প্রতীকী ছবি
ইন্টারনেটকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করি। তাই তারও কিছু প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া থাকবে সেটা অস্বাভাবিক নয়। তাই যত গোপন ভিডিও-ছবি ফাঁস হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দোষ দেওয়া হবে, ততই এই প্রবণতা বাড়বে। বরং জোর গলায় যদি বলতে শুরু করা যায়, হ্যাঁ এটা আমি… তখন দেখা যাবে প্রথমদিকে একটু হাল্লাগুল্লা হলেও একসময়ে ওই ‘ট্যাবু’গুলি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। লিখছেন বিনোদ ঘোষাল।
কিছুদিন ধরে বাংলার নেটদুনিয়ায় রাজনীতি ছাড়া অন্য যে বিষয়টি নিয়ে তুমুল চর্চা হচ্ছে তা হল বেশ কয়েকজন পরিচিত নামের ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হওয়া। সেই ছবি এবং ভিডিওগুলি প্রচলিত অর্থে আপত্তিকর। যাঁদের নিয়ে এই চর্চা, তাঁরা বলছেন সেগুলি আসল নয়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা সংক্ষেপে AI দিয়ে তৈরি। তাঁদের বদনাম করার উদ্দেশ্যেই তাঁদের ‘শত্রুপক্ষ’ এই কীর্তি করছেন।
বেশ। তাঁদের কথা মেনে নিলাম। ধরে নিলাম তাঁরা সকলে সত্যি বলছেন। এবং তাঁদের কথা সত্যি হলে কাজটি অন্যায়, অনৈতিক। কিন্তু যদি ধরে নেওয়া যায় তাঁদের ওই ছবি-ভিডিওগুলি সত্যি, এবং তাঁরা সঠিক বলছেন না- তাহলে? তাঁরা কি কোনও গূঢ় অপরাধ করেছেন? শারীরিক আকাঙ্ক্ষা মানুষের একটি স্বাভাবিক বিষয়। এবং সেই আকাঙ্ক্ষা তাঁরা মিটিয়েছেন কারও প্রতি বলপূর্বক নয়, কারও অনিচ্ছায় নয়, একান্তই পারস্পারিক আগ্রহে। এবং সেই আনন্দের উপকরণ হিসেবে তাঁরা আধুনিক মোবাইল নামক যন্ত্রটিকেও ব্যবহার করেছেন, সেটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে অসুবিধাটি কোথায়?
এমন নয় যে তাঁরা আর পাঁচটি সাধারণ মানুষের থেকে শরীরগতভাবে ভিন্ন, একই অঙ্গে একই রূপ। তাই তাঁরা যদি বলেন যে, হ্যাঁ এটা আমিই। আমাকে ছবিতে বা ভিডিওতে যেমনটি দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ছেন দেখে কি মনে হয়েছে আমার শারীরিক গঠন বা কার্যকলাপ আপনি বা আপনাদের থেকে আলাদা? এবং আমি কোনও অন্যায় করিনি, কারও ক্ষতি করিনি, কিন্তু আপনি বা আপনারা আমার অনুমতি না নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাই অপরাধী আপনি।
এই মর্মে অবশ্যই আইনের দ্বারস্থ হওয়া যায়। কিন্তু আমাদের সোশাল ট্যাবু এতই ভয়ানক যে আনন্দ নেওয়ার উপকরণ হিসেবে আমরা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেব, অথচ তার সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যদি আমার ক্ষেত্রে সবসময় সুফলদায়ক না হয় তবে তাকে অস্বীকার বা দোষারোপ করব এবং আঁকড়ে ধরব ভিক্টোরিয়ান যুগের ধারণাকে- সেটা একপ্রকার দ্বিচারিতা। আমরা ওষুধ খাই তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে জেনেও খাই। আমরা ইন্টারনেটকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করি। তারও কিছু প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া থাকবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই যত বলবেন ওটা আমি নই, সব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দোষ ততই এই প্রবণতা বাড়বে। বরং জোর গলায় যদি বলতে শুরু করা যায়, হ্যাঁ এটা আমি, তো? তখন দেখবেন প্রথমদিকে একটু হাল্লাগুল্লা হলেও একসময়ে ওই ‘ট্যাবু’গুলি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।
এবার আসি দ্বিতীয়পক্ষের কথায়। যাঁদের ফটো বা ভিডিওগুলি কোনও কারণে ছড়িয়েছে সেইগুলি দেখার জন্য নেটদুনিয়ার একটি মস্ত অংশ এমনই ব্যাকুল যে ‘লিংক দাও, লিংক দাও’টা অনেকটা ‘ফ্যান দাও, ভাত দাও’-এর মতো হাহাকার হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন হল, এমনটা কেন? আমরা কি কেউ অপরের অনাবৃত শরীর কখনও দেখিনি? অবশ্যই দেখেছি, দেখি, সেটাই স্বাভাবিক। তাহলে এঁদের দেখার জন্য এই প্রাণান্তকর কাতর চিৎকার কেন? এমন নয় ‘তাঁদের’ বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি অতি অসাধারণ, অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাও আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি ওই পরিচিত, বিখ্যাতদের ওইরূপে দেখব বলে- এই মানসিকতা আসলে একপ্রকার হীনমন্যতা থেকে আসে।
পরিচিতির দিক থেকে আমি তাঁর ধারেকাছে নই, কিন্তু তাঁকে ‘অপ্রস্তুত’ অবস্থায় দেখছি- এর মধ্যে এক উদ্ভট উল্লাস রয়েছে। ‘‘এই দেখ তোকে এই অবস্থায় দেখে ফেললাম’’ গোছের বাহাদুরি রয়েছে। ব্যর্থ জিতে যাওয়ার সান্ত্বনা রয়েছে। তাঁকে সামাজিকভাবে খানিকটা অপদস্ত করতে পেরে তুরীয় আত্মতৃপ্তি রয়েছে- সেই জন্যই এই আস্ফালন, এই বিকৃত চিৎকার।
সব শেষে বলি, AI-এর বুদ্ধি রয়েছে কিন্তু মন নেই। তাই মান-অভিমানও নেই। তাই তার ঘাড়ে শতবার দোষ চাপানোর পরেও যদি পরমুহূর্তে তার কাছে কোনও বিষয়ে সাহায্যের হাত পাতি, সে অভিমানে মুখ ফেরাবে না। পালটা প্রশ্ন করবে না, আমার কী দোষ ছিল বলো তো? তাই AI-কে সবসময় দোষের ভাগী না করে আমাদের মানে উভয়পক্ষের দোষটুকু বুঝে তাকে শোধরানোর সময় হয়েছে। এখন অপেক্ষা, সেই দিন আসতে আর কত দেরি।
(মতামত ব্যক্তিগত)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.