প্রতীকী ছবি
নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা। পরপর সাক্ষী গণ-অভ্যুত্থানের। ভারত উচ্চাভিলাষী ‘গ্লোবাল সাউথ’-কে নেতৃত্ব দিতে। অথচ পড়শি দেশে বাড়ছে অস্থিরতা। এমন অবস্থায় মাটির কাছাকাছি কী ঘটছে তাতে আমল দেওয়া প্রয়োজন। লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম বৈদেশিক নীতির উদ্যোগের কথা মনে আছে? নিজের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত দেশের নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যা একটি ‘মাস্টারস্ট্রোক’। বলা বাহুল্য, এই পদক্ষেপ ভারতের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ঐক্যের ক্ষেত্রে চুম্বক হিসাবে কাজ করেছিল। এর এগারো বছর পরে, ‘সার্ক’-এ অবশ্য দেখা গেল না সেই পুরনো তাগিদ। তার জায়গায় মাথাচাড়া দিল অকল্পনীয় জটিল অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা, অর্থনৈতিক সংকট ও পারস্পরিক বিরোধ। যে টালমাটাল পরিস্থিতিতে মোদি সরকারের ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ (‘প্রতিবেশী প্রথম’) বুলি নিতান্তই ভোঁতা শোনাল।
সম্প্রতি, নেপালের সহিংস বিক্ষোভের উদাহরণটিই ধরা যাক। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অস্থিতিশীলতায় জর্জরিত দেশটি। ২০১৫ সালে, যখন একটি নতুন সংবিধান কার্যকর হয়, তখন থেকে নেপাল মোট ন’টি সরকারের অধীনে থেকেছে, যার মধ্যে দশম সরকার ক্ষমতায় আসার পথে। দারিদ্র, বেকারত্ব, দুর্নীতি ও কুশাসনের এক মারাত্মক মিশ্রণ-শেষে কফিনের অন্তিম পেরেকটি হল– সোশ্যাল মিডিয়ার স্বাধীন গতিবিধিতে হস্তক্ষেপ করার ফলে– অগ্ন্যুৎপাতের গতিতে জনরোষের ছড়িয়ে পড়া। নয়াদিল্লির পররাষ্ট্রনীতির কৌশলীরা হয়তো সহজে স্বীকার করবেন না, তবে নেপালের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে ঘটা বিক্ষোভের তীব্রতা ও ভয়াবহতার এমন ধার স্পষ্টতই মোদি সরকারকে বিস্মিত করেছে, শঙ্কিত করেছে।
স্মৃতিতে ম্লান, এমন আরও একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিই। নেপাল সেই ‘দ্বিতীয়’ বিদেশি দেশ (ভুটান প্রথম), যেখানে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সফরে গিয়েছিলেন মোদি। সেবার মুহূর্তে ‘ভাইরাল’ হয়েছিল পশুপতিনাথ মন্দিরে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থনারত ছবিসমূহ: দেশবাসী মোদির এমনতর ভক্তিময় রূপে মোহিত হয়ে ধরেই নিল, হিন্দুত্ব-কেন্দ্রিক নেতৃত্বের প্রতীক তিনি, তঁার সাহাযে্যই দু’-দেশের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিকড় পুনরুদ্ধার হবে। এমনতর নিপুণ ‘অপটিক্স’ অবশ্য বাস্তবের সামনে মুখ থুবড়ে পড়তে অবশ্য বেশি সময় নেয়নি।
২০১৫-’১৬ সালে ভারত-নেপাল সীমান্তে পঁাচ মাসের অনানুষ্ঠানিক ‘অবরোধ’-কে অনেক নেপালবাসী-ই নয়াদিল্লির তরফে কাঠমান্ডু উপর শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার একটি অন্যায় প্রচেষ্টা হিসাবে দেখেছিল। এর ফলে দু’-দেশের তিক্ততা এমন পর্যায় পৌঁছয় যে, নেপালের তরফ থেকে মানচিত্র পুনর্নির্মাণ এবং সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকা সম্প্রসারণের দাবি ওঠে। এমন হুজুগে উত্তেজনাপূর্বক পদক্ষেপ থেকেই বোঝা যায়, নেপালের রাজনীতিবিদরা স্থানীয় আন্তঃদলীয় সমর্থনের জন্য ভারত-বিরোধী রাজনীতিকে কোন স্তরে কীভাবে উসকে দিয়েছিলেন।
এক অর্থে দেখলে– নেপালের সাম্প্রতিক জেন-জি বিক্ষোভ কিন্তু গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশে যা ঘটেছিল তারই নবতম প্রতিফলন যেন। নেপালে সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা থেকে বিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিভিল সার্ভিসে সংরক্ষণ নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। কাঠমান্ডুর মতো, ঢাকাতেও, দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের প্রতি জনসাধারণের অসন্তোষ একটি বৃহত্তর অভিজাত-বিরোধী, প্রতিষ্ঠা-বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। গণ-অভু্যত্থানের জেরে অবশেষে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনও ঘটে।
হাসিনা সরকারে সঙ্গে রাজনৈতিক সুসম্পর্ক ভুলে মোদি সরকার তখন পিছিয়ে আসে কিছুটা। ভারতবিরোধী, বিশেষ করে হিন্দুবিরোধী শব্দভাণ্ডার-সহ উগ্র ইসলামপন্থী শক্তির উত্থানের অর্থ– নয়াদিল্লির নিজস্ব আদর্শিক অবস্থানে আটকা পড়ে যাওয়া। সমালোচকদের প্রশ্ন– হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিকে এগিয়ে রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত এ-দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের কি সত্যিই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার বা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার প্রয়োজনের কথা বাংলাদেশকে মনে করিয়ে দেওয়ার মতো নৈতিক অবস্থান ছিল? ২০২৪ সালের গণ-অভু্যত্থানের পর থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে, ঢাকার সঙ্গে, নয়াদিল্লি, সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য লড়ছে, যদিও ভারতে শেখ হাসিনার দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক নির্বাসন বাংলদেশকে সরাসরি শত্রুতায় নামিয়ে না আনলেও পড়শির সঙ্গে ভেঙ্ে যাওয়া সম্পর্কের পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বহাল রেখেছে।
এবার চোখ রাখা যাক শ্রীলঙ্কার দিকে। সে-দেশটিও নিকট অতীতে বিবিধ অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানির ঘাটতি, গভীরতর অর্থনৈতিক সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক রাজপরিবারকে সেখানে পিছু হটতে বাধ্য করে মানুষ। রাজাপক্ষে ভাইয়েরা, যাঁরা আপাতদৃষ্টিতে দ্বীপরাষ্ট্রটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন, তঁাদের প্রায় রাতারাতি দেশ থেকে বিতাড়ন করা হয়। নাগরিক বিক্ষোভকারীদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি ভবন দখলের চিত্রগুলি প্রতীকী হয়ে ওঠে। কীভাবে অমিতশক্তিধর শাসকরাও গণ-আন্দোলনের ঝুঁকিমুক্ত নয়। সেবারও মোদি সরকার প্রাথমিকভাবে চক্ষু মুদিয়া ছিলেন। তবে রাজাপক্ষে পরিবারের সঙ্গে মোদির ব্যক্তিগত সমীকরণ মধুর হওয়ার দরুন পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কার বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ করেন তিনি।
উপরোক্ত দেশগুলির দুর্দশার জন্য ভারত কোনওভাবেই সরাসরি দায়ী নয়, তবে ২০২৪ সালে ‘ক্ষুদ্র’ মালদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক অচলাবস্থা চাইলেই এড়ানো যেত। সে-সময় তিক্ততার জেরে ক্ষমতাসীন দলের অতি-জাতীয়তাবাদী সোশ্যাল মিডিয়া বাহিনী মোহাম্মদ মুইজ্জুর নেতৃত্বাধীন মালদ্বীপ সরকারের প্রায় প্রত্যেককে ‘ইন্ডিয়া আউট’, ‘চায়না ইন’ স্লোগান আওড়াতে বাধ্য করেছিল। বলা বাহুল্য– মুইজ্জুর ভারতবিরোধী বক্তব্য উসকানিমূলক ছিল এমন নয়, অপ্রয়োজনীয়ও বটে।
এদিকে সেলিব্রিটি ও নেটিজেনরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে মালদ্বীপ-ভ্রমণ বয়কটের যে আহ্বান জানান সেই প্রয়াসকেও সংবেদনশীল বৈদেশিক নীতির রাজনীতিকরণের একটি উদ্বেগজনক উদাহরণ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়, যা করা হয়েছিল কেবলমাত্র দেশীয় উগ্রপন্থাকে তাতিয়ে দেওয়ার স্বার্থে। প্রধানমন্ত্রী মোদির সাম্প্রতিক মালদ্বীপ সফর উত্তাপ কমানোর ইঙ্গিতবাহী হলেও কীভাবে সাধারণ বিরোধের ফলে বৃহত্তর সমস্যা দেখা দিতে পারে তারও জ্বলন্ত উদাহরণ মালদ্বীপ।
এবার নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে আরও পরিচিত এবং ভারতের চিরন্তন ‘শত্রু’ পাকিস্তানের কথা বলতেই হয়। পাকিস্তানের দ্বারা সীমান্ত সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংহতিকে নষ্ট করার জন্য দায়ী, সন্দেহ নেই। তবে ইসলামাবাদের প্রতি মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির গতি পরিবর্তন যারপরনাই অপ্রত্যাশিত। হঠাৎ ‘দোস্তি’-র হিড়িক। তারপরই প্রতিশোধের তীব্র দহন। যেমন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের কথা মনে করুন। মোদি-শরিফের আলিঙ্গন উৎসব চলল লাহোরে, আবার হালে সন্ত্রাসী হামলাই ‘যুদ্ধের পদক্ষেপ’ বলে বিবেচিত।
পাকিস্তান সন্দেহাতীতভাবে সর্বৈব ব্যর্থ একটি রাষ্ট্র। সেনাবাহিনী ও জিহাদি ফঁাদ থেকে বের হতে অক্ষম। কিন্তু নয়াদিল্লি যে একটি সুসংগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দক্ষিণ এশীয় নীতি তৈরির করতে পারেনি, পাকিস্তানের বিদ্বেষপরায়ণের উদাহরণ টেনে, সেই ব্যর্থতাকে ঢাকাচাপা সম্ভব কি? ভারত এদিকে উচ্চাভিলাষী ‘গ্লোবাল সাউথ’-কে নেতৃত্ব দিতে, কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে। অথচ একাধিক পড়শি দেশে ক্রমাগত বাড়ছে অস্থিরতা। আরও সমস্যার হল, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য বিস্তারের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চিনের অন্য দেশের নরম জমিতে সুযোগ পেলেই অঁাচড় কাটার প্রবণতা।
এই সমস্ত কারণেই ভারতের ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার দাবির জরুরি পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন: পশ্চিমের স্বীকৃতির তীব্র আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে, দেশের কাছাকাছি, মাটির কাছাকাছি কী ঘটছে তাতে বিশেষ করে আমল দেওয়া প্রয়োজন। সীমান্তবর্তী দেশগুলিকে বিপাকে ফেলা বা তাদের প্রতি নরম মনোভাব প্রদর্শন: কোনওটিই কৌশলী রাজনীতির পরিচয় নয়। নেপালে যা ঘটল, গত বছর বাংলাদেশ যা ঘটেছে, তারও আগে শ্রীলঙ্কা যা ঘটতে দেখেছি– কে জানে আগামীতে তা ভারতে ঘটবে কি না!
পুনশ্চ: এপ্রিল মাসে পহেলগঁাও হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে বয়ান রাখে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার, যে শাসনব্যবস্থাকে ভারত স্বীকৃতিও দেয় না। কৌশলগত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, বিপদের দিনে এমনতর ‘বন্ধু’ কি ভারতের প্রয়োজনে আসবে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.