ইউক্রেনের ‘চিলড্রেন অফ ওয়ার পোর্টাল’-এর হিসাব বলছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে এখনও পর্যন্ত ১৯,৫৪৬টি শিশু রাশিয়া-কর্তৃক অপহৃত, নির্বাসিত। সুপরিকল্পিতভাবে ইউক্রেনীয় ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভুলিয়ে তাদের পুরোপুরি রুশ করে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। মনে পড়ছে– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোলিশ শিশুদের জার্মানিকরণের প্রসঙ্গ। লিখছেন গৌতম সরকার।
সেনিয়া কোল্ডিন উত্তর ইউক্রেনের খারকিভ অবলাস্টের ভবচান্সক শহরে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বাস করত। সতেরো বছরের কোল্ডিন স্কুলের পড়া শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক সেই সময় তাকে সামার ক্যাম্পের কথা বলে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়– তার ভাইয়ের বয়স তখন বারো।
যুদ্ধ শুরুর প্রথম বছরেই রোস্তিস্লাভ লাভরভের দিদিমা মারা যায়। কিছু দিন পরে রুশ মিলিটারিরা চিকিৎসার নামে তার মাকে নিয়ে যায়। ১৬ বছরের লাভরভ পৃথিবীতে একদম একা হয়ে যায়।
কয়েক মাস মাস বাদে মিলিটারিরা আবার আসে, এবার লাভরভকে নিয়ে যায় রাশিয়া অধিকৃত অঞ্চল ক্রিমিয়ায়। তিন বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধে রাশিয়া কেবলমাত্র ইউক্রেনের জমি দখল করছে ভাবলে ভুল করা হবে, জমির সঙ্গে সঙ্গে তারা হাজার-হাজার ইউক্রেনীয়দের অপহরণ করে নিজের দেশে নিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু। ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেল আন্দ্রেই কোস্টিন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অফিসার তঁাদের সতর্কবার্তায় জানিয়েছেন, রাশিয়া এই শিশুদের মগজধোলাই করে তাদের মধ্যে ইউক্রেন সম্পর্কে ঘৃণাবোধ জাগিয়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
‘ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও’-র বরিষ্ঠ সাংবাদিক অপহৃত হওয়া উপরোক্ত দুই বাচ্চার সঙ্গে কথা বলে বন্দিজীবনে তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছেন। সতেরো বছরের সেনিয়া কোল্ডিন জানিয়েছে, সেখানে তাদের জোর করে রুশ ভাষা শেখানো হচ্ছিল, মাতৃভাষায় কথা বললে শাস্তি দেওয়া হত। তাকে এক রুশ পরিবারের সঙ্গে রাখা হয়, যারা তাকে সর্বদা বলত, “ইউক্রেনের ধ্বংস অনিবার্য, আগামী দিনে ‘ইউক্রেন’ বলে কোনও দেশ-ই মানচিত্রে থাকবে না। সেখানে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করবে না।”
আঠারো বছরের রস্তিস্লাভ লাভরভের অভিজ্ঞতাও আলাদা কিছু নয়। লাভরভ জানিয়েছে, রাশিয়ান সৈন্যরা তাকে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়ায় নিয়ে আসার পর, রুশ জাতীয় সংগীত গাইতে অস্বীকার করায়, তাকে একটা ৬ বাই ৬ ঘরে আটকে রাখা হয়। কেড়ে নেওয়া হয় তার মোবাইল। এই দুই কিশোরকে ‘সেভ ইউক্রেন’ সংস্থা উদ্ধার করে নিজ-দেশে ফিরে আসতে সাহায্য করে। ঘরে ফিরে কোল্ডিন তার ১২ বছরের ভাইকে পেয়ে খুব আনন্দিত, লাভরভ চায় তার মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসুক– তবে এর সমাধান ‘সেভ ইউক্রেন’ কীভাবে করবে জানা নেই।
‘সেভ ইউক্রেন’-এর মাইকেল কোলেবার মতে, কোল্ডিন ও লাভরভের মতো হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে আটক রাখা হয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে ইউক্রেনীয় ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভুলিয়ে তাদের পুরোপুরি রুশ করে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। কোলেবার জানাচ্ছেন, এই শিশুদের অতি সত্বর উদ্ধারের প্রয়োজন। কারণ যার খুব ছোট, যারা এখনও ঠিক করে মা-বাবার নাম-ঠিকানা বলতে শেখেনি, তাদের খুব সহজেই অতীত ভুলিয়ে রুশ নাগরিক বানিয়ে তোলা সম্ভব। এই উদ্ধারকর্মটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ ‘শিশু কল্যাণ পরিষেবা’ ভেঙে পড়ায় আন্তর্জাতিক সাহায্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ইউক্রেনের সরকারি ‘চিলড্রেন অফ ওয়ার পোর্টাল’-এর হিসাব বলছে– ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে এখনও পর্যন্ত ১৯,৫৪৬টি শিশু রাশিয়া-কর্তৃক অপহৃত এবং নির্বাসিত হয়েছে। তবে এটি নেহাতই সরকারি হিসাব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের একটি দলের অনুমান– রাশিয়া ও তাদের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৩৫ হাজার ইউক্রেনীয় শিশু আটকে আছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এসব শিশুর সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিছু শিশুর ঠঁাই হয়েছে সরকারি শিশু নিবাসে। আবার বেশ কিছু শিশুকে রুশ পরিবারগুলো দত্তক নিয়েছে। রুশ কোর্ট, সম্প্রতি দত্তক আইনের সংশোধন ঘটিয়েছে, যাতে করে প্রতিপালক বাবা-মা শিশুর নাম, পদবি, জন্মস্থান এমনকী জন্ম তারিখ পর্যন্ত পরিবর্তন করে তার অতীত সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে ইউক্রেনের শিশুদের রুশ নাগরিক বানিয়ে তোলার ঘটনাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় পোলিশ শিশুদের জার্মানিকরণের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
২০১৪ সাল থেকে অপহরণের ঘটনা শুরু হলেও বিষয়টি বৈশ্বিক পরিচিতি পেয়েছে ২০২২ সালে– বেআইনি অপহরণের সংখ্যাটি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠার পর। ২০২২ সালের ১ জুলাই ‘গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন’ ইউক্রেনীয় সরকারের পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক আন্তর্দেশীয় দত্তক গ্রহণ আইনের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে। ২০২৩ সালের মার্চের শুরুতে ৪৩টি এনজিও একটি আবেদনপত্রে দস্তখত করে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট একটা রেজোলিউশন গ্রহণ করে যেখানে বলা হয় রাশিয়াকে অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে শিশু অপহরণের অমানবিক প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া, এই রেজোলিউশনে আটকে থাকা সমস্ত শিশুর বর্তমান অবস্থান সত্বর জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের ১ জুন, আন্তর্জাতিক শিশু দিবসে, ইউক্রেনে ২৩টি বিদেশি কূটনৈতিক মিশন একযোগে এক যৌথ বিবৃতিতে রাশিয়ার কর্তৃক শিশুহরণের ঘটনাকে ‘বেআইনি এবং বর্বরোচিত’ বলে নিন্দাপ্রস্তাব আনে।
এত কিছুর পরও শিশু অপহরণ বন্ধ হয়নি, বরং শিশু নির্যাতনের ধরন বদলে গিয়েছে। রাশিয়ার ক্ষয়িষ্ণু জনসংখ্যার পরিপূরক হিসাবে এই শিশুদের নতুন দত্তক আইনের দ্বারা সহজেই রাশিয়ার নাগরিক করে তোলা হচ্ছে। সেখানে তাদের রুশ ইতিহাস জানতে বাধ্য করা হচ্ছে, রাশিয়া-অধিকৃত অঞ্চলে শিক্ষক বা ছাত্ররা রুশ পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে অস্বীকার করায় তাদের কারাবন্দি করে অকথ্য অত্যাচার চালানো হচ্ছে। বহু কিশোর-কিশোরীকে সামরিক বাহিনীতে জোর করে ভর্তি করা হয়েছে এবং চলমান যুদ্ধে এর মধ্যে বহু শিশুমৃত্যুও ঘটেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম প্রধান দরিয়া জারিভনার মতে, ‘এই শিশুদের ইউক্রেনীয় পরিচয় ধ্বংসের একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত চলছে। তাদের রুশ সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে এবং নিজ-দেশ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এটি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ।’
এতশত আশঙ্কার মধ্যে একটিই রুপোলি রেখা, গত মাসে ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প– জেলেনস্কি এবং ইউরোপের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন– এর কিছু দিন আগে আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সেরেছেন। বৈঠক-শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, আগামী ত্রিদেশীয় আলোচনায় রাশিয়া-অধিকৃত ইউক্রেনের জায়গাগুলির দাবি পুতিন আদৌ ছাড়বেন কি না তঁার জানা নেই, তবে যুদ্ধবন্দি এবং অপহৃত শিশুদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে আশাবাদী। অপহৃত শিশুদের পরিবারের সঙ্গে বিশ্ব সেদিকেই তাকিয়ে প্রহর গুনছে।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.