সোশাল মিডিয়ার কমেন্ট বক্সে প্রথম কয়েকটি মন্তব্য ইতিবাচক হলে, বাকিগুলোও সেই পথে হাঁটে। নেতিবাচক হলে, বাকিরাও নেতিবাচক মন্তব্য করে। এই প্রবণতার নেপথ্যে রয়েছে ‘সোশাল প্রুফ’ বা সামাজিক প্রমাণ তত্ত্ব। যখন মানুষ অন্যদের মতামত দেখে, তখন তারাও সেটিকেই ‘সঠিক’ বা ‘জনপ্রিয়’ ধরে নিয়ে নিজের মতামত তৈরি করে। লিখছেন সুজনকুমার দাস।
সোশাল মিডিয়া এখন আমাদের সামাজিক জীবনের অঙ্গ। এখানে মতামত তৈরি হয়, আবেগ প্রকাশ পায়, এমনকী, বাস্তব জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক সিদ্ধান্তও প্রভাবিত হয়। অথচ এই প্ল্যাটফর্মেই একদিকে দেখা যায়– কেউ দুঃখের ‘পোস্ট’ দিয়েছে, আর তাতে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট পড়ছে; অন্যদিকে দেখা যায়, এক বা দু’টি কমেন্টের উপর নির্ভর করে পুরো মন্তব্যধারা গঠিত হচ্ছে। এসব ‘ডিজিটাল আচরণ’ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এর নেপথ্যে আছে গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বাস্তবতা।
ফেসবুক বা অনুরূপ প্ল্যাটফর্মে কেউ মৃত্যুবেদনা, ব্যক্তিগত কষ্ট বা মানসিক বিপর্যয়ের কথা প্রকাশ করলে দেখা যায়, কিছু নেটিজেন সেখানে হাসির রিঅ্যাকশন দেয়। এটা একদিকে যেমন আবেগীয় অসংবেদনশীলতা, অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত ট্রোলিংয়েরও নিষ্ঠুর অসভ্য প্রকাশ। এটি বোঝার প্রাসঙ্গিক মনস্তাত্ত্বিক ধারণাটিকে বলা হয়– ‘ইমোশনাল ডিট্যাচমেন্ট ইন ডিজিটাল স্পেসেস’।
ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে শরীরী ভাষা, চোখের চাহনি বা কণ্ঠস্বরের অনুপস্থিতিতে আবেগ বুঝে ওঠা কঠিন। এই মাধ্যম আমাদের অনুভব করার ক্ষমতা হ্রাস করে। সেই সঙ্গে অনেকের মধ্যে তৈরি হয় এক ধরনের অনলাইন নিষ্ঠুরতা (অনলাইন ক্রুয়েলটি), যা অন্যের কষ্টে হাসতে শেখায়। তাছাড়া, অনেকেই পোস্টের মর্মার্থ উপলব্ধি না-করে, ভালো করে না দেখে-না বুঝেই হাসির রিঅ্যাক্ট দেয়, শুধু অভ্যাস বা মনোযোগহীনতার কারণে। আবার অনেকে বুঝেই উঠতে পারে না যে ‘হা-হা’ রিঅ্যাক্ট এখানে অনুচিত– এটা একপ্রকার ‘কগনিটিভ লেজিনেস’ বা মানসিক অলসতা।
বর্তমান ডিজিটাল সংস্কৃতিতে ডার্ক হিউমারের প্রসার ঘটছে। কিছু তরুণ নেটিজেন যে কোনও আবেগকে হালকাভাবে নিয়ে ট্রোল করা বা মিম বানানোকে মজা বলে প্রতিপন্ন করে। এতে সমাজের প্রতি বা সামাজিক জীব হিসাবে তার নিজের যে সহানুভূতির অনুভব, তা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। কেউ দুঃখ প্রকাশ করলে, প্রতিক্রিয়ায়, অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে উলটো প্রতিক্রিয়া দেয়– যেন এক ধরনের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রমাণ! এবং তা করে পৈশাচিক আনন্দ পেতে তারা মরিয়া।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কোনও পোস্টের নিচে যে-মন্তব্য বিভাগ থেকে, সেটা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ এখন সাহিত্য (বই) যত না পড়ে, তার থেকে বেশি সমাজমাধ্যমের কমেন্ট সেকশনে নেটিজেনদের কমেন্ট পড়ে। মানুষের চিন্তাভাবনা সবকিছুই সেখানে প্রতিফলিত হয়। অথচ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানেও এক অদ্ভুত প্রবণতা– যে কোনও পোস্টের কমেন্ট সেকশনে প্রথম কয়েকটি মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী মন্তব্যগুলো তৈরি হয়। একদম অন্ধ অনুকরণ। প্রথম কয়েকটি মন্তব্য ইতিবাচক হলে, বাকিগুলোও সে-পথে হঁাটে। নেতিবাচক হলে, বাকিরাও নেতিবাচক মন্তব্য করে। এই প্রবণতার নেপথে্য রয়েছে ‘সোশ্যাল প্রুফ’ বা সামাজিকতার প্রমাণ তত্ত্ব। যখন মানুষ অন্যদের মতামত দেখে, তখন তারাও সেটিকেই ‘সঠিক’ বা ‘জনপ্রিয়’ ধরে নিয়ে, নিজের মতামত তৈরি করে। বিশেষ করে অনিশ্চিত বা জটিল বিষয়ে এই প্রবণতা আরও প্রকট। সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদ্মগুলো জনপ্রিয় কমেন্টগুলোকেই উপরে দেখায়, ফলে সেসব মতামত-ই সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়। এর ফলে তৈরি হয় এক ধরনের ‘কমেন্ট সেটিং’, যা বাস্তব জীবনের ‘অ্যাজেন্ডা সেটিং’-এর ডিজিটাল রূপ।
সংবাদমাধ্যমে ‘অ্যাজেন্ডা সেটিং’ একটি পুরনো তত্ত্ব, যার মাধ্যমে গণমাধ্যম নির্ধারণ করে কোন খবর বেশি গুরুত্ব পাবে, আর কোনটা নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায়– এই ক্ষমতা কিছু নেটিজেন বা ইনফ্লুয়েন্সারদের হাতে চলে গিয়েছে– যারা পোস্ট বা মন্তব্যের মাধ্যমে জনমতের গতিপথ নির্ধারণ করে। যখন নির্দিষ্ট বিষয় বারবার আলোচনায় আসে, বা প্রথমে কিছু নেতিবাচক ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য উপরে উঠে যায়, তখন সাধারণ মানুষ ওই মতামতের দিকেই ঝুঁকে পড়ে, অনেক সময় যাচাই না করেই।
এই ‘কমেন্ট’ এবং ‘অ্যাজেন্ডা সেটিং’-এর সম্মিলিত প্রভাব সমাজে গুজব, বিভ্রান্তি ও ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করতে পারে। প্রথমে কয়েকজন ভুল তথ্য বা ভুল ব্যাখ্যা দিলেই তা সত্য ধরে নেওয়া হয়। যেমন– স্বাস্থ্য, ধর্ম, রাজনীতি বা কোনও জনপ্রিয় ব্যক্তিকে নিয়ে মিথ্যা বা বিরূপ মন্তব্য প্রথমেই ‘জনপ্রিয়’ হলে, পরে সেগুলোই ‘সাধারণ ধারণা’-য় রূপ নেয়। ভুল তথ্য শুধু একবার প্রচার করলেই হয় না, সেটিকে জনপ্রিয় করে তুলতেই এই সেট আপ ব্যবহার হয়।
এই পরিস্থিতি তৈরি করে ‘স্পাইরাল অফ সাইলেন্স’। যখন একপাক্ষিক মতামত ছড়িয়ে পড়ে, তখন ভিন্নমতাবলম্বীরা চুপ করে যেতে বাধ্য হয়। এই নীরবতা আসলে বিকল্প মতের মৃত্যু। তারপর এক সময় মানুষের মনে হয়– ভিন্ন কিছু বলা মানেই অপ্রিয় হওয়া, বিদ্রুপের শিকার হওয়া, কিংবা ডিজিটাল ‘লিঞ্চিং’-এর মুখোমুখি হওয়া। এতে মতের বৈচিত্র ধ্বংস হয়, বিতর্কের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগামহীন কু-রসিকতা, ভুল রিঅ্যাক্ট, আর বিদ্রুপ– সবকিছু মিলে তৈরি করছে একপ্রকার আবেগহীন ডিজিটাল সমাজ। এখানে সহানুভূতি, সমবেদনা কিংবা শ্রদ্ধা– যেন এক ‘রিঅ্যাক্ট বাট্ন’-এ সীমাবদ্ধ। মানুষ বাস্তব জীবনে মুখোমুখি সহানুভূতি পায়, কিন্তু ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে হয় নিঃসঙ্গ, হয় বিদ্রুপের শিকার। এর ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা, মেরুকরণ, ও মানসিক দূরত্ব।
সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের এই মিডিয়ার প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা দরকার– বিশেষত কিশোর-কিশোরীদের। ‘রিঅ্যাক্ট’ বা ‘কমেন্ট’ দেওয়ার আগে ভাবা, যাচাই করা, এবং অন্যের আবেগের প্রতি সম্মান দেখানো একটি সামাজিক দায়িত্ব। মেঘনাদের মতো আড়াল থেকে মন্তব্য করা যায় বলে, অন্যের ভাবাবেগকে আহত করে যা খুশি মন্তব্য করা উচিত নয়। সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম-ও যেন ভুল বা বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যকে প্রোমোট না করে, তার জন্য অ্যালগরিদমিক স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, অনলাইনে সদাচরণ, সহানুভূতি, ও সহমর্মিতা চর্চা করাও সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য এক ধরনের সামাজিক আন্দোলন।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.