মহারাষ্ট্র বিজয়ের এমন উন্নাসিক দেওয়াল লিখন কিন্তু আদতে বলে না- সেখানে ভুয়ো ভোটার চক্র কেমন করে সহায়তা করছে বিজেপিকে। ছবি: প্রতীকী
ইদানিংয়ের ‘পলিটিক্যাল ইকোসিস্টেম প্যাটার্ন’– মূল অভিযোগের জবাব না দিয়ে সমস্বর প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে বিরুদ্ধস্বর চাপা দেওয়ার প্রবণতা। সেই সূত্র ধরেই কমিশনের বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর আনা ‘ম্যাচ ফিক্সিং’-এর অভিযোগ বিজেপি খণ্ডন করার পথে হাঁটেনি। বরং রাহুল ও কংগ্রেসকে দমাতে চেয়েছে তারা রাজনৈতিকভাবে। এবং বিরোধীরা ছন্নছাড়া। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
রাহুল গান্ধী মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে ‘ম্যাচ ফিক্সিং’-এর মারাত্মক অভিযোগ আনা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন চুপ। ৭২ ঘণ্টা কেটে গেলেও কমিশন-কর্তারা একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। কারণ, কমিশনের নামে যা কিছু বলা হচ্ছে– সবই ‘সূত্রের বরাত’-এ। রাহুল কমিশনকে কিছু জানাননি। কোনও অভিযোগ করেননি। কমিশনের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধও জানাননি। অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে তারা উত্তর দেবে। যে সংবাদপত্রে রাহুলের নিবন্ধ ছাপা হয়, সেই কাগজই পরের দিন লেখে, নির্বাচন কমিশনের সূত্র বলেছে, ম্যাচ হারার পর রেফারিকে দোষারোপ করা ইদানীংকালের রীতি। কমিশনের বদনাম করা-ই ‘লক্ষ্য’। রাহুলের অভিযোগ অবাস্তব।
এ এক অদ্ভুত যুক্তি! লোকসভার বিরোধী নেতা সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে নিজের নিবন্ধে অভূতপূর্ব অভিযোগ আনছেন এবং বলছেন বিহার বিধানসভার ভোটেও নির্বাচন কমিশন এই কাজই করবে, অথচ কমিশন তার জবাব দেবে না? পাশ কাটাতে বলবে, তাদের চিঠি না দিলে কিছু বলবে না? একদিকে এই কথা বলবে, অন্যদিকে ‘সূত্র’ মারফত নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করবে? রাহুলের অভিযোগ ‘কাল্পনিক, মনগড়া ও রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক’ হলে নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্যই তো সরাসরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে ‘প্রকৃত তথ্য’ পেশ করা উচিত’! তা না করে এই ধরনের লুকোচুরি কিন্তু বুঝিয়ে দেয় ডাল মে সত্যিই কুছ কালা হ্যায়।
কমিশন গায়ে না-মাখলেও ‘ম্যাচ ফিক্সিং’-এর অভিযোগ ওঠা মাত্র বিজেপি নেতারা রে-রে করে রাহুলের দিকে তেড়ে গিয়েছেন। বিজেপির সভাপতি জে. পি. নাড্ডা থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ অভিযোগের জবাবে যা বলেছেন, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক। যেমন, রাহুল ক্রমাগত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও জনতার রায় অসম্মান করে চলেছেন। তাঁর কোনও গ্রহণযোগ্যতাই নেই। মানুষ তাঁর দলকে প্রত্যাখান করে চলেছে। যত প্রত্যাখাত হচ্ছেন তত আজগুবি গল্প ফাঁদছেন, জিতলে কমিশন ঠিক হারলে কারচুপি ইত্যাদি ইত্যাদি। লক্ষণীয়, রাহুল যে-যে কারণে (প্রমাণ-সহ) কমিশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, নাড্ডা বা ফড়নবিশেরা তা খণ্ডন করার পথে হাঁটেননি। তাঁরা রাহুল ও কংগ্রেসকে দমাতে চেয়েছেন রাজনৈতিকভাবে।
এটাই ইদানীংয়ের বিজেপির ‘পলিটিক্যাল ইকোসিস্টেম প্যাটার্ন’। মূল অভিযোগের জবাব না-দিয়ে সমস্বর প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে বিরুদ্ধস্বর চাপা দাও। প্রয়োজনে তাদের ‘দেশবিরোধী’ তকমা দাও। স্যোশাল মিডিয়ায় বদনাম করো। ইডি, সিবিআই লেলিয়ে দাও। এই প্যাটার্নের প্রচুর উদাহরণ আছে। টাটকা নমুনা ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রিকে আক্রমণ ও জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের এফআইআর।
রাহুল মোট পাঁচটি বিষয়ের উত্থাপন করেছেন। প্রতিটির আধার সরকারি পরিসংখ্যান। শুরু করেছেন নির্বাচন কমিশন কবজা করা দিয়ে।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও দুই কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে এত কাল কোনও আইন ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিল। তত দিন পর্যন্ত কমিশন সদস্যদের নিযুক্ত করতেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেতা ও প্রধান বিচারপতি। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি অনেক দিন ধরেই সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ পদ্ধতির অংশ হতে আগ্রহী। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট নারাজ। সরকার সেই শোধ নেয় নির্বাচন কমিশনের নিযুক্তি থেকে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে।
২০২৩ সালে আইন পাস করে প্রধান বিচারপতির জায়গায় আনা হয় আরও এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। এক্ষেত্রে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ফলে হল কী, একদিকে রইলেন শাসক দলের দু’জন, অন্যদিকে বিরোধী নেতা। যে-প্রতিযোগিতার জন্য আম্পায়ার নিযুক্ত করা হচ্ছে– প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দু’জনই সেখানে প্রতিযোগী! প্রতিযোগীরা কেন নিরপেক্ষ বিচারক বসাতে যাবেন? নিযুক্তরাও-বা কেন ‘খাঁচার তোতা’ হবেন না? অনুগত তোতা না হলে কী হয় তা বুঝতে প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসার পরিণতি স্মরণ করুন।
কমিশনের দেওয়া চারটি পরিসংখ্যান দাখিল করে রাহুল এরপর দেখিয়েছেন, বিজেপিকে জেতাতে কারচুপি কীভাবে করা হয়েছে। যেমন, ভুয়া ভোটার তালিকা। ২০১৯ সালে মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটার ছিল ৮ কোটি ৯৮ লাখ। ২০২৪ সালের মে মাসে লোকসভায় ভোটার বেড়ে হয় ৯ কোটি ২৯ লাখ। অর্থাৎ, ৫ বছরে ভোটার বাড়ে ২১ লাখ। ৫ মাস পর ২০২৪ সালের নভেম্বরে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা বেড়ে হয় ৯ কোটি ৭০ লাখ। একবার ভেবে দেখুন, ৫ বছরে যেখানে ভোটার বাড়ছে ৩১ লাখ, সেখানে মাত্র ৫ মাসে ভোটার বাড়ছে ৪১ লাখ! কারচুপিরও সীমা থাকে। সেই সীমা পেরিয়ে কমিশন নিজেকে হাস্যকর করে তুলেছে কারণ, সরকারি হিসাবে মহারাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৯ কোটি ৫৪ লাখ। অথচ ভোটার তার চেয়েও বেশি!
ভোটার ভুয়ো হলে সেই ভূতেরা বসে না থেকে দাপাদাপি করবেই। করেওছে। কীরকম, সেটা রাহুলের দেওয়া আরও এক উদাহরণ। বিকেল ৫টা পর্যন্ত রাজ্যে ভোট পড়েছিল ৫৮.২২ শতাংশ। পরদিন সকালে কমিশন জানাল, সন্ধে ৬টা পর্যন্ত পড়া ভোটের হার ৬৬.০৫ শতাংশ! এর মানে শেষ এক ঘণ্টায় এত ভোট পড়ল যে শতাংশের হার ৭.৮৩ বেড়ে গেল! রাহুল একটি তালিকা পেশ করে দেখিয়েছেন, ২০০৯ সালে প্রাথমিক ভোটদান হয়েছিল ৬০ শতাংশ, কিন্তু চূড়ান্ত হার সামান্য কমে হয় ৫৯.৫০ শতাংশ। ২০১৪ সালে ৬২ শতাংশ বেড়ে হয় ৬৩.০৮। ২০১৯ সালে ৬০.৪৬ শতাংশ বেড়ে হয় ৬১.১০। অথচ ২০২৪ সালের বিধানসভা ভোটে ৫৮.২২ শতাংশ বেড়ে হল ৬৬.০৫? এক লাফে ৭.৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি? শেষ প্রহরে এভাবে বেছে-বেছে ভুয়া ভোটার হাজির করানোর সঙ্গে ব্র্যাডম্যানীয় ক্রিকেটের তুলনা করেছেন রাহুল। আমার তো মনে হয়, এই উল্লম্ফন দেখে কিংবদন্তি পোল ভল্টার সের্গেই বুবকাও ভিরমি খাবেন!
৫ মাস আগে মহারাষ্ট্রে যে-বিজেপি সবান্ধব লোকসভা ভোটে পর্যুদস্ত হয়েছিল, ৫ মাস পর বিধানসভায় ১৪৯ আসনে লড়ে কী করে তারা ১৩২টিতে জেতে, রাহুল সে-ই রহস্যই উদ্ঘাটন করেছেন। নিরপেক্ষতার নামাবলি টান মেরে খুলে বেআব্রু করে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনকে। সূত্রের বরাতে কমিশন যে-যুক্তি খাড়া করেছে, প্রতিটিই পাশ কাটানো। পাবলিক ডিবেটে একটাও ধোপে টিকবে না। তা সত্ত্বেও মোদি সরকার ও বিজেপি এত নিরুদ্বিগ্ন, কারণ, রাহুল একা। তঁার দল দুর্বল। বিরোধীরা ছন্নছাড়া। যে-যার খাসতালুকে জমি ধরে রাখার কসরতে ব্যস্ত। সবচেয়ে বড় কথা, বিজেপির শক্তিশালী ও কার্যকর ‘ইকোসিস্টেম’ ১১ বছর ধরে বারবার অগণিত দশরথকে দশচক্রে ঘিরে ভূত বানিয়ে চলেছে। এবারেও তার অন্যথা হওয়ার নয়।
বিজেপির ইকোসিস্টেমের ‘সাফল্য’-র নবতম উদাহরণ পহেলগাঁও কাণ্ড ও ‘অপারেশন সিঁদুর’। পহেলগাঁওয়ের নিদারুণ ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা নেই। একটা মাথাও কাটা পড়েনি। একজনও ধরা পড়েনি। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ‘লোকসানের খতিয়ান’-ও অনুল্লিখিত। অনুচ্চারিত। সেনা সর্বাধিনায়ক বলেছেন, ক’টা উইকেট পড়ল সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা জয় এল কি না। সেই ‘জয়’ নিয়ে ‘ইকোসিস্টেম’ যেমন তোলপাড়, ভারতের ‘পাঁচটা ফাইটার নামিয়ে’ পাকিস্তান তার দ্বিগুণ বেশি উৎফুল্ল। সত্যি এই, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক ঋণ পেয়েই চলেছে। সন্ত্রাসবাদের মদতদার বলে একজনও তাদের দাগায়নি। কুয়েত ভিসা ‘নিষেধাজ্ঞা’ তুলে নিয়েছে। সন্ত্রাস দমনে রাষ্ট্র সংঘও পাকিস্তানকে কাছে টেনেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পও ভারত-পাকিস্তানকে একাসনে বসিয়ে দু’-দেশকেই বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন। ১২ মে থেকে ৫ জুন– ২৫ দিনে ট্রাম্প ৯ বার বলেছেন, তাঁর হুমকিতেই যুদ্ধবিরতি। মোদি কিন্তু একবারও বলেননি ট্রাম্প মিথ্যুক। স্বীকার করেননি ভারতের কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতার সত্যতাও। বরং পতপত করে উড়ছে জয়ধ্বজা। চলছে মোদি-বন্দনা। খড়কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছে যাবতীয় প্রশ্ন। বিরুদ্ধ সমালোচনা। রাহুল গান্ধীর তোলা ‘ম্যাচ ফিক্সিং’-এর অভিযোগও এভাবে অচিরেই মিলিয়ে যাবে বিজেপির দুর্নিবার ইকোসিস্টেমের প্রাবল্যে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.