারে রাজি হলেন না। তখন তঁাকে জোর করে, প্রায় হাত-পা বেঁধে, তঁার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অস্ত্রোপচার করা হল। ‘মেডিকেল এথিকস’-এর কেস স্টাডি হিসাবে এই ঘটনাটি প্রায়শই আলোচনায় আসে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ঘটনার পর থেকে এই ডাক্তারটির বেশ নামডাক হল এবং তিনি নাকি দাসদের জটিল চিকিৎসা, বিশেষত অঙ্গচ্ছেদনে দক্ষ বলে চারিদিকে প্রচারিত হল। সেই সময় চিকিৎসক থেকে সাধারণ শ্বেতাঙ্গ মানুষের মধ্যে একটা চালু ধারণা ছিল যে, কালো মানুষরা শারীরিকভাবে কোনওরকম যন্ত্রণা তেমন অনুভব করে না। এবং এই ধারণার বশেই সাদা চামড়ার ডাক্তাররা সার্জারির আগে অজ্ঞান করারও প্রয়োজন বোধ করতেন না।
আর-একদিকে আমেরিকায় মেডিকেল কলেজের সংখ্যা যত বাড়তে লাগল, শব ব্যবচ্ছেদের জন্য তখন প্রচুর মৃতদেহ প্রয়োজন হয়ে পড়ল। মর্গে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ দেহ চুরি করে কিংবা কবর খুঁড়ে তুলে আনা এনে দেহ দিয়ে প্রয়োজন মেটানো হত। এসব মৃতদেহের অধিকাংশই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের। ১৯৮৯ সালে জর্জিয়ার মেডিক্যাল কলেজের নিচে পাওয়া গেল হাজার-হাজার হাড়, পরীক্ষা করে দেখা গেল, এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই অ্যাফ্রো-আমেরিকানদের, যদিও এই কলেজের আশপাশে বসবাসকারী কালো মানুষের সংখ্যা ৪২ শতাংশ। নিউ ইয়র্কের নিগ্রো সমাধিক্ষেত্রে (আগে এর নাম ছিল ‘আফ্রিকা-আমেরিকান সেমেটারি’) পাওয়া যায় ১৫ হাজার কালো মানুষের দেহ। কোনওরকম সম্মতির তোয়াক্কা না-করে বিভিন্ন চিকিৎসা-সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার রেওয়াজ রীতিমতো চালু ছিল বিশ শতকেও। এই কাজে লাগানো হত জেলবন্দি কালো মানুষদের। এর থেকে রেহাই পেত না শিশু বা কিশোররাও। হোমসবার্গ প্রিজন কুখ্যাত হয়ে আছে এই কারণে। এইখানেই চলেছিল ‘XXY Syndrome’ নিয়ে ভয়াবহ গবেষণা। এই রোগে আক্রান্ত পুরুষদের থাকে একটি অতিরিক্ত ‘এক্স’ ক্রোমোজোম এবং শৈশবে বা বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের মধ্যে উপসর্গগুলি ক্রমশ প্রকট হয়। এখানে বন্দি কৃষ্ণাঙ্গ নাবালকদের শরীরে এই রোগ সঞ্চারিত করে তাদের ব্যবহার করা হত চিকিৎসার স্বার্থে। এছাড়াও নতুন ওষুধের প্রাথমিক প্রয়োগও করা হত এখানে। গত দশকের ছয় ও সাতের দশকে আমেরিকার কয়েকটি প্রতিরক্ষা সংস্থার (MKNAOMI) অধীনে চলতে থাকে জৈবিক যুদ্ধের (Biological Warfare) প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির অংশ হিসাবে, হ্যারিয়েট দেখিয়েছেন যে, বেছে বেছে কালো মানুষ অধ্যুষিত এলাকায় ঝঁাকে-ঝঁাকে ছেড়ে দেওয়া হত বিশেষ জীবাণু-বাহক মশা, দেখা হত, কত দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে পীতজ্বর আর অন্যান্য সংক্রামক মারণব্যাধি।
চিকিৎসা জগতের এরকম অজস্র বর্ণবিদ্বেষী উদাহরণ ছড়িয়ে আছে হ্যারিয়েটের লেখায়। এই লেখা শেষ করব কুখ্যাত ‘Tusegee Syphilis Study’-র প্রসঙ্গ দিয়ে। উপসর্গহীন সিফিলিসে আক্রান্ত ৩৯৯ জনের সঙ্গে একেবারেই আক্রান্ত নন এরকম ২০১ জনকে একসঙ্গে রাখা হল। এঁরা ছিলেন সীমাহীন দারিদ্রের মধ্যে থাকা কালো মানুষ এবং বলা হল এক বিশেষ তুচ্ছ কারণে মাত্র ছয় মাসের জন্য এই ব্যবস্থা। এর বিনিময়ে কিছু সুবিধা মিলবে ঘোষণা করা হল। ‘ইউনাইটেড স্টেটস পাবলিক হেলথ সার্ভিস’ (PHS) এবং ‘সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ (CDC)-এর যৌথ প্রচেষ্টায় এই ‘স্টাডি’-র আসল লক্ষ্য ছিল, কোনওরকম চিকিৎসা না করলে সিফিলিস ঠিক কী আকার নেয়, যদিও তত দিনে এই রোগ নিরাময়ের ওষুধ পাওয়া গিয়েছে। ছ’-মাসের কথা বললেও এই ‘স্টাডি’ অবশ্য চলেছিল ৪০ বছর জুড়ে। এর ফলে দেখা গেল, ২৮ জন সিফিলিসেই মারা গেলেন, ১০০ জন মারা গেলেন সিফিলিসের জন্য অন্যান্য শারীরিক জটিলতার কারণে, ৪০ জনের স্ত্রীর মধ্যে ছড়িয়েছে রোগ আর ১৯ জন শিশু আক্রান্ত হয়েছে জন্মগত সিফিলিসে।
এ বই পড়ার পর যা হল, এখন তো যে কোনও প্রাণদায়ী ওষুধ হাতে নিলেই মনে পড়বে ‘মেডিক্যাল অ্যাপারথেড’ বইয়ের কথা। পাশাপাশি, এই কথাও তো বলা উচিত যে, শুধু যে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সঙ্গেই এমন ঘটেছে, তা নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমনকী আমাদের দেশের ভয়াবহ দরিদ্র মানুষ, সমাজের একেবারে প্রান্তিক মানুষ কিংবা অন্যান্য জনজাতির মানুষের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে গিয়েছে। চিকিৎসা বা ওষুধ প্রাণ ফিরিয়ে দেয় মানুষকে, আবার এরই নেপথ্যে প্রাণ দিয়েছে কত লক্ষ নিরীহ মানুষ– অদ্ভুত এই প্যারাডক্সের সামনেই আসলে আমাদের দঁাড় করিয়ে দেন হ্যারিয়েট ওয়াশিংটন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.