প্রয়াত সুষমা স্বরাজ ২০১৩ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে মনমোহন সিং সরকারকে নিশানা করে বলেছিলেন, ‘উত্তরাখণ্ডে প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে বিকাশের নাম করে যা শুরু হয়েছে তাতে ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। নদীর উপর বাঁধ রাস্তা তৈরিতে প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। মানুষ বিপদে পড়বে।’ লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
মাত্র ৩৪ সেকেন্ড। তার মধ্যে একটি জনপদ পাথর-কাদা-মাটির নিচে সম্পূর্ণ ডুবে গেল। বহু মানুষ চাপা পড়ল। যেন তাসের ঘরের মতো উড়ে গেল দোকান-বাজার, বাড়ি-স্কুল, হোটেল-মন্দির। অাপাতনিরীহ ক্ষীরগঙ্গার রোষে সলিলসমাধি দেবভূমির ধরালি গ্রাম। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল, কেন হল কেউ বুঝতেই পারল না।
বঁাচার সুযোগটুকু মিলল না। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণেও বোধহয় এত দ্রুত সব শেষ হয়ে যায় না। একটি শীর্ণকায়া নদী অাচমকা দানব হয়ে মাত্র ৩৪ সেকেন্ডে গিলে খেল ছোট্ট সাজানো উপত্যকাকে। বদলে দিল ভূগোল। প্রকৃতির সামনে অামরা কতটা অসহায় অাবার প্রমাণিত হল। উলটোদিকের পাহাড় থেকে যারা মোবাইলে সেই দৃশ্য বন্দি করতে পেরেছিল, তাদের জন্যই জানা গেল অাসলে কী ঘটেছে। ভয়ংকর সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে ‘২০১২’ নামক বিখ্যাত সিনেমাটি মনে পড়ে যাচ্ছিল। বিশাল ঢেউ ঢেকে দিল সুবিশাল শহর। ভেঙে দিল তিরিশ-চল্লিশ তলা সব বাড়ি। কয়েক সেকেন্ডে সব জলের তলায়।
নদীর ধ্বংসলীলার পর ধরালি অাবার শান্ত। পুরো এলাকা কাদা-পাথরের মাঠ। একটু অাগে অাধা শহর ছিল কে বলবে! কেউ পরিজনের জন্য কঁাদছে না। কারণ, কঁাদারও কেউ নেই-ও আর। সবাই হারিয়ে গিয়েছে বিপর্যয়ের গভীরে। পাশে বইছে গঙ্গা। ক্ষীরগঙ্গার সব ধ্বংসলীলা বুকে সে ধারণ করেছে। এখন সব শান্ত, সমাহিত ধরালি।
ঠিক ৩০ বছর অাগে এই ধরালি গ্রামের উপর দিয়ে গিয়েছি। তখন এলাকা এতটা জমজমাট ছিল না। গাছপালা অারও বেশি ছিল। চা-টিফিন খাওয়ার ছোট-ছোট দোকান রাস্তার পাশে। গঙ্গোত্রী মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে। উপরে বরফ। জমে থাকা অগুনতি হিমবাহ। নিচে স্রোতস্বিনী গঙ্গা, গা দিয়ে সবুজ গাছপালার মধে্য জনপদ। ধরালি যেন নন্দনকানন! অামাদের গন্তব্য ছিল গঙ্গোত্রী।
সেখান থেকে গোমুখ ট্রেকিং। পরে হিমবাহ পেরিয়ে শিবলিঙ্গ পাহাড়ের নিচে তপোবন। তখন অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ছিল। পথে কোনও সমস্যা হয়নি। পুরোটায় ট্রেক রুট। গঙ্গোত্রী থেকে ১৮ কিলোমিটার হেঁটে গোমুখ যাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকেরই অাছে। ১০-১২ হাজার ফুট উপরে ট্রেকিং হলেও এই পথ ততটা চড়াই নয়। যে কেউ চলে যেতে পারে।
গোমুখের অাগে ভুজবাসায় ছিল লালবাবার অাশ্রম। তখন একমাত্র থাকার জায়গা। এখন তিনি অাছেন না নেই অামি জানি না। অাশ্রমটি নিশ্চয়ই অাছে। অাশ্রম বলতে মাটির নিচে পাথরের ঘর। ঠান্ডার হাত থেকে বঁাচতে ব্যবস্থা। লালবাবাকে অামাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল। খুব গল্প করতে ভালবাসতেন। বাংলাটা ভালই বলেন। নাগা সন্ন্যাসীর মতো সারাদিন খালি গায়েই। শীত-টিত লাগত না।
অাশ্রমে দুটো উনুনে সারা দিন রান্না হচ্ছে খিচুড়ি ও চা। উনি অামাদের দেখামাত্র বলেছিলেন, ‘বাঙ্গাল সে… পেহলে নাম এন্ট্রি করো, চা ও খিচুড়ি খাও, উসকে বাদ কমরে মে যাও, অারাম করো।’ শীতের সময় উনি সমতলে নেমে অাসতেন। ডিসেম্বর থেকে মার্চ এলাকা পুরো বরফের তলায় চলে যায়। পশ্চিমবঙ্গে বাবার প্রচুর ভক্ত। সবার ঠিকানা রেখে দিতেন। চার-পঁাচ মাস বাড়ি বাড়ি ঘুরে অন্ন গ্রহণ করতেন। পুজোর পর ফিরে যেতেন পাহাড়ে।
তঁার একটি কথা এখনও অামার মনে অাছে। এই মুহূর্তে খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হল। সুবিশাল গঙ্গোত্রী হিমবাহের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘এই বরফের পাহাড় দেখছ, অাসলে মা গঙ্গা। উনি অাসছেন স্বর্গ থেকে মর্তে। এই মাটিতে কোনও পাপীর জায়গা নেই। যত বেশি মানুষ অাসবে, তত গ্লেসিয়ার গলে যাবে। হিমালয়ে দেবতারা থাকেন, এটা সবার জায়গা নয়।’
কী সতি্যকথা! হিমালয়ে দেবভূমিতে হিন্দু জাগরণের অঙ্ক কষে এখন উত্তরাখণ্ডের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ-লক্ষ মানুষ তীর্থ করতে যাচ্ছে। তার জেরেই কি দেবতারা রুষ্ট? কেদার থেকে উত্তরকাশী, কুলু থেকে সিকিম– পর-পর কেন বিপর্যয়? কোথাও মেঘভাঙা বৃষ্টি, কোথাও হিমবাহ ধসে জল, কোথাও ধস, কোথাও অাবার ডায়নামাইটের কম্পনে পথ ভেঙে নদীতে। গত ৩০ বছর ধরে প্রকৃতিকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে মানুষ। দেবতার প্রতিশোধ চলছে, চলবেও।
ধরালির বিপর্যয়ের পর লক্ষ করলাম, যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করা হল। উত্তরাখণ্ড সরকার দ্রুততার সঙ্গে সব চেপে যাওয়ার চেষ্টা করল। মৃতু্যর হিসাব কমিয়ে দিল। প্রাকৃতির বিপর্যয় বলে মূল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া হল। কিন্তু অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ হবে না।
সতি্যটা বেঅাব্রু হয়ে পড়েছে। দেবভূমি হয়ে উঠেছে রাজনীতির ভরকেন্দ্র। যে-কেদারে দিনে ২০০ তীর্থযাত্রী যেতে পারে, সেখানে প্রকৃতির ব্যালেন্স নষ্ট করে দিচ্ছে দিনে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি। ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে চারধামকে এক সূত্রে বঁাধার প্রকল্প হাতে নিয়েছে উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার। প্রায় হাজার কিলোমিটার ছোট-বড় রাস্তায় উন্নয়ন হবে। সেগুলি চওড়া করা থেকে নদীর উপর ব্রিজ বানানোর মতো নানা উন্নয়ন প্রকল্প। গ্রিন ট্রাইবুনাল বলেছে, ঠিক হচ্ছে না। পাহাড় ফাটিয়ে নতুন করে রাস্তা-হোটেল-জনপদ তৈরি করলে ধস নামবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে ধর্মীয় ‘উন্নয়ন’। যত মানুষ দেবতার গৃহে অাসবে, তত ‘হিন্দু জাগরণ’।
মজার কথা হল, উত্তরাখণ্ডের যে ডাব্ল ইঞ্জিন সরকার এই কাজ প্রোমোট করছে সেই দলের নেত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজ ২০১৩ সালে সংসদে দঁাড়িয়ে মনমোহন সিং সরকারকে নিশানা করে বলেছিলেন, ‘উত্তরাখণ্ডে প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে বিকাশের নাম করে যা শুরু হয়েছে তাতে ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। নদীর উপর বঁাধ রাস্তা তৈরিতে প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। মানুষ বিপদে পড়বে।’ রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের এটাই সমস্যা। যখন ক্ষমতার বাইরে থাকেন তখন তঁারা একরকম, অাবার যখন ক্ষমতায় বসে গেলেন তখন অাগের সরকারের চটি পায়ে গলিয়ে ফেলেন। সুষমা কংগ্রেসকে ‘লক্ষ্য’ করে যা বলেছিলেন, ঠিক তার উলটো এখন করছে তঁার দল।
গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে ইউরোপ তথা উন্নত দেশগুলি প্রকৃতির উপর অত্যাচার থামাতে কঠোর মনোভাব নিলেও ভারতে সব উলটো। গাছপালা ধ্বংস করে নগরায়ন, পাহাড়ে রাস্তা ও রেলের জন্য টানেল তৈরি, নদীর পথ রুদ্ধ করে জলাধার তৈরি হিমালয়ের বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। হিমালয় ভঙ্গিল পর্বত। এই কারণে ব্রিটিশরা যখন পাহাড়ে রেল ও রাস্তা তৈরি করেছিল, তখন তা বৈজ্ঞানিকভাবে করা হয়েছিল। যত রেল টানেল ভারতের মধ্য ও দক্ষিণ প্রান্তে তারা বানিয়েছিল, সেসব পাহাড় অাগ্নেয়শিলায় তৈরি বলেই। হিমালয়ে তারা এই ধরনের কাজ করেইনি। এখন কোনও নিয়মনীতি নেই। পরিবেশ অাইন মানার দায় নেই। রাজনীতি সবার অাগে।
ধরালির ঘটনা অশনি সংকেত। এই বিপর্যয় মেঘভাঙা বৃষ্টিতে নয়। সেদিন বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ২৭ মিলিমিটার। তাহলে সহসা জল এল কীভাবে? তথ্য ভয়ংকর। উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ও প্রকৃতির ব্যালেন্স নষ্ট করার জন্য হিমালয় পাহাড় অারও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। লে থেকে অরুণাচল, সুদীর্ঘ বরফ সাম্রাজ্যে বড় পরিবর্তন ঘটেছে গত কয়েক দশকে। ৩০০-র বেশি গ্লেসিয়ার গলে ছোট-বড় লেক তৈরি করেছে। সহসা সৃষ্টি হওয়া সেই লেক ফেটে জল নেমে অাসছে। কখনও জলের চাপ বৃদ্ধি অাবার কখনও মৃদু্ কম্পন। সরে যাচ্ছে পাথর। লেক ভেঙে যাচ্ছে।
রাস্তা তৈরির জন্য পাহাড়ে বিস্ফোরণের প্রভাবও পড়ছে। ক্ষীরগঙ্গার উৎসমুখে এমন ঘটনাই ঘটেছে। হিমবাহ-গলা জল জমে ছিল। কোনওভাবে পাথর সরে গেলে জল ঝঁাপিয়ে পড়েছে নিচে। যত নেমেছে তত তার শক্তি বেড়েছে। স্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়েছে বড় বড় পাথর। অন্তত ১৪-১৫ হাজার ফুট থেকে জল নেমে এলে কী হতে পারে!
সিকিমের দক্ষিণ রউনাক লেক ফেটে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হিমালয় পাহাড় এখন মৃতু্যফঁাদ। ধরালির দশা যে কোনও দিন যে কোনও সময় যে কোনও প্রান্তে হতে পারে। পাহাড়ে বসবাস করা শুধু নয়, বেড়াতে যাওয়া অার নিরাপদ নয়। দেবভূমিতে দেবতার অালয়ে পাপীদের স্থান নেই। লালবাবা কথাটা কবে বলেছিলেন! কেন বলেছিলেন? উত্তর তঁার প্রশ্নের ভিতরেই ছিল। এখন বুঝছি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.